মুক্তকথা

সিলেটে আল্লামা দিলওয়ার হোসেন সাঈদী রহঃ

৷৷ আহমদ কুতুব ||
লেখক: প্রাবন্ধিক, কমিউনিটি একটিভিস্ট

আঞ্জুমানে খেদমতে কোরআনের ব্যানারে সিলেটবাসীর প্রথম পরিচয় ঘটে আল্লামা দিলওয়ার হোসেন সাঈদীর সাথে।
শুরুতেই আঞ্জুমানে খেদমতে কোরআনের কিছু ধারণা তুলে ধরা আবশ্যক মনে করি।
স্বাধীনতা উত্তর ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কারণে ভিন্ন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও ছিলো সীমিত। মাদ্রাসা ও মসজিদে শুধু জমিনের নিচে মৃত মানুষের সাথে কি আচরণ করা হবে এবং  আকাশের উপরে কি পুরুস্কার দেয়া হবে এবং  কিছু কিচ্ছা কাহিনি সম্মিলিত বয়ানকেই সাধারণ মানুষের জন্য কোরআনের শিক্ষা বিবেচিত হত। জমিনের জন্য কোরআনের দিকনির্দেশনা প্রায় ছিলোই না। কোরআন খানি, মৃতের কাছে বসে ও কবরের পাশে কোরআন তালায়ত করা, নামাজ রোজার জন্য মুখস্ত কিছু দোয়া কালাম শিখে নেয়ার মধ্যেই সীমিত ছিলো সাধারণ মানুষের কাছে কোরআনের প্রচার। যেনো কোরআন শুধু মৃতদের জন্য নাজিল করা হয়েছে। কোরআন যে জীবন্ত মানুষের কিতাব এই ধারণা ধীরে ধীরে অস্তিত্ব হারাচ্ছিল ।
সেই সময় কোরআনের দা’য়ীরা সচেতন নাগরিকদের নিয়ে সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারে কোরআনের জীবন্ত বাণী সাধারণ জনগণের মাঝে তুলে ধরার লক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ শুরু করেন। এই সময় সিলেটেও মাঠে ময়দানে কাজ করার চেষ্টা চলছিল। কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেউ বা সমমনাদের নিয়ে মাঠে আসার চেষ্টা করছিলেন। নবজাতকের প্রসববেদনার মত দা’য়ীরা চটপট করছিলেন। তখন মাঠে ময়দানে মুজিব বাহিনীর খবরদারী ছিলো প্রখর। যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দেয়ার প্রচুর সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু কোরআনের দা’য়ীরা হাত গুটিয়ে নিরব তামাশা দেখেননি।
এক সময় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের ব্যানারে সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়।
তখন সিলেটে বাংলাদেশ মসজিদ মিশনরে সভাপতি ছিলেন সিলেট আলিয়া মাদ্রাসার সনামধন্য মুহাদ্দিস উস্তাদ আব্দুল মালিক চৌধুরী রহঃ, সেক্রেটারী ছিলেন জামাত নেতা অধ্যাপক ফজলুর রহমান। সম্মিলনের প্রধান অতিথি ছিলেন, সাবেক আমেরিকা ইউনিভার্সিটি ও আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার আধুনিক আরবি প্রভাষক মাওলানা আলাউদ্দিন আল-আজহারী রহঃ আর বিশেষ অতিথি ছিলেন অধ্যাপক মওলানা আখতার ফারুক রহঃ।
মসজিদ মিশন ছিলো সরকার নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কাজে সরকারের নির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকায় উদ্যোক্তারা ভিন্ন ব্যানারে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
আলাউদ্দীন আল-আজহারী সাহেব মসজিদ মিশনের সভাপতি থাকায় তাঁর নিজেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো।
এই পেক্ষাপটে সিলেটে কোরআন প্রেমিক উদ্যোক্তারা বিকল্প পথে হাটতে শুরু করেন।
প্রথমেই তাঁরা চাপমুক্ত সাহসী একজন আলোচক খুঁজেতে থাকেন।
অবশেষে আল্লামা দিলওয়ার হোসেন সাঈদীকে তাঁরা আমন্ত্রণ জানান। তখনো কোনো প্লাটফর্ম তৈরী করা হয়নি, কোনো একটা ব্যানারে তাঁকে আনা হয়েছিলো- এখন আর স্মরণ নেই এবং সেই ব্যানারের নামটাও আর কখনো ব্যবহার করা হয়নি।
সাঈদী সাহেবকে সিলেটে আনার উল্লেখযোগ্য উদ্যোক্ততাদের মধ্যে ছিলেন, উস্তাদ আব্দুল মালিক চৌধুরী, অধ্যাপক ফজলুর রহমান, ডঃ শাহ মাহবুবুস সামাদসহ আরো আনেকেই।
১৯৭৪ সালে জুন অথবা জুলাই মাসে ওয়াজের জন্য আল্লামা সাঈদী প্রথম সিলেট আসেন।
সিলেট শাহজালাল দরগাহ মসজিদের সামনের মাঠে স্থান নির্ধারণ করা হয়, উল্লেখ্য স্থান নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা তৈরী হয়। দরগাহ কতৃপক্ষ কোনো মতেই মাঠে প্রোগ্রাম করতে দিবেন না। মরহুম ডঃ শাহ মাহবুবুস সামাদের একান্ত নিরলস প্রচেষ্টায় অবশেষে অনুমতি মিলে।
সেদিন দরগাহ মসজিদের মাঠে আল্লামা সাঈদী সিলেটবাসীর উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রথম বক্তব্য রাখেন। সে দিন যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁদের জানা থাকার কথা আল্লামা সাঈদী সুরায়ে আদ-দুহার তাফসির করেছিলেন।
এই প্রথম নতুন আঙ্গিকে ও নতুন আবেদনে কোরআনের তাফসির শুনে সিলেটবাসী মোহিত ও মুগ্ধ হয়।
তখন তো আর মোবাইল-টুইটার বা ফেইসবুক ছিলো না কিন্তু তাঁর পরও সিলেটবাসীর কাছে সাঈদীর ওয়াজ এতই সমাদৃত হয়েছিলো যে, সিলেটের অলি-গলি, দোকান-পাট সর্বত্র সাঈদী রহঃ এর ওয়াজ শুনা যাচ্ছিলো। 
জনগণের ব্যাপক সমর্থনে উদ্যোক্তাদের সাহস-উদ্দীপনা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
১৯৭৪ সালে রমজান মাসে ইলম ও আমল অর্জনের এজেণ্ডা নিয়ে আঞ্জুমানে খেদমতে কোরআন প্রতিষ্ঠা করা হয়।
প্রতিষ্ঠাকালিন সভাপতি আলিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস উস্তাদ মরহুম আব্দুল মালিক চৌধুরী এবং সেক্রেটারী অধ্যাপক ফজলুর রহমান ছিলেন।
পরবর্তি কমিটিতে ছিলেন সাবেক ডিস্ট্রিক্ট ডিপুটি মাজিস্ট্রেট মরহুম জনাব মদরিস আলী চৌধুরী এবং সেক্রেটারী মুহাদ্দিস মরহুম আব্দুল মালিক চৌধুরী।
উল্লেখ্য ই’লম ও আমল নিয়ে কাজ করার প্রত্যয়ে আঞ্জুমানে খেদমতে কোরআনে প্রতিষ্ঠা হলেও আল্লামা দিলওয়ার হোসেন সাঈদী রহঃ এর অনুরোধে “খেদমতে খালক” (মানব সেবা) সংযোজন করা হয়।
আঞ্জুমানে খেদমতে কোরআনের আমন্ত্রণে প্রতি বছরই সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আল্লামা দিলওয়ার হোসেন সাঈদী কোরআনের তফসির পেশ করতেন, লক্ষ মানুষ কান উঁচু করে মুক্তাতুল্য বক্তব্য তন্ময় চিত্তে শুনতেন।
আল্লামা দিলওয়ার হোসেন সাঈদীর কোরআনের খেদমতে সিলেটের তরুণ সমাজ ব্যাপক পরিবর্তন ও আলোড়িত হয়েছে। ইংরেজি শিক্ষিত তরুণরা কোরআনকে বুঝে-শুনে পড়ার প্র্যাকটিসে অভ্যস্ত হয়েছে। আরবি শিক্ষিত তরুণরা তালাওয়াতে সাঈদী কন্ঠের অনুকরণের অনুশীলন করছে।  সাধারণ মানুষও আজগুবি কিচ্ছা কাহিনি বাদ দিয়ে কোরআন থেকে শিক্ষা নেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অনেক বক্তারা কিচ্ছা-কাহিনি বাদ দিয়ে সাঈদীর মত করে বক্তব্য রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
আল্লামা দিলওয়ার হোসেন সাঈদী রহঃ এর  খেদমতে কোরআন ও খেদমতে খালক (মানব কল্যাণ) নিয়ে আমার পক্ষে লেখে শেষ করা যাবে না। তাঁর কাজগুলো এত বিশাল ও প্রশস্ত যা একজন লেখকের পক্ষে একা লেখা সম্ভব নয়।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার কাছে তাঁর সকল কাজের হিসাব রয়েছে। শুধু এই দোয়াই করি, ইয়া রব্ব, তাঁর সকল খেদমতকে কবুল করে জান্নাতের সুউচ্চ মর্যাদা দান করো। বাংলার মানুষ কোরআনের পথে পরিচালিত হওয়া তাঁর সারা জীবনের স্বপ্নকে মেহেরবানী করে কবুল করো।

তত্ব সংগ্রহঃ অধ্যাপক ফরীদ আহমদ রেজা।
অধ্যাপক ফজলুর রহমান।
অধ্যাপক আব্দুল কাদের সালেহ

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close