মুক্তচিন্তা

বিদ্যুৎ বিল বাড়িয়ে নয়, মূল সমস্যা চিহ্নিত করে স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজুন

।। মুহাম্মাদ শরীফুজ্জামান।।

রয়টার্স চলমান বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে সরকারি নথি বিশ্লেষণ করে গত বুধবার (৭ জুন) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৩ সালের পর থেকে সবচেয়ে তীব্র বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে বাংলাদেশ। বৈরি আবহাওয়া, কমতে থাকা রিজার্ভের কারণে জ্বালানি আমদানিতে ভোগান্তি ও টাকার বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ায় এই সংকট তৈরি হয়েছে বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে এমন বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও গত বুধবার (৭ জুন) প্রধানমন্ত্রী আশার বাণী শুনিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দু-এক দিনের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে আরও ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে। ১০-১৫ দিনের মধ্যে আরও বিদ্যুৎ যুক্ত হবে। তখন আর কোনো কষ্ট থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এমন আশ্বাস বাণীর পর গত শনিবার (১০ জুন) দৈনিক মানবজমিনে একটি খবর আমার নজরে পড়ে। যে খবরে বলা হয়, ২৬ হাজার ৬২০ মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে মোংলা বন্দরে পৌঁছেছে চীনা পতাকাবাহী জাহাজ। যে জাহাজটি গত ২১শে মে ইন্দোনেশিয়া থেকে মোংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। এখন মোংলা বন্দর থেকে এই জাহাজের কয়লা খালাস করে তা বাগেরহাটের রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নেয়া হবে। তাই তীব্র গরমে চলমান লোডশেডিং নিয়ে যখন জনমনে অস্থিরতা বিরাজ করছে এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর লোডশেডিং লাঘবের এই আশ্বাসবাণী এবং রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কয়লা আসা নিশ্চয় জনমনে প্রশান্তির ছোঁয়া লাগবে।

দেশের চলমান এই লোডশেডিং নিয়ে বিভিন্নমহলের বিভিন্ন বক্তব্য যেমন আছে তেমনি এর লাঘব নিয়েও বিভিন্ন মহলের বিভিন্ন বক্তব্য আছে। তবে সরকারি তথ্যমতে বিদ্যুৎ ঘাটতির এই মূল কারণ হিসেবে জ্বালানি সংকটকে বলা হচ্ছে। আর এখানেই সমস্যা! কারণ দেশে ডলার সংকট নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আমরা নিয়মিত খবর প্রকাশ হতে দেখছি। তাই জ্বালানি প্রাপ্তিতে ডলার সংকট অন্যতম প্রধান কারণ হলে গ্রাহকদের ওপর বোঝা চাপিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা যাবে না এটাই প্রতীয়মান। এই বাড়তি মূল্য নিয়ে জ্বালানির জন্য যে ডলার দরকার সেটা কোন ভাবেই নিশ্চিত হবে না।

তাই এই জ্বালানি সংকটের তড়িৎ কোন স্থায়ী সমাধান সরকার আদৌ করতে পারবে কি তা নিয়ে জনমনে সকল সংশয়। তাছাড়া জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় এমন সংশয় আরো প্রবল হয়েছে। সর্বশেষ কয়লার মজুত শেষ হয়ে যাওয়ায় পরীক্ষামূলক উৎপাদনে আসার চতুর্থ দিনেই বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে অবস্থিত এস আলম গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র। বৃহস্পতিবার (৮ জুন) এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায় বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়।

এমতাবস্থায় এই সংকট লাঘবে সরকারের পরিস্কার কোন সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং দ্রুত বাস্তবায়নের কার্যকরী উদ্যোগ জনগণের সামনে না আসলে বিদ্যুৎ সমস্যা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে। আর যে সংকটের জন্য জনগণ দায়ী নয় সেই সংকটের সমাধানে যদি জনগণের উপর বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব ও হবে সুদূরপ্রসারি। কারণ যে ভর্তুকি বিদ্যুৎ খাতকে দিতে হয়, সেই ভর্তুকি দেওয়ার জন্য আসলে জনগণ দায়ী নয়। বিদ্যুতের এই উচ্চ মূল্যের পেছনে উচ্চ হারে ক্যাপাসিটি চার্জ দায়ী বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন।

তবুও গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে বিদ্যুতের দাম খুচরা পর্যায়ে সরকার আরও ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশ পায়। এর আগে, গত ৩১ জানুয়ারি সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। তার আগে ১২ জানুয়ারি ভোক্তাপর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম গড়ে প্রতি ইউনিটে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

তাই বিদ্যুৎ বিল আবার বাড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জ্বালানি প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে গেলে এর নেতিবাচক প্রভাব হবে ব্যাপক। এতে কৃষিতে সেচের খরচ যেমন বাড়বে তেমনি শিল্পপণ্যের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে। তাই খালি চোখে জনগণের আয় বেড়েছে এই যুক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ বিল বাড়ানোর চিন্তা অবান্তর। কারণ বিদ্যুতের এই বাড়তি বিলের অজুহাতে ব্যবসায়ীরা জনগণের দৈনন্দিন আরও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিবেন। এতে বিনা কারণে জনগণ ভোগান্তিতে পড়বেন। দেখা যাবে মাসে হয়তো একজনের বিদ্যুৎ বিল বাড়বে ৫০ টাকা কিন্তু তার অন্যান্য খরচ বেড়ে যাবে ৫০০ টাকা! তাই এক্ষেত্রে মূল যে কারণ বা সমস্যা তা চিহ্নিত করে ধারাবাহিকভাবে এগুতে হবে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কলামিস্ট। ক্রীড়া সম্পাদক, সাপ্তাহিক সুরমা।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close