মুক্তকথা

দেশকে গভীর সংকটে ফেলা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিশ্লেষণ

।। ব্যারিস্টার নাজির আহমদ।।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাক্টিসিং ব্যারিস্টার।

জাতীয়ভাবে আমাদের সাধারণ একটা অভ্যাস বা প্রবণতা হচ্ছে আমরা কোন সমস্যার গভীরে যাই না। আমরা যা চোখে দেখি তা নিয়েই মাতামাতি, তর্কাতর্কী ও গালাগালি করি। এ যেন কঠিন এক রোগের কারণ ও উপর্সগ নির্ণয় না করে সাধারণ প্যারাসিটামল দিয়ে তার প্রতিকারের চেষ্টা করা। এতে হিতে বিপরিত হয়। কঠিন রোগটি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করে রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন আর কারো তেমন কিছুই করার থাকে না। তাই রোগ বা সমস্যার মূল কারণে বা গভীরে না গিয়ে যদি সুপারফিশিয়ালী সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করা হয় তাতে সমস্যা না কমে বরং তা প্রকট আকার ধারন করতে পারে। তখন তা সমাধান ক্ষমতার বাহিরে চলে যেতে পারে। দেশ আজ গভীর রাজনৈতিক সংকটে। আর এই সংকটের গুঁড়ায় আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়। এই রায়ের প্রধান কারিগর হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। এই নিবন্ধে খুঁজবো দেশকে রাজনৈতিক সংকটে ফেলা সেই রায়ের আইনী, নৈতিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক ভিত্তি।

২০১১ সালের ১০ মে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের রায় সর্বসম্মত ছিল না। বরং এটি ছিল গভীরভাবে (অনেকটা সমান সমানভাবে) বিভক্ত রায়। রায় দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। রায় প্রদানকারী বাকি ৬ জন বিচারপতির মধ্যে ৩ জন (যথাক্রমে বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি এস কে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দেন। আবার ৩ জন (যথাক্রমে বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি মো. ইমান আলী) তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দেন। বিচারপতি মো. ইমান আলীর রায়টি একটু ভিন্ন ধাঁচের হলেও তাঁর রায় স্পষ্টত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে ছিল। একেবারে সমানভাবে বিভক্ত রায় বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোট তথা রায় বাতিলের পক্ষে চার—তিনে মেজরিটি হয়ে এই রায় সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের সংখ্যাগরিস্ট বিচারপতিদের রায় হয়।

৪:৩- এর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেয়া হয়। ওই সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আপীল বিভাগ বলেন, বিদায়ী প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারপতিদের বাদ রেখে সংসদ এ সরকার পদ্ধতি সংস্কার করতে পারে। ওই সংক্ষিপ্ত রায়ের উপর ভিত্তি করে পূর্নাঙ্গ রায় বের হবার আগেই তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করত: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে মহাজোট সরকার। অথচ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে যে গুরুত্বপুর্ন মত সর্বোচ্চ আদালত থেকে দেয়া হয় তা আমলেই নেয়নি সরকার। এত তড়িঘড়ি করার কি দরকার ছিল? পূর্নাঙ্গ রায় বের হলে পুরো রায়ের ব্যাখ্যা ও চুলচেড়া বিশ্লেষন করার সুযোগ থাকতো, থাকতো সর্বোচ্চ আদালতে পূনর্বিবেচনা করার আবেদনের অধিকার। যেহেতু ৩:৩ এ সমানভাবে বিভক্ত রায় বিচারপতি খায়রুল হকের কাস্টিং ভোট তথা রায়ে মেজরিটি হয়েছিল এবং বিচারপতি খায়রুল হক যেহেতু সংক্ষিপ্ত আদেশের পরপরই অবসরে গিয়েছিলেন, সেহেতু সমূহ সম্ভাবনা ছিল পূনর্বিবেচনায় রায় পাল্টে যাবার! সংক্ষিপ্ত রায়ের উপর ভিত্তি করে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করার কারণে সর্বশেষ এই পূনর্বিবেচনা করার আবেদনের সুযোগ ও অধিকারটিও থাকলো না।

এই রায়কে ঘিরে পর্দার আড়ালে কি যে হয়েছে তার কিছুটা আন্দাজ মিলে কয়েকটি তথ্য ও প্রমান থেকে। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অপেন কোর্টে তাঁর সংক্ষিপ্ত আদেশে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে মত দেন। কিন্তু সরকার সংক্ষিপ্ত আদেশের উপর ভর করে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার পর যখন বিচারপতি খায়রুল হক পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশ করলেন তখন পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে বলে যে মত দিয়েছিলেন তা আর রাখেন নি! কোন অধিকতর বা পরবর্তি ((More or further) শুনানী ছাড়া এভাবে রায় পরিবর্তন করা যায় না। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠে- কেউ কি তাঁকে চাপ দিয়েছিল? বা কারো সাথে কোন যোগসাজসে তেমনটি করা হয়েছিল? শুনা গেছে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরের পর রায় লিখে জমা দেয়ার পর আবার নিয়ে সংশোধন করে লিখে আবার জমা দিয়েছিলেন। এমনটি কি তিনি করতে পারেন? উন্নত বিশ্বে এভাবে রায় পরিবর্তন করাকে সিরিয়াস জুডিশিয়াল মিসকন্ডাক্ট বা বিচারসম্পর্কিত গুরুতর অসদাচরণ হিসেবে দেখা হয়।

আশ্চর‌্যের বিষয় হলো- বিচারপতি খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি হিসেবে অবসর গ্রহণের অব্যবহিত পূর্বে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী-সংক্রান্ত মামলার আপীল শুনানী করেন এবং একটি সংক্ষিপ্ত বিভক্ত আদেশ দেন। এর পরপরই তিনি অবসরে যান এবং ৭৪৭ পৃষ্ঠার পূর্নাঙ্গ রায় লিখেন ও সাক্ষর করেন অবসরে যাবার প্রায় ১৬ মাস পরে! এখন প্রশ্ন হচ্ছে তিনি যখন খুব শীগ্রই অবসরে যাবেন এবং এর ভিতরে পূর্নাঙ্গ রায় লিখা অসম্ভব তাহলে কেনইবা এই আপীল মামলায় নিজেকে জড়ালেন? তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারতেন। সম্পূর্ন শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, তিনি এই মামলার আপীল শুনানীতে এত অতিউৎসাহী ছিলেন কেন? ত্রয়োদশ সংশোধনীকে হাইকোর্টের তিনজন সিনিয়র বিচারপতি সর্বসম্মতভাব বৈধ বলে ঘোষণার পর আপিল পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে থাকলেও বিচারপতি খায়রুল হক তা হঠাৎ করে অবসরে যাবার ঠিক আগে শুনানি করার উদ্যোগ নেয়ার হেতু কি? তাও ক্ষমতাসীন দল সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণের পর!

অবসরে যাবার পর একজন বিচারপতি আর শপথের আওতায় থাকেন না। এমনকি একজন বিচারপতি অবসরে যাবার এক বছরের মধ্যে তাঁকে রাস্ট্রের দেয়া বাড়ি, গাড়ি ও স্টাফ ছাড়তে হয়। বস্তত: উনি হয়ে পড়েন একজন সাধারণ নাগরিক। এমতাবস্থায় কিভাবে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাবার প্রায় ১৬ মাস পর অত্যন্ত স্পর্শকাতর সাংবিধানিক মামলার পূর্নাঙ্গ রায় দেন এবং তাতে সাক্ষর করেন। এটা দুনিয়ার সভ্য দেশের ইতিহাসে বিরল। বিচারপতি খায়রুল হকের উত্তরসূরি সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা (যিনি স্বয়ং বিচারপতি খায়রুল হকের সাথে একমত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন) অবসর গ্রহণের পর রায় লেখা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী বলে ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারী স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন। এর আলোকে বিচারপতি খায়রুল হকের অবসরের প্রায় ১৬ মাস পরে লেখা ও সাক্ষর করা ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় কি সংবিধান পরিপন্থী হয় না? অনেকে (আমি তাদেরকে দুষ্ট লোক বলি!) বলে থাকেন বিচারপতি খায়রুল হক পরবর্তী রাস্ট্রপতি হবার সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় এগিয়ে থাকার চিন্তায় সম্ভবত: এই অতিউৎসাহ দেখিয়েছেন। তাদের এই সন্দেহ বা অভিযোগ কি একেবারে ফেলে দেয়ার মতো? বিচারপতি খায়রুল হকের ইচ্ছা যাই থাকুক না কেন, তাঁর রায়ের উপর ভিত্তি করে দেশটাকে তো গভীর সংকটে ফেলে দেয়া হলো এটা তো সত্য!

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে তিন জন বিচারপতি আপীল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন তাদের সবাইকে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বানানো হয়েছিল। শুধু তাই নয় এই মামলা শুরুর আগে বিচারপতি খায়রুল হককে দুইজন সিনিয়র ও দক্ষ বিচারপতিকে (বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান ও বিচারপতি আব্দুল মতিন) ডিঙ্গিয়ে প্রধান বিচারপ্রতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু যে তিনজন বিচারপতি আপীল বিভাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন তাঁদের সবদিক দিয়ে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সিনিয়রিটি থাকার পরও তাঁদেরকে প্রধান বিচারপতি বানানো হয় নি। বিচারপতিদের রায়ের উপর খুশী বা ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁদেরকে এভাবে পুরস্কৃত বা প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

এই মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের ৮ জন সিনিয়র আইনজীবীকে এ্যমিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু তথা আইনি সহায়তাকারী) নিযুক্ত করা হয়। এরা হলেন: সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার রফিক উল হক, সাবেক এ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. এম জহির, অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম, সুপ্রীম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার রোকনউদ্দীন মাহমুদ এবং ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি। একমাত্র ব্যারিস্টার আজমালুল হক কিউসি ছাড়া অন্য সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে আইনি ও সাংবিধানিক ব্যাখ্যা আদালতের সামনে উপস্থাপন করেন। উল্লেখ্য, এই সাতজন এ্যমিকাস কিউরি যেইসেই আইনজীবী নন। উনারা দেশসেরা ও প্রতিথযশা আইনজীবী। তাদের অনেকের ডাইরেক্ট জুনিয়ররা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসরে গিয়েছেন বা এখনও কর্মরত আছেন। আইন ও সংবিধানের এমন অভিজ্ঞ, প্রাজ্ঞ ও পন্ডিত ব্যক্তিদের মূল্যবান মতামতকে যদি পাত্তাই দিলেন না তাহলে তাদেরকে কেনইবা এ্যমিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল?

এমনকি শুনানীকালে সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে বক্তব্য প্রদান করেন। সরকার সম্পর্কিত যে কোন মামলায় সরকার তথা রাস্ট্র হচ্ছে প্রধান ও শক্তিশালী পক্ষ। সরকার বা রাস্ট্রকে রিপ্রেজেন্ট করেন রাস্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল। আর সেই প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেল যদি একমত হোন এবং সংশ্লিষ্ট মামলায় ছাড় দেন (Concede করেন) তাহলে বিচারপতিদের ভিন্ন পথ ধরার হেতু বা যৌক্তিকতা কি? আটজনের মধ্যে সাত জন দেশ সেরা আইনজীবী তথা এমিকাস কিউরী এবং মামলার শক্তিশালী পক্ষ রাস্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ্যাটর্নি জেনারেলের মতামতকে অগ্রাহ্য করে দেয়া রায়ের নৈতিক ভিত্তিইবা কতটুকু? এভাবে প্রায় সব এ্যমিকাস কিউরিদের মতামতকে ছুঁড়ে ফেলে এবং রাস্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তার ছাড় (Concede) দেয়াকে আমলে না নিয়ে অনেকটা ইউটার্ন নিয়ে রায় দেয়া জুরিস্প্রোডেন্সিয়াল হিস্ট্রিতে এক অভিনব ঘটনা।

উল্লেখ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্বলিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনৈক আইনজীবী ১৯৯৮ সালে হাইকোর্টে রিট করলে তাতে গুরুত্বপূর্ন সাংবিধানিক ব্যাখ্যা ও সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচার এর প্রশ্ন জড়িত থাকায় তৎকালীন প্রধান বিচারপতি হাইকোর্টের তিনজন সিনিয়র বিচারপতির সমন্বয়ে একটি বিশেষ ও বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করেন। পূর্নাঙ্গ ও চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট হাইকোর্টের তিন বিচারপতির বিশেষ ও বৃহত্তর বেঞ্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে বলেন, ‘১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত’[৫৭ ডিএলআর (২০০৫)]।

বৃটেনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদালত কোর্ট অব আপীলে সাধারণত তিনজন বিচারপতিকে নিয়ে বেঞ্চ গঠন হয়। তিনজন বিচারপতি সর্বসম্মত রায় না হয়ে যদি ২:১ সংখ্যা গরিষ্ঠতার রায় হয়, সুপ্রীম কোর্ট থেকে অনেকটা রুটিনলী আপীলের পারমিশন দেয়া হয় বা আবেদন করলেই পাওয়া যায়, কেননা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির ডিসেন্টিং জাজমেন্ট হলেও তা সর্বোচ্চ আদালত যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার করে। উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতির প্রজ্ঞা ও বিবেচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়। অনেক সময় মাইনোরিটি একজন বিচারপতির ডিসেন্টিং জাজমেন্টই সর্বোচ্চ আদালতে গিয়ে টিকে যায় (prevail করে)।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত হচ্ছে সুপ্রীম কোর্ট। হাইকোর্ট বিভাগ ও আপীল বিভাগ- এ দুটি বিভাগ নিয়েই বাংলাদেশের সুপ্রীম কোর্ট গঠিত। সুপ্রীম কোর্টকে সংবিধানের গার্ডিয়ান বলা হয়। সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আছে সহজাত (রহযবৎবহঃ) ক্ষমতা ও মূল/আদি (ড়ৎরমরহধষ) জুরিসডিকশন। এবার যদি আমরা সুপ্রিম কোর্টকে মাথায় রেখে বিশ্লেষন করি তাহলে দেখব এই মামলায় উচ্চ আদালত তথা সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে: মোট ছয় জন বিচারপতি ছিলেন পক্ষে (হাইকোর্টের তিন জন আর আপীল বিভাগের তিন জন) আর বিপক্ষে ছিলে চার জন বিচারপতি (আপীল বিভাগের চার জন বিচারপতি খায়রুল হকসহ)। অর্থাৎ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতি এবং এ্যামিকাস কিউরিদের ৮ জনের মধ্যে ৭ জন এবং রাস্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল পর্যন্ত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন। এমন অবস্থার পরিপেক্ষিতে দেয়া একটি রায়কে অজুহাত হিসেবে বলে ও ভিত্তি করে সংবিধান পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করলেন, তাও তড়িগড়ি করে পূর্নাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে! এর নৈতিক ও আইনী ভিত্তি কতটুকু?

উল্লেখ্য ত্রয়োদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে এই মামলা ছাড়া অতীতে আরও একটি মামলা হয়েছিল। সাঈদ মশিউর রহমান বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে বিচারপতি মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি এম এ মতিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বৈধ বলে ঘোষণা দেন [১৭ বিএলডি (এইচসিডি) (১৯৯৭)]। সুতরাং এই দুই জন বিচারপতিদের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে বলা যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের মোট ১২ জন বিচারপতি রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জন (দুই-তৃতীয়াংশ) বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে (হাইকোর্টের পাঁচ জন আর আপীল বিভাগের তিন জন) আর বিপক্ষে ছিলেন চার জন বিচারপতি (আপীল বিভাগের চার জন বিচারপতি খায়রুল হকসহ)।

উপরের আইনী দিকগুলো ছাড়াও, রাজনৈতিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের নৈতিক ভিত্তি খুবই দূর্বল। আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হলেও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের কোনো প্রস্তাব ছিল না। ফলে তা ছিল জনগণের ম্যান্ডেটের বাইরে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের সংক্ষিপ্ত রায়ের উপর ভিত্তি করে সম্পাদিত কাজ। স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের জুলাই মাসে সংসদ উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরী ও সুরঞ্চিত সেন গুপ্তের যৌথ নেতৃত্বে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়, যাতে বিএনপি অংশ নেয়নি। কমিটি তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ জন শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক বা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতাদের মতামত নেয়। বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কেউই এর বিরোধিতা করেননি। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও দল হিসেবে কমিটির কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেনি। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রীও সংশোধিত আকারে এর পক্ষে বক্তব্য দেন। কিন্তু ২০১১ সালের ৩০ মে কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে সবকিছু উল্টে যায়, সবকিছু বদলে যায়! ২০ জুন কমিটি অন্য সবার মতামত উপেক্ষা করত: একেবারে ৩৬০ ডিগ্রী ইউটার্ন দিয়ে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করে!

দেশ আজ গভীর সংকটে। আর এই গভীর সংকটের প্রধান কারণ হচ্ছে আদালতে সংক্ষিপ্ত রায়ের দোহাই দিয়ে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী তড়িগড়ি করে বাতিল করত: তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা। যে রায়ের দোহাই দেয়া হয়েছে ও হচ্ছে তার পেক্ষাপট ও ধরণ বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের আইনী, নৈতিক ও সাংবিধানিক ভিত্তি খুবই দূর্বল ও গলদপূর্ন। নৈতিকভাবে সেই রায় ও তার উপর ভিত্তি করে সংবিধান সংশোধন অনেক শঠতা, ধূর্ততা, অতিউৎসাহ ও গুজামিলে ভরপুর।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close