মুক্তচিন্তা

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার আরো একটি ধোঁকাপূর্ণ নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের বধির নীরবতা

।। মো. ইউসুফ হোসেন ।।
লেখক: গুমের শিকার হয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা একজন মানবাধিকার কর্মী।

লণ্ডনে বসবাসকারী একজন বাংলাদেশী হিসাবে আমি আমার জন্মভূমির গণতান্ত্রিক কাঠামোকে কলঙ্কিত করে এমন ধোঁকাপূর্ণ নির্বাচনী প্রহসনের পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে আমার আওয়াজ তুলতে বাধ্য হয়েছি। বাংলাদেশের কুখ্যাত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে বলপূর্বক গুমের শিকার হয়ে আমি শেখ হাসিনার শাসনামলে সাজানো বিভীষিকাময় বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছি। একটি সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০০৮ সালে তার ক্ষমতায় আরোহণ গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার একটি নতুন যুগ চিহ্নিত করার কথা ছিল। কিন্তু জনগণের কাছে ইতিপূর্বেই জাতীয় বেইমান হিসেবে চিহ্নিত শেখ হাসিনার দেয়া গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি স্বল্পস্থায়ী ছিল কারণ ক্ষমতায় এসেই তিনি ধীরে ধীরে এটিকে সমুন্নত রাখার জন্য দেশের বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভেঙে দিয়েছিলেন।

২০০৯ সাল থেকে পরবর্তী বছরগুলিতে হাসিনার শাসন একটি শ্বাসরুদ্ধকর স্বৈরাচারে রূপান্তরিত হয় যা তার পৃষ্ঠপোষক ভারতের সহায়তায় একটি গণতান্ত্রিক মুখোশের আড়ালে কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তার স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা পদ্ধতিগতভাবে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ গুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে, নাগরিকদের অধিকারকে পদদলিত করেছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের সুষ্ঠু ও ভারসামৗপূর্ণ আচরণের যে কোনো চিহ্নকে বিলুপ্ত করেছে। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দুটি ভয়ঙ্করভাবে কারচুপির নির্বাচনে জাতি শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদেও দ্বারা গণতান্ত্রিক নীতির সাথে একটি গুরুতর বিশ্বাসঘাতকতার সাক্ষী হয়েছিল।
২০১৪ সালের নির্বাচনটি গণতন্ত্রের একটি কঠোর পরিহাস ছিল। হাসিনার কারচুপির কৌশল নিশ্চিত করেছিল যাতে তার দলের ১৫৩ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে পারে। উল্লেখ্য বাংলাদেশের সংসদে সরকার গঠন করতে মাত্র ১৫১ জন সংসদ সদস্য লাগে। প্রধান বিরোধী দলগুলি তত্বাবধায়ক সরকার বিহীন হাসিনার জোরপূর্বক ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার প্রক্রিয়াটির প্রহসনমূলক প্রকৃতির পূর্বাভাস পেয়ে নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি তার নিছক অবহেলা এবং ক্ষমতার উপর তার অবৈধ দখলদারীত্ব তাকে বিরোধীদের কণ্ঠস্বরকে নস্যাৎ করতে সাহসী করে তোলে, পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে নির্লজ্জ কারচুপি এবং নির্বাচনী প্রকৌশলের মাধ্যমে তার শাসনকে সুসংহত করে।

২০১৮ সালে তিনি নির্বাচনের আগের রাতে দলবাজ অনুগত প্রশাসনের সাহায্যে পূর্বেই সিলমারা ব্যালট দিয়ে ব্যালট বাক্সে ঠাসা করে নতুন নিম্নমুখীএক নির্বচনী দূর্ণীতির সূচনা করেছিলেন। এই নির্লজ্জ ও দুঃসাহসী কাজটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মৌলিক নীতিকে সম্পূণর্রূপে উপেক্ষা করে ক্ষমতার জন্য তার নির্লজ্ব প্রচেষ্টার প্রমাণ ছিল। তার অধীনে নির্বাচনী জালিয়াতির মাত্রা তাকে দুনিয়াব্যাপী কারচুপির মাস্টার হিসাবে চিহ্নিত করেছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যে বিশ্বাসযোগ্যতার কোনো চিহ্নকে ভেঙে দিয়েছে।
যখনই গণতান্ত্রিক বিশ্ব তাকে জনগলের দাবী অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সর্বদলীয় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য অনুরোধ করে, তখনই তিনি সংবিধানের দোহাই দিয়ে কৌশলীভাবে এই আহ্বানগুলি এড়িয়ে যান। কিন্তু একথঅটি কখনোই বলেন না যে তার নিজের সরকারই সংবিধানকে বিকৃত করেছিল, তার সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার নির্মম শক্তির মাধ্যমে ইতিপূর্ব থেকেই সংবিধানে চলে আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে মুছে ফেলেছিল। অথচ একসময় তিনি নিজেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার জন্য দেশব্যাপী জ্বালাও পোড়াও আন্দোলন করেছিলেন, এমনকি ১৭৩ হরতালও পালন করেছিলেন। তার সুবিধাজনক অতীত ভুলে যাওয়া যে ক্ষমতায় তার স্বৈরাচারী দখলকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্যই— সেকথা বিদেশীরা বুঝতে না পারলেও বাংলাদেশের জনগণের কাছে তা অত্যন্ত পরিষ্কার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানকে যে সিস্টেমটি সংবিধানে ছিল তা ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রে হাসিনা তার কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে উপেক্ষা করেই সারাক্ষণ সংবিধানের আক্ষরিকতার দোহাই দিচ্ছে।

হাসিনার অত্যাচারের মুখে গনতন্ত্রকামী বাংলাদেশীদেও প্রতি পশ্চিমাদের বধির নীরবতা বিস্ময়কর এবং হতাশাজনক। বাংলাদেশে জালিয়াতিপূর্ণ নির্বাচনের চিরস্থায়ী চক্রকে প্রতিহত করার সংগ্রামে লিপ্ত গলতান্ত্রিক শক্তি শেখ হাসিনার অবিরাম মানবাধিকার লংঘন ও দূঃশাসনের মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের কাছ থেকে আরও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দাবি করে। শেখ হাসিনা দ্বারা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং মানবাধিকার পদদলিত হওয়ার দিকে অন্ধ দৃষ্টি না রাখা গণতান্ত্রিক দেশগুলির জন্য একটি বাধ্যতামূলক নৈতিক কর্তব্য ।

বাংলাদেশের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই জানুয়ারির ৭ তারিখে দ্বাদশ জাতীয় নিবার্চনের তারিখ ঘোষণা করেছে। আরেকটি প্রহসনমূলক নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনার প্রস্তুুুতি পশ্চিমাদের নিষ্পত্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জরুরি প্রয়োজনের ওপর জোর দেয়। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতদের মানহানিমূলক অব্যাহত হুমকি প্রদান এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নির্লজ্জভাবে নষ্ট করে এমন শাসনের উপর বাস্তব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সময় এসেছে। একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হাসিনার সরকারকে চাপ দিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি তার অঙ্গীকারে বিশ্ব স¤প্রদায়কে দৃঢভাবে বাংলাদেশিদেও পাশে দাঁড়াতে হবে।

শেখ হাসিনা বিগত দেড় দশক ধরে যে ধোঁকাপূর্ণ নির্বাচন ব্যবস্থা সাজিয়েছেন তার চেয়েও ভালো কিছু বাংলাদেশের জনগণের প্রাপ্য। অনেক দেরি হওয়ার আগেই কথা বলা, অবস্থান নেওয়া এবং গণতন্ত্রের উপর অত্যাচারীর নিরলস আক্রমণ থামানো গণতান্ত্রিক বিশ্বের দায়িত্ব। একটি জাতির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের ভাগ্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন আংগের ভারসাম্যের মধ্যে ঝুলে থাকে, যা বর্তমান বাংলাদেশে একেবারেই অনুপস্থিত। বিশ্ব সত্যিকারের গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের জন্য আকাঙি্ক্ষত বাংলাদেশের জনগণের কান্নার প্রতি উদাসীন থাকতে পারে না। তাদেরকে মুক্তি দেয়ার জন্য গণতান্ত্রিক বিশ্বকে অবশ্যই ব্যবস্থঅ নিতে হবে এবং তা দেরী হয়ে যাবার আগেই।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close