নিউজ

রয়েল লণ্ডন হসপিটালের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ, প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন বাঙালি বৃদ্ধা, বিষয়টি তদন্তাধীন: এনএইচএস

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ২৫ জানুয়ারী – পূর্ব লণ্ডনের রয়েল লণ্ডন হসপিটালের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। দায়িত্বরত স্টাফদের অযত্ন, অবহেলা ও অজ্ঞতার কারণে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী এক বাংলাদেশী বৃদ্ধাকে হাসপাতাল থেকে ঘরে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে তাঁর পরিবার। বৃদ্ধার ছেলে আব্দুল দায়াছ তার মাকে ঠিকমতো যত্ন তথা সময়মতো খেয়াল করে খাবার-দাবার না দেবার অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে ইতোমধ্যে এনএইচএস‘র সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ দায়েরের পাশাপাশি মিনিস্ট্রি অফ ডিপার্টমেন্ট, স্থানীয় এমপি, লণ্ডন মেয়র সাদিক খান ও টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রসহ ব্রিটিশ মেইনস্ট্রিম ও বাংলা মিডিয়ায় বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন।

রয়েল লণ্ডন হসপিটালে অযত্ন-অবহেলার শিকার জহুরা বিবির ছেলে আব্দুল দায়াছ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেন, ৮৬ বছর বয়সী তাঁর মা একজন স্ট্রোকের রোগী। যার কারণে ২০০৮ সাল থেকে তাঁর শরীরের বাম অংশ সম্পূর্ণ অবশ এবং তিনি নিজ থেকে খাবার গ্রহণে অক্ষম। সম্প্রতি ৬ জানুয়ারী, ইউরিন ইনফেকশনের কারণে তাকে স্থানীয় রয়েল ল-ন ভর্তি করা হয় এবং সেখানে তিনি ১৩ জানুয়ারী পর্যন্ত ছিলেন।

তিনি বলেন, জিপি কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার মায়ের ইউরিন ইনফেকশন ধরা পড়ে এবং সেটি সেরে ওঠার জন্য এন্টিবায়োটিক প্রদান করা হয়। তখন জিপি এও বলেন, যদি এতে অবস্থার উন্নতি না হয় অথবা খারাপ হয় তখন যেন ৯৯৯ এ কল করা হয়। তাকে গত ৬ জানুয়ারী, বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এম্বুলেন্স ডাকা হয় এবং সাড়ে ১০টার দিকে এম্বুলেন্স এসে পৌঁছলেও তিনি তখন কোভিডের কারণে হাসপাতালে পরিস্থিতির কথা ভেবে এবং তার মায়ের শারীরিক অবস্থার স্থিতিশীলতা দেখে ততক্ষনাৎ এম্বলেন্স পরিষেবাটি বাতিল করার জন্য বলেন। কিন্তু এম্বুলেন্স আসা পর্যন্ত ফোনের অপরপ্রান্তে থাকা মহিলা খুব ভালো ছিলেন এবং তিনি তাকে বিভিন্নভাবে সান্তনা দিচ্ছিলেন আর ততক্ষণে অর্থাৎ সাড়ে ১০টায় এম্বুলেন্সও এসে পৌঁছে যায়। প্যারোমেডিক্সরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানান যে, তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন কারণ তার মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ এবং অন্যান্য বুকের সংক্রমণের কারণে সমস্যা হতে পারে। তখন তারা আমাকেসহ আমার মাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। সব ধরণের চেকআপ এবং হাসপাতালে পৌঁছা পর্যন্ত প্যারামেডিক্সদের পারফরমেন্স তথা সবকিছুই ছিলো দুর্দান্ত।

সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে রয়েল লণ্ডন হসপিটালে পৗঁছার পর সবধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট এবং আমার মাকে দেখে কর্তব্যরত কনসালটেন্ট এবং ডাক্তাররা প্রস্রাবে সংক্রমণ পান। সংক্রমণের ফলে কিডনির কার্যকারিতা হ্রস এবং এক্স-রেতে কোভিড রোগীর মতো (তবে নিশ্চিত নয়) কিছুটা বুকের সংক্রমণও ধরা পড়েছিলো। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য তখন তাকে হাসপাতালে রেখে দেওয়া হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে তাকে একটি ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।

আব্দুল দায়াছ বলেন, আমার মায়ের বয়স ও শারীরিক কারণে বছরে অন্তত একবার হাসপাতালে যেতে হয়। তখন আমরা বার বার তাঁর খোঁজখবর নিই এবং কর্তব্যরত নার্সদের স্মরণ করিয়ে দেই যে, আমাদের মা স্ট্রোকের রোগী। তিনি পুরোপুরি বিছানাবন্দী, তিনি নিজে নিজে খেতে পারেন না এবং তার অনেক সাহায্যের প্রয়োজন হয়। আমরা তাদেরকে বলেছি যে, যদি কোনো ধরণের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তারা যেন আমাদেরকে জানায়। এবারও ভর্তির পরেরদিন আমরা ফোন করে জানতে চেয়েছি Ñ কী অবস্থা, কেমন আছেন। আমাদের জানানো হয়েছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আমরাও তাদের কথা বিশ্বাস করি। আমাদের বেশী উদ্বেগ ছিলো যে, তিনি খাওয়া-দাওয়া, ওষুধগুলো ঠিকমতো খাচ্ছেন কীনা। ১২ জানুয়ারী, দুপুর দেড়টার দিকে হঠাৎ ডাক্তার আমাকে ফোন করে জানান যে, আপনার আম্মার অবস্থা খুবই খারাপ। আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, অবস্থা খারাপ হবে কেন? তখন বলা হয়, পানীয় ও খাবার না খাওয়ার কারণে উনার ক্ষতস্থানের ঘা বেড়ে গিয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে, তিনি হয়তো আর বেশী বাঁচবেন না এবং আজই কোনকিছু ঘটে যেতে পারে। শুনে আমি চরমভাবে হতাশ ও অবাক হয়ে যাই এবং সাথে সাথে বলি আমি এখনই আসছি এবং আমার মাকে ঘরে নিয়ে আসবো। কারণ এভাবে মরার চেয়ে আমাদের হাতেই মৃত্যু তার হোক। তখন আমাকে বলা হয়, না এই পরিস্থিতিতে এভাবে হাসপাতালে আসা যাবে না। তখন আমাদের স্কাইপ এর মাধ্যমে মাকে দেখার সুযোগ দেওয়া হয়। স্কাইপে মায়ের বেগতিক অবস্থা দেখে আমরা আরো হতাশ হয়ে যাই এবং তাদের জানাই যে, আমারা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখনই আসছি। তখন আমাদের জানানো হয় যে, নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই এসে একবার দেখে যাও এবং আমাদের সময় দেওয়া বিকাল ৫টা।
বৃদ্ধার ছেলে বলেন, ৫টায় গিয়ে দেখি আমার মায়ের ঠোঁটমুখ খুবই শুকনো এবং পরিবেশ দেখে মনে হয়েছে Ñ আমি হাসপাতালে নয় যেন একটি পাগলখানায় এসেছি। মাকে আমাকে দেখেই বলেন, ‘পুত আমারে জলদি পানি দেয়’। তখন আমি সবকিছু রেখে সাথে সাথে আমার মাকে টিস্যু ভিজিয়ে আলতো করে ঠোঁট মুছে দিয়ে একটু পানি পান করাই এরপর ৫টা ৯টার ভেতরে এক প্লেট খিচুরি, এক পট ইয়োগাট, কিছু রাজবেরী এবং এক লিটারের মতো পানি ও ড্রিঙ্কস খাওয়াই। এরপরও আমার আরো পানি খেতে চেয়েছেন।
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, হাসপাতালে অনেকে আত্মীয়-স্বজন শুধুমাত্র কোভিডের কারণেই মারা যাবেন না, তাদের অনেকে ঠিকমতো পানীয় ও খাবার না খাওয়ার জন্য ডিহাইড্রেশনের কারণে মারা যেতে পারেন।

এদিকে, সুরমার পক্ষ থেকে উত্থাপিত অভিযোগটি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানতে এনএইচএস‘র সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হলে বার্টস হেলথ এনএইচএস ট্রাস্টের একজন মুখপাত্র বলেছেন: “আমরা বুঝতে পেরেছি যে হাসপাতালে বিশেষত এই মহামারী চলাকালীন সময়ে প্রিয়জনকে রাখা অবিশ্বাস্যরকম কঠিন হতে পারে। রয়্যাল ল-ন হসপিটালটি বেশিরভাগ অসুস্থ কোভিড-১৯ রোগীর যতœ নেওয়ার জন্য খুবই ব্যস্ত। তবে আমরা আমাদের কমিউনিটিকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, এখনও রোগীর সুরক্ষা আমাদের শীর্ষস্থানীয় অগ্রাধিকার হিসাবে রয়ে গেছে। আমাদের কর্মীরা সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা ও যতœ নেওয়ার জন্য কঠিন পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রমীভাবে কঠোর পরিশ্রম করছেন।”
আরো উল্লেখ করা হয় যে, আমাদের রোগীদের এবং তাদের পরিবার দ্বারা উত্থাপিত যে কোনও উদ্বেগকে আমরা খুবই গুরুত্ব সহকারে নিয়ে থাকি। তবে আমরা স্বতন্ত্র ক্ষেত্রে মন্তব্য করতে পারি না। আমাদের অভিযোগ দেখভালকারী টিম বিষয়টি সচেতন এবং অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করছে এবং আমরা সেটির জবাব সরাসরি পরিবারকে জানাবো।
করছে এবং আমরা সেটির জবাব সরাসরি পরিবারকে জানাবো।
উল্লেখ্য, রয়েল লণ্ডন হসপিটালসহ এনএইচএস‘র সেবা বিশেষ করে এই ভয়াবহ মহামারিকালে সাহসের সাথে তাদের সেবা ও যত্ন সবার প্রশংসা পাচ্ছে। তবু মাঝে মাঝে এধরণের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে এনএইচএস কর্তৃপক্ষ কাছে আরো দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করেন সচেতন জনসাধারণ।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close