নিউজ

এস আলম থেকে জয়ের বখরা ১৫শ’ কোটি

  • আদালতে পিকে’র স্বীকারোক্তি-
  • ১৩ হাজার কোটি বাগাতে লীগকে ঘুষ আরো ১৫শ’ কোটি
  • দুই বছর ধরে গোপন অবস্থানে জয় – জেল কমপ্লেক্সে লাঞ্ছিত পিকে
    ।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
    লণ্ডন, ১৫ সেপ্টেম্বর: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় আবারও সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার আইটি উপদেষ্টা দেড় হাজার কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী ভারতের বহুল প্রচারিত অনলাইন পোর্টাল ‘নর্থইস্ট নিউজ’ এ একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন।

সেই প্রতিবেদন অনুসারে বিনা শুল্কে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানী নিশ্চিত করার বিপরীতে এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে সজীব ওয়াজেদ জয় ১৫০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। শুধু তাই না, সর্বশেষ দু‘টি নির্বাচনে এস আলম আওয়ামী লীগকে আরও ১৫০০ কোটি টাকা দিয়েছিলেন (পত্রিকার ভাষায় কিকব্যাক অর্থাৎ গৃহীত সুবিধা ফেরৎপ্রদান)। এছাড়া জালিয়াতি করে এস আলম তাঁর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দাম ১.৫-১.৬ বিলিয়ন ডলার থেকে জমির মূল্য অনেক বেশি দেখিয়ে প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছেন। এভাবে মোঃ সাইফুল আলম ওরফে এস আলম তাঁর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ও স্ফীত করেছেন। এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামিক ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে তিনি তাঁর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অর্থায়ন করেছেন।
মূলত: এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বর্তমানে আর্থিক জালিয়াতিতে দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারের ভারতীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টোরেট’র কাছে দেয়া একটি জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করে তিনি এই প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন। প্রতিবেদনটিতে জয়ের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস হওয়া ছাড়াও দুর্নীতি দমন কমিশন, ডিজিএফআই, আইজিপি এবং আইন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদে কাকে নিয়োগ দেওয়া হবে তাতেও ব্যবসায়ী এস আলমের প্রভাব খাটানোর সকল তথ্য উঠে এসেছে। ভারতের ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্টকে (ইডি) দেওয়া জবাবনবন্দিতে পিকে হালদার এসকল তথ্য দিয়েছেন।
‘Tk 1,500 cr kickback to Sheikh Hasina’s son in 2014, B’desh banker told ED in May 2022’ শিরোনামে লেখা প্রতিবেদনটিতে চন্দন নন্দী লিখেছেন- ভারতের ডিরেক্টরেট অব এনফোর্সমেন্টের (ইডি) সদস্যদের হাতে পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর থেকে গ্রেফতারের এক সপ্তাহের মধ্যেই বাংলাদেশের একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা (এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক বর্তমান গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার) জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের জানান যে, ২০১৪ সালে ১,৫০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। ইডির এ সংক্রান্ত তথ্যের নথি নর্থইস্ট নিউজের কাছে পৌঁছেছে।

ইডির তথ্য ঘেঁটে জানা গেছে, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাইফুল আলমকে ব্যবসার বিভিন্ন কাজ পাইয়ে দেবার বিনিময়ে তার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের আত্মীয়-স্বজন এবং সহযোগিরা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা পরিচালনা করা সাইফুল আলমের সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব রয়েছে। তিনি রিলায়্যান্স ফাইন্যান্স লিমিটেড এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক লিমিটেড এর চেয়ারম্যান। পিকে হালদার ২০০৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত রিলায়্যান্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন।

ইডিকে দেওয়া জবানবন্দিতে পিকে হালদার বলেন, “২০১৪ সালে বাংলাদেশে ১,৩০০ মেগাওয়াট পাওয়ার প্ল্যান্ট বানাতে আর্থিক এবং কারিগরি সংক্রান্ত বিষয়ে চায়নিজ একটি গ্রুপের সঙ্গে সমঝোতা করতে আমাকে দায়িত্ব দেন সাইফুল আলম।” তিনি বলেন, “পাওয়ার প্ল্যান্ট বানানোর জন্য প্রাথমিকভাবে খরচ ধরা হয়েছিলো ১.৫-১.৬ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু প্রতারণামূলকভাবে জমির চড়া দাম দেখিয়ে ও নির্মাণব্যয় বাড়িয়ে সেই খরচ দেখানো হয় প্রায় ২.৫ বিলিয়ন ডলার। অতিরিক্ত মূল্যায়নের আর্থিক মূল্য ওই সময়ের হিসেবে ছিলো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এই পাওয়ার প্ল্যান্টের খরচের টাকা নেওয়া হয় সাইফুল আলমের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রণে থাকা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ থেকে।”

ইডিকে পিকে হালদার বলেন, “পাওয়ার প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতি আমদানিতে যে রাজস্ব ট্যাক্স দেবার কথা তা দিতে হয়নি সাইফুল আলমকে। আর এতে সাইফুল আলমের কোম্পানিকে প্রায় ৩,০০০ কোটি টাকা ট্যাক্স দিতে হয়নি। বাংলাদেশের সরকারই তাকে এ সুযোগ তৈরি করে দেয়। আর এ জন্য সজীব ওয়াজেদ জয়কে ১,৫০০ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে সাইফুল আলমকে।”

গত ২ বছর ধরে বাংলাদেশে জনসম্মুখে দেখা যায়নি সজীব ওয়াজেদ জয়কে। ধারণা করা হচ্ছে তিনি বিদেশে নিজের অবস্থান গোপন রেখে বসবাস করছেন। এই ২ বছরে মাঝে মাঝে তাকে ওমান এবং যুক্তরাষ্ট্রে দেখা গেছে।

ইডির নথিপত্রগুলো স্বাধীনভাবে যাচাইয়ের সুযোগ পায়নি নর্থইস্ট নিউজ। তবে ইডির পাবলিক প্রসিকিউটর অরজিত চক্রবর্তী ২০২২ সালের জুলাই মাসে বলেন, পিকে হালদার জিজ্ঞাসাবাদের সময় বাঘা বাঘা ব্যক্তিদের নাম বলে দিয়েছেন। সরাসরি কারো নাম না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা জানিয়েছেন বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা টাকা আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত। এরপর থেকে আদালতের নিয়মিত মামলার কার্যক্রম ছাড়া ইডির এই মামলাটির কার্যক্রম আর এগোয়নি। ২০২২ সালের ১৪ মে ৫ সহযোগীসহ অশোকনগর থেকে পিকে হালদাকে গ্রেফতার করে ইডির সদস্যরা। ইডির মামলার নথি অনুসারে জানা যায়, পিকে হালদারের ১১টি বাড়ির বিষয়ে অভিযান চালানোর সময়ে এই ছয় জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো। তাদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়।

ইডির ১৫ মে’র একটি নথি থেকে জানা গেছে, পিকে হালদার এবং তার সহযোগিরা প্রতারণার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড এবং আধার কার্ড বাগিয়ে নিয়েছে। এমনকি এসব ভূয়া পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তারা ভারতে বিভিন্ন কোম্পানি খুল বসে এবং পশ্চিমবঙ্গে সম্পত্তি ক্রয় করে। গত বছর ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত করার অনুরোধের পর গভীর তদন্তে নামে ইডি। তদন্তে ব্যাপক দুর্নীতি আর ঘুষ নেবার চিত্র উঠে আসে। এ অনুসন্ধানে বাংলাদেশে ১০,০০০ কোটি টাকার ব্যাংক জালিয়াতি আর বিদেশে টাকা পাচারের বিষয়টি জানা যায়। বাংলাদেশ এবং ভারতের ভূয়া পাসপোর্ট ছাড়াও পিকে হালদারের কাছে গ্রেনাডার পাসপোর্টও পাওয়া যায়। এসময় পিকে হালদারের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড কর্ণার নোটিশের বিষয়েও জানতে পারে ইডি। পিকে হালদার ইডিকে বলেন, “ছয়টি ব্যাংক, একটি নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ২ টি সাধারণ বীমা কোম্পানি এবং ২ টি জীবন বীমা কোম্পানির ওপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সাইফুল আলমের। নিজের ৩ টি কোম্পানিকে ব্যবহার করে সাইফুল আলমের মালিকানায় রয়েছে ২ টি বাণিজ্যিক ব্যাংক। এছাড়া ঢাকা এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তার সদস্যপদ রয়েছে।”

পিকে হালদার বলেন, “ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং সোশাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের মোট ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশ ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকে সাইফুল আলমের কোম্পানি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো। একই সময়ে এই চার ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ ঋণ দেওয়া হয় অন্য ব্যাংকের পরিচালকদেরকে। এর মধ্যে রয়েছেন আইএফআইসি ব্যাংকের মালিক এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।” সরকারি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে সাইফুল আলম এবং তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো ২০,০০০ কোটি টাকারও বেশী ঋণ নিয়েছে বলে জানান পিকে হালদার।

ইডিকে দেওয়া জবানবন্দিতে পিকে হালদার বলেন, “সাইফুল আলম তার অঢেল টাকার সুবাধে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দপ্তর এবং প্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। বাংলাদেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান–দুর্নীতি দমন কমিশন, ডিজিএফআই, আইজিপি এবং আইন মন্ত্রণালয়–এগুলোর শীর্ষ পদে কাদের নিয়োগ দেওয়া হবে তাতে প্রভাব খাটান তিনি।”

আওয়ামী লীগ এবং হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দেবার বিষয়টি ইডির নথিতে জানা গেছে। পিকে হালদার বলেন, “২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন সাইফুল আলম। অনুদানের টাকার মধ্যে সাইফুল আলমের ২ টি কোম্পানি থেকে ১০০ কোটি টাকার অনুদান আমি নিজে ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

জয়কে ঘুষ ও আওয়ামী লীগকে অনুদান এবং সরকারি দপ্তরে এস আলমের প্রভাবের কথা প্রকাশ করায় কলকাতা জেল কমপ্লেক্সে লাঞ্ছিত পিকে হালদার
গত ৯ সেপ্টেম্বর চন্দন নন্দী ‘নর্থইস্ট নিউজ’ এ আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। সেখানে তিনি জয়কে ঘুষ ও আওয়ামী লীগকে অনুদান এবং সরকারি দপ্তরে এস আলমের প্রভাবের কথা প্রকাশ করায় কলকাতা জেল কমপ্লেক্সে সাবেক ব্যাংকার প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।

ইডি’র কাছে দেয়া পিকে হালদারের জবানবন্দীর কপিটি সুরমা’র কাছে পৌচেছে। কলকাতার নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, কলকাতা স্পেশাল সিবিআই কোর্ট নম্বর-০১ ‘এর বিচারক মানি লন্ডারিং কেস নম্বর-১২/২০২২ সূত্রে ২৮ এপ্রিল ২০২৩ পিকে’র এই জবানবন্দী গ্রহণ করেছেন। তবে ইডি বা জবানবন্দী গ্রহণকারী কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে এর সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। কাজেই ‘নর্থইস্ট নিউজ’ এ প্রকাশিত ভারতীয় সাংবাদিক চন্দন নন্দী’র অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে জনগুরুত্ব বিবেচনায় এটি প্রকাশ করা হলো।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close