এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারের কালো হাত
আতঙ্কে ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা, জানালেন মুখ্যসচিব
লন্ডন, ৫ ডিসেম্বর: সাধারণ মানুষ থেকে সঞ্চয়কারী। এই মুহূর্তে যাঁদের হাতে টাকা আছে, তাঁদের একটাই প্রশ্ন—টাকা রাখব কোথায়। এ প্রশ্নের উত্তরে সবার আগে এত দিন যে উত্তরটা মিলত, সেটা হলো ‘ব্যাংক’। সেই ব্যাংকগুলোই এখন দেউলিয়া হতে বসেছে। একের পর এক ব্যাংক লুট করছে লুটেরা সরকার। ‘ব্যাংকে টাকা নেই’, এই প্রসঙ্গ আলোচনায় আসার পর গ্রাহকরা আতঙ্কে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। গত শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তিন দিনব্যাপী বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকে টাকা নেই, এটা বলার পর সত্যিকারের একটা ইমপ্যাক্ট হয়েছিল। প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা মানুষ উইথড্র করেছে। সন্মেলনে পাচারের টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ এবং ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে একই পরিবারের সদস্যদের সংখ্যা ও মেয়াদ বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদেরা। সরকারের এসব নীতি নির্ধারণে কারা বুদ্ধি দেয়, তা জানতে চান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এসব সিদ্ধান্ত নৈতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক—কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য নয়। অনুষ্ঠানে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা ব্যাংকের ঋণখেলাপির কথা বলছি। কিন্তু ব্যাংকে একই পরিবার থেকে দুজন পরিচালকের জায়গায় চারজন থাকতে পারবেন—এই নিয়ম করার বুদ্ধি কারা দিয়েছিলেন? এই পরিচালকেরা ৬ বছরের জায়গায় ৯ বছর থাকতে পারবেন—এটা করার বুদ্ধি কারা দিয়েছিলেন? চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে আনার বুদ্ধি কারা দিয়েছিল? এত বড় একটা আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে কত টাকা জমা হলো? বলা হচ্ছে, প্রতিবছর ৭ বিলিয়ন বা ৭০০ কোটি টাকার মতো টাকা বিদেশে চলে যায়। এই টাকা দেশে থাকলে তো আমাদের রিজার্ভের কোনো সংকট হতো না। তাহলে সরকারকে এই বুদ্ধিগুলো কে দিয়েছিল?’ অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহী চৌধুরী, বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস। তাঁরা কেউ এ বিষয়ে কোনো উত্তর দেননি।
এদিকে সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক এবং অতি সম্প্রতি ইসলামি ব্যাংক লুটপাট শেষে শেখ হাসিনার অবৈধ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় এখন সরাসরি বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিচ্ছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অবৈধ সরকারের চোঁখ পড়েছে। দুই দফা রিজার্ভ লুটের পর নতুন করে আরও লুটপাটের ধান্ধা করছে। দেশের ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার পুরো দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ জন্য ব্যাংক খাত নিয়ে সরকারও লিখিতভাবে কোনো নির্দেশনা দেয় না—শুরু থেকে এমনটাই চলে আসছে। কিন্তু শেখ হাসিনার অনির্বাচিত অবৈধ সরকার এখন সরাসরি বিভিন্ন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দিচ্ছে। বিভিন্ন সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করছে। আর এসব সিদ্ধান্ত যাচ্ছে ব্যাংক খাতের আমানতকারীদের বিরুদ্ধে। এতে দুর্বল হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর ঝুঁকিতে পড়ছে পুরো খাত। এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ শুধু সরকারি ব্যাংক নয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও তদারক করতে শুরু করেছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা দিন দিন কমছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী ও ব্যাংকমালিকদের হস্তক্ষেপও চলছে। গত ১৪ বছরে সরকারের ইচ্ছায় ও পরামর্শে নতুন ব্যাংক অনুমোদন, ঋণখেলাপিদের ছাড় ও সুবিধা দেওয়া, ঋণের সুদহার নির্দিষ্ট করে দেওয়াসহ নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এসব নির্দেশ ও পরামর্শ বেশির ভাগ এসেছে মৌখিকভাবে বা কোনো অনানুষ্ঠানিক সভায়। এখন নির্দিষ্ট একটি গ্রুপকে বিশেষ সুবিধা দিতে লিখিত নির্দেশ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আর শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বাড়তি টাকা ঢালতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ডেকে সভা করেছে, নির্দেশনা দিয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নথিপত্র পর্যালোচনায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, ‘মনে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো অধিদপ্তরে পরিণত হয়েছে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মন্ত্রণালয় কোনো নির্দেশনা দিতে পারে না। আমাদের সময়ে এটা চিন্তাও করা যেত না। মন্ত্রণালয় জানত এমন নির্দেশনা পালন করা হবে না। ব্যাংক খাত নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভালো জ্ঞান আছে, তাই ব্যাংক খাত নিয়ে তাদের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। নচেৎ খাতটির ক্ষতি হয়।’ ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত গভর্নর ছিলেন তিনি।