মুক্তচিন্তা

জিয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের অন্তরালে

।। ডক্টর এম মুজিবুর রহমান ।।

লেখক: সংবাদ বিশ্লেষক। সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

এক:
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মিথ্যাচার মানসিক বিকৃতির পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে অনেকের মত । তবে এটাকে শুধু বিকৃতির পর্যায়ে সীমাবদ্ধ গন্ডিতে রেখে চিন্তা করলে পর্যালোচনা পূর্নতা পাবে না। স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষ করে ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সময়ের নানা ঘটনার দিকে তাকালে এর উত্তর পাওয়া দুস্কর নয়। সম্প্রতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কিছু মন্তব্যও বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচারিত হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। আর তা হলো স্বাধীনতার জন্য মার্চের ২৫-২৬ তারিখে একটা ঘোষণা দেয়ার দরকার ছিল এবং সেটা সেনাবাহিনীর কাউকে দিয়ে। তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান সেটা দিয়েছেন । তাহলে ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার যে ঘোষণা বলা হচ্ছে তা এনাফ ছিল না, সেটা তিনি নিজেই স্বীকার করলেন। এর পরের কথা হলো ২৫-২৬ তারিখ এই দুইদিন গুলি করে কাদের হত্যা করা হয়েছে, সেই মানুষগুলোর নাম ঠিকানা এতোদিনেও পাওয়া গেল না কেন ?

এখন প্রশ্ন হলো ২৫-২৬ তারিখ এই দুইদিন রাস্তায় যারা ব্যারিকেড দিয়েছিলো তাদের গুলি করে মারলেন যে জিয়া সেই জিয়াকে আওয়ামী লীগ নেতারা স্বাধীনতার ঘোষণা পড়ার জন্য আনতে গেলেন কেন? আর কি কাউকে খোঁজে পাওয়া গেলো না? মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু শুরুই হয়ে গিয়েছিল তাহলে আওয়ামী লীগের নেতারা জিয়ার সাথে সখ্যতা করতে গেলেন কেন? এছাড়া এই দুই দিন জিয়াকে ধরে তারা কোথায় রাখছিলেন তাও জানা দরকার।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে মানুষটি ২৫-২৬ তারিখে গুলি করে বাঙালি মারলেন তাকে দিয়েই সাতাশ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়াতে হলো কেন? আর যাকে ধরে এনে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়াতে হলো তিনি কিভাবে নিজের নামে এমনকি নিজেকে কমান্ডার ইন চিফ এবং হেড অব স্টেট বলে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা দেয়ার সুযোগ পেলেন? আওয়ামী লীগের ঐ নেতারা তাদের কথিত বন্দিকে রেখে কোথায় ছিলেন নাকি কিছু সেবন করতে গিয়েছিলেন তা পরিষ্কার করা উচিত? শেষ কথা হলো, ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর আওয়ামী লীগ নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন বলেন নাই যে, জিয়া ২৫-২৬ তারিখে বাঙালিদের উপর গুলি চালিয়েছিলেন? কেন এমন মানুষটারে শেখ মুজিব উপ সেনা প্রধান বানাইলেন? কেন সেই সময়ের সরকার সম্মুখ সমরে সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ জিয়াকে বীর উত্তম খেতাব দিলো? সর্বোপরি যুদ্ধের শেষ ভাগে সিলেট অঞ্চলে জিয়ার জেড ফোর্স বাহিনীর কাছে কারা আত্মসমর্পণ করেছিল সেটাও জানা দরকার ।

এতসব ভুলের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো উচিত নয় কি?  আর যদি এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া না যায় তাহলে প্রধানমন্ত্রী প্রকারান্তরে উনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকেও অপমানিত করছেন বলে অনেকে মনে করেন। এক্ষেত্রে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট লংঘিত হয়েছে তা কি বলা যায় না? তবে আওয়ামী লীগ সব কিছুতে মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের একক কৃতিত্ব দিতে চাইলেও উনার রেখে যাওয়া আদর্শ বাকশাল বাদ দিয়ে স্বজ্ঞানে দরখাস্ত করে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম কেন দিলেন তা এক বিরাট প্রশ্ন?

দুই:
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৭ সালের ১০ মার্চ এ নিয়ে কি বলেছিলেন তা দেখে নেয়া যাক । ঢাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ : রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো পরিবর্তনের দিকদর্শন’ শীর্ষক ঐ আলোচনা সভায় তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনা দেননি বরং কারা সেদিন (৭ মার্চ) শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষনা দিতে পিড়াপিড়ী করছিলেন তাদের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য পরদিন ১১ মার্চ বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কিছু অংশ …“একাত্তরের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের দিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে দলের ভেতর থেকে ‘কারা, কী উদ্দেশ্যে’ চাপ দিচ্ছিল, তা খুঁজে দেখার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে আন্তÍর্জাতিকভাবে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারত এমন ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তাহলে, তারা (যারা চাপ দিচ্ছিল) কার হয়ে কথা বলছিল? উদ্দেশ্যটা কী ছিল?’ .. শেখ হাসিনা বলেন, ‘আক্রমণকারী কারা হবে? যারা আক্রমণকারী হবে, আন্তর্জাতিকভাবে তারাই হবে অপরাধী। আর কোনোমতেই বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়া যাবে না। তা হলে কখনো কোনো উদ্দেশ্য সফল হয় না। ’

‘’সেমিনারে সাড়ে চার দশক আগের সেই স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে শেখ হাসিনা, সেদিন তাঁর বাবার গাড়িবহরের সঙ্গেই তৎ্কালীন রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। জনসভা শেষে তাঁদের গাড়ি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে ফুলার রোড দিয়ে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ফেরে। পথে রেসকোর্স ময়দান থেকে বাঁশের লাঠি হাতে শ্লোগানমুখর স্বতঃস্ফূর্ত জনতাকে ফিরতে দেখার কথা সেমিনারে তুলে ধরেন তিনি।”

‘’বাড়ি ফিরে শেখ হাসিনা যা দেখেছিলেন; সেই ঘটনা তিনি তুলে ধরেন তাঁর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘আমি যখন ঘরের মধ্যে ঢুকলাম, ঠিক সেই সময় দেখি, আমাদের কয়েকজন ছাত্রনেতাসহ বেশ কিছু … তারা হঠাৎ দেখি বেশ উত্তেজিত। আমার আব্বাকে বলছেন, ‘এটা কী হলো লিডার? আপনি স্বাধীনতার ঘোষণাটা দিয়ে আসলেন না। মানুষ সব হতাশ হয়ে ফিরে গেল।”

‘’শেখ হাসিনা বলেন, ‘ঠিক এই কথাটা যখন বলছে, তখনই আমি ভেতরে ঢুকেছি। ঢুকে সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, আপনারা মিথ্যা কথা বলছেন কেন? আমি একটু টাশ টাশ মুখের ওপর কথা বলে দেই; এটা আমার অভ্যাস। আমি বললাম, আপনারা এই রকম মিথ্যা কথা বলেন কেন? মানুষ কোথায় হতাশ হয়ে গেছে? তাহলে আপনারা মানুষ দেখেন নাই। আমি কিন্তু মানুষ দেখতে দেখতে আসলাম। মানুষের ভেতরে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা আমি দেখলাম, তাতে আমি তো কারো মুখে কোনো হতাশা দেখলাম না। আপনারা কেন আব্বাকে এ রকম মিথ্যা কথা বলেন। আব্বাকে এ রকম মিথ্যা কথা বলবেন না। ”

শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন যাদের তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে চাপাচাপি করতে দেখেছিলেন, তাদের কথায় কান না দিতে বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। তিনি বলেন, ‘আমি আব্বাকে সোজা বললাম, আব্বা আপনি ওদের কথা বিশ্বাস করবেন না। কারণ সবাই মিথ্যা কথা বলছে।” (কালের কণ্ঠ ১১ মার্চ ২০১৭)।

প্রধানমন্ত্রীর আগের বক্তব্যের সাথে এ বছর ৭ মার্চের উপলব্দি ভিন্ন বলে মনে হলো । তবে বাড়তি হিসেবে যোগ হয়েছে ২৫-২৬ তারিখে ৭ মার্চের ভূতাপেক্ষ (রেট্রোস্পেক্টিভ) ডাকে সাড়া দিয়ে যারা রাস্তা অবরোধ করতে গিয়েছিলেন তাদেরকে নাকি গুলি করেন জিয়া। তাই স্বভাবত প্রশ্ন জাগে আগামী বছর অন্য কিছু নাকি ষোলকলা পূর্ণ হতে চলেছে ।

তিন:
ওয়ান ইলেভেন’র সেনাবাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ ভারত সফরে যান। ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির সাথে একটি বৈঠক হয়েছিল মইন ইউ আহমেদের। ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ারস’ বইয়ে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ওই বৈঠকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সেনাপ্রধান তাঁর কাছে চাকরির নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন। মইন ইউ আহমদের চাকরীর দায়িত্ব ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। প্রণব মুখার্জি যিনি পরবর্তীতে ভারতের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে আশ্বস্ত করেন যে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে তাঁর কোন সমস্যা হবে না। শুধু কি তাই?  ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং’র প্রকাশ্য ভূমিকা স্মরণে রাখলে অনেক কিছুর উত্তর হয়তো মিলতেও পারে।  বিবিসি খ্যাত বিশিষ্ট সাংবাদিক সিরাজুর রহমান এবং তাঁর সহকর্মী জন রেনারের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুটি সাক্ষাৎকারের কথা যা সিরাজুর রাহমানের ‘ইতিহাস কথা কয়’ বইয়ের ১৪২ পৃষ্ঠায় বর্ণিত রয়েছে তা পাঠকরা পড়ে নিতে পারেন।

৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের চুক্তিতে কি ছিল তা শেষ পর্যন্ত জানা গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে সম্পাদিত চুক্তিতে কি রয়েছে তা কি দেশের মানুষ জানেন? চীন-ভারতের সাম্প্রতিক প্রতিযোগিতা, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড, বিশাল বিনিয়োগ, পাকিস্তান-চীন হাইওয়ের নিরাপত্তা, দক্ষিণ চীন সাগর  ও ভারতের লাদাখ, চিকেন নেকসহ অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশলী স্থানসমূহে আধিপত্য ধরে রাখার উপর দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির গতি প্রকৃতি অনেকটা নির্ভর করবে তাতে সন্দেহ নেই । প্রশ্ন হলো স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুন্ন রেখে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পথ চলা নাকি অন্য কারোর হয়ে টিকে থাকা? সময়ের পরিক্রমায় রাজনৈতিক দলসমূহ এবং দেশপ্রেমিক সিপাহী জনতার মানসিকতা ও সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে কোন পথে এগোবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মাধ্যমে পরিচালনার ব্যাপারে সন্দেহ ও ধোঁয়াশা সৃষ্টি করতে পারলেই অন্য একটি দেশের সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়ক হয় বলে অনেকের ধারণা। ভারতের অনেক রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যে অখণ্ড ভারতের স্বপ্নের কথা প্রায়ই শোনা যায়। এছাড়া বাংলাদেশের জনযুদ্ধ তথা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনা থেকে শুরু করে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বলেও ওপারে একটা জোরালো প্রচারনা রয়েছে বেশ কিছু দিন ধরে । এ ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমানের ‘উই রিভোল্ট’ বলে আনুষ্ঠানিক মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘোষণা এবং তাঁর রাজনীতি ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদের দর্শন অন্যতম বাঁধা । 
লন্ডন, ১০ মার্চ ২০২১ ।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close