নিউজ

করোনার মহা বিপর্যয়ের বছর ২০২০ ।। ২০২১ ভালো হওয়ার আশাবাদ

।। সুরমা ডেস্ক ।।
লণ্ডন, ৩ জানুয়ারী – গত ২০২০ সাল ছিলো মহা করোনা বিপর্যয়ের বছর। পুরো বছরজুড়ে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস মহামারীর তা-ব সারা পৃথিবীকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। যন্ত্রণার কারণ হয়েছে অনেক মানুষের জন্য। উৎসব, আনন্দ কেড়ে নিয়েছে পুরো বিশ্বের। ঈদ, পূজো, ক্রিসমাস এমনকি বছর শেষে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসব কিছুই করতে পারেনি বিশ্বের মানুষ। পুরো বছর চরম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় দিনগুণতে হয়েছে বিশ্ববাসীকে। বছর শেষে এসেছেও কোনো পরিবির্তন দেখা যাচ্ছে না। বরং দিন দিন হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে কিছুটা হলেও মানুষ আশার আলো দেখছে যে, হয়তো কোনো বিহীত হবে। সম্প্রতি এমনি আশার বাণী শুনিয়েছেন বিশ্বের প্রধানতম ধনী ব্যক্তি মাইক্রেসফট এর সহ প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। তিনি আগামী বছর তুলনামূলক ভালো হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

চীনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে চীনের হুবেই প্রদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ে। হুবেই প্রদেশে উহান শহরের একটি সামুদ্রিক খাবার ও পশুপাখির বাজারের সাথে প্রথম সংক্রমণগুলোর সম্পর্ক আছে। কিন্তু চীনা গবেষকদের এক জরিপ, যা ল্যানসেট চিকিৎসা সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় এ বছরের গোড়ার দিকে, তাতে বলা হয় করোনাভাইরাসের উপসর্গ দেশটিতে প্রথম পাওয়া যায় ২০১৯-এর ডিসেম্বরের প্রথম দিকে।
নতুন এই রোগটিকে প্রথমদিকে বিভিন্ন নামে ব্যাখ্যা করা হলেও ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটির আনুষ্ঠানিক নাম দেয় ‘করোনা ভাইরাস ডিজিজ ২০১৯’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ, কোভিড-১৯।
প্রথম দিকে নতুন এই রোগটিকে বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছিল, যেমন: ‘চায়না ভাইরাস’, ‘করোনাভাইরাস’, ‘২০১৯ এনকভ’, ‘নতুন ভাইরাস’ ও ‘রহস্য ভাইরাস’ ইত্যাদি। পরে ২০২০ সালের ১১ মার্চ কোভিড-১৯ প্রার্দুভাবকে বিশ্ব মহামারী ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুস আক্রমণকারী এই ভাইরাস পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কেড়ে নিয়েছে অনেক মানুষের জীবন। অনেক মানুষ শিকার হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক জটিলতার।
২১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত জন্স হপকিন্সের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীব্যাপী এই ভাইরাসে সংক্রমিতের সংখ্যা সাত কোটি ৬৮ লাখ আর মৃতের সংখ্যা ১৭ লাখ।
এ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে লকডাউন ও বিধিনিষেধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছে পৃথিবীর কয়েক কোটি মানুষ। বলা হচ্ছে, ১৯৩০ দশকে যে বিশ্ব মহামন্দা পরিস্থিতি (যা গ্রেট ডিপ্রেশন নামে পরিচিত) তৈরি হয়েছিল, তার পর এই প্রথম করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে আবার বড় রকমের ধ্স নেমেছে। অনেকের ধারণা, মহামারি হয়তো নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে, কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির যে মারাত্মক ক্ষতি এর মধ্যে হয়ে গেছে, তা কাটাতে লেগে যাবে অনেক বছর।
এই রোগের উৎস কোথায়, কখন চীন প্রথম এই রোগ সম্পর্কে জেনেছিল, এই রোগের বিস্তার ঠেকাতে কতটা সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, এই ভাইরাস মানুষের তৈরি নাকি গবেষণাগার থেকে দুর্ঘটনাক্রমে বাইরে চলে এসেছে, এসব নিয়ে সারা বছর ধরে চলেছে নানা জল্পনা, তথ্যানুসন্ধানের প্রক্রিয়া। এসব প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে নানা বিতর্কের।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স¤প্রতি জানিয়েছে করোনার উৎস খুঁজে বের করতে ১০ জন বিজ্ঞানীর একটি আন্তর্জাতিক দল আগামী মাসে (জানুয়ারিতে) চীনের উহান শহর সফর করবেন।
তদন্তকারী দলের একজন জীববিজ্ঞানী সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেকে জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কারো উপর দোষ চাপানোর উদ্দেশে এই তদন্ত পরিচালনা করছে না, বরং ভবিষ্যত সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করাই তাদের অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য।
বিজ্ঞানীরা বলেছেন, চীনের উহানে গত বছরের ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের আবির্ভাবের পর এ পর্যন্ত এটি অন্তত ১৭ বার মিউটেশনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করেছে। স¤প্রতি ভাইরাসটির নতুন এবং আরো বেশি সংক্রামক আরেকটি জাত আত্মপ্রকাশ করার পর নতুন করে দেশে দেশে উদ্বেগ ছড়িয়েছে।

বিল গেটসের পর্যালোচনা, নতুন বছরটি আগের চেয়ে ভালো হবে:
প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনীও তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিল অ্যাণ্ড মেলিণ্ড গেটস ফাউণ্ডেশন বিশ্বজুড়ে যত দাতব্য কাজ করছে, তার অন্যতম লক্ষ্য মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। করোনা মহামারি, এর টিকা উদ্ভাবন ও বিতরণ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি করোনাপরবর্তী বিশ্ব নিয়ে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন বিল গেটস। সম্প্রতি লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিজের ব্লগ গেটস নোটসে।
বিল গেটস লিখেছেন— এটি একটি বিধ্বংসী বছর। কোভিড-১৯ মহামারিতে ১৬ লাখের বেশি মানুষ এরই মধ্যে মারা গেছেন। সেই সঙ্গে সাড়ে ৭ কোটির বেশী মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এবং অর্থনৈতিক খাতে ১০ ট্রিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ১০০ কোটির বেশী শিশু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে স্কুলে যেতে পারেনি। এ বছর যুক্তরাষ্ট্র জর্জ ফ্লয়েড ও ব্রেওনা টেলরের হত্যা দেখেছে, দেখেছে বিধ্বংসী দাবানল এবং এমন একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যা আধুনিক সময়ে আর দেখা যায়নি।
তবে ২০২১ সালে আমাদের জন্য ভালো খবর আছে। চলতি বছরের বেশীরভাগ সময়টা আমি ফাউণ্ডেশনের সহকর্মীদের সঙ্গে কাটিয়েছি এবং এর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ, চিকিৎসা এবং এর শনাক্তকরণ পরীক্ষা চালানোর পথ খোঁজা। ২০২০ সালের বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রার গতি নিয়ে আমি যখন ভাবি, তখন স্তম্ভিত হয়ে যাই। এ বছর কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বে যে পরিমাণ বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি হয়েছে, অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে এক বছরে মানুষ এতটা এগোতে পারেনি। সাধারণ সময়ে, একটি টিকা তৈরি করতে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এবার এক বছরের কম সময়ে একাধিক টিকা তৈরি করা হয়ে গেছে।
দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এখনো প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে বের হতে পারিনি। কম্পিউটাওে তৈরি মডেলে দেখা গেছে, সামনের মাসগুলোতে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের নতুন ধরণ (স্ট্রেইন) আবির্ভূত হয়েছে এবং সে বিষয়েও আমাদের জানতে হবে। করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরণ আরও দ্রুত ছড়াচ্ছে, যদিও এটি ততটা প্রাণঘাতী নয় বলে মনে হচ্ছে।
তবু আশাবাদী হওয়ার জন্য দুটি কারণ হাজির আছে। একটি হলো মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মধ্য দিয়ে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার গতি কমিয়ে দেওয়া এবং এর মাধ্যমে টিকা সর্বত্র পৌঁছানোর আগপর্যন্ত জীবন বাঁচানো।
টিকা তৈরিতে সাধারণত প্রায় ১০ বছর লাগলেও এবার এক বছরেই একাধিক টিকা পাওয়া গেছে।
আশাবাদী হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, ২০২১ সালের বসন্তে করোনার টিকা ও চিকিৎসা সম্পর্কিত যেসব খবর আপনারা এখন সংবাদমাধ্যমে পড়ছেন, সেগুলো এমন পর্যায়ে পৌঁছাবে যে এর বৈশ্বিক প্রভাব জোরদার হতে থাকবে। যদিও তখনো কিছু বিধিনিষেধ মেনে চলার প্রয়োজন হবে (উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বড় জনসমাগমের কথা), তবে অন্তত ধনী দেশগুলোতে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কমে আসতে থাকবে এবং এখনকার তুলনায় জীবন অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
আজ থেকে এক বছর পর, আমি মনে করি, আমরা পেছনে ফিরে তাকিয়ে বলতে পারব যে ২০২১ সাল ছিল ২০২০ এর তুলনায় উন্নতির সময়। হয়তো ব্যাপক উন্নতি হবে না, কিন্তু বিশ্বের মানুষের জন্য এটি হবে লক্ষণীয় ও পরিমাপযোগ্য পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া। ২০২১ সাল জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর হবে।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close