নিউজবাংলাদেশ

দেশজুড়ে প্রতারক চক্রের নতুন নতুন প্রতারণার জাল, প্রশাসন নিশ্চুপ

  • শুয়ে বসে আয়ের লোভ দেখিয়ে এবার উধাও এমটিএফই
  • ফাঁদে নিঃস্ব উত্তরের লাখ মানুষ

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।

লণ্ডন, ২৩ আগস্ট: শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলে দেশ ডিজিটাল করতে না পারলেও দেশজুড়ে ডিজিটাল প্রতারকের জন্ম দিয়েছেন। এই ডিজিটাল প্রতারকেরা প্রশাসনের নাকের ডিগায় ক্যাসিনো থেকে শুরু করে দেশজুড়ে নতুন নতুন প্রতারণার জাল পেতে সাধারণ মানুষকে নি:স্ব করে দিচ্ছেন। ডেসটিনি-২০০০, ইউনি পে টু ইউ এসবেরই ধারাবাহিকতায় এবার পরিশ্রম ছাড়া ঘরে বসে বিনিয়োগ করে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে গ্রাহকের প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ (এমটিএফই) নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিদেশি ভুঁইফোঁড় এই অনলাইন প্রতিষ্ঠানের চাতুরীর ফাঁদে পড়ে বরিশাল, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুষ্টিয়া, উত্তরাঞ্চলসহ অনেক এলাকার লাখ লাখ মানুষ এখন ফতুর। দেশে অবৈধ ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে অনলাইনের সব কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে অ্যাপসভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি।

৭ আগস্ট সিস্টেম আপগ্রেডের কথা বলে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে এমটিএফই। ফলে অনেকেই অপেক্ষায় ছিলেন যে সিস্টেম আপগ্রেড হওয়ার পর টাকা তুলবেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) রাতে হুট করে প্রায় সব গ্রাহকের ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের ব্যবসায় লোকসান হয়েছে। এজন্য উল্টো গ্রাহকদের কাছ থেকেই তারা টাকা পাবে। আয়ের লোভ দেখিয়ে এমটিএফই উধাও হলেও মূলহোতারা আছেন ওমরা হজে।

জানা গেছে, কানাডিয়ান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ কোম্পানি (এমটিএফই) বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০২১ সালে। তিন বছরে এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই ৪২ লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারের বেশিও ইনভেস্ট করেছেন। এভাবে কোম্পানিটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে।

ঢাকাসহ সারা দেশে কোম্পানিটির ৪ শতাধিক অফিস রয়েছে। এমটিএফই’র অ্যাপে এসব অফিসের ছবিসহ ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য দেয়া আছে। মূলত দুবাই থেকে মাসুদ আল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশি এমটিএফই’র এশিয়া অঞ্চলের দেখভাল করেন। তিনিই এমটিএফই’র কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে দিতেন। তার থেকে পাওয়া তথ্য অন্যান্য গ্রুপের সিইওরা তাদের মেম্বারদের জানাতেন। মেম্বাররা আবার তাদের সদস্যদের জানাতেন।

এমটিএফই’র বেশ কয়েকজন গ্রাহক জানান, অ্যাপটিতে কেউ ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে প্রতিদিন তাকে প্রায় ১৩ ডলার লাভ দেওয়া হতো। তবে এত অল্প বিনিয়োগে তো বড় লাভ আসবে না। সেজন্য অনেকে ৫ হাজার, ১০ হাজার, এমনকি ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন। বিনিয়োগ যত বেশি, লাভও তত বেশি ছিল। এমনকি প্রতিমাসে বিনিয়োগের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত লভ্যাংশ পেতেন গ্রাহকরা। এমটিএফইতে শুধু বিনিয়োগের ওপর লাভই নয়, কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারলে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন পাওয়া যেত। এমন করে কারও মাধ্যমে ১০০ জন গ্রাহক বিনিয়োগ করলে তার পদবি হতো ‘সিইও’। কমিশন আর নিজের বিনিয়োগের অর্থ মিলে ওই কথিত সিইও মাসে ১৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারত।

এমটিএফই’র ফাঁদে পড়ে শুধু বাংলাদেশে নয়, পশ্চিমবঙ্গেও প্রতারিত হয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতারিতদের মধ্যে বেশিরভাগই তরুণ এবং বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এ ছাড়া শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী এবং সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষও রয়েছেন।

কিভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে এমটিএফই

একজন নাগরিক এমটিএফই এবং বাইনান্স নামের একটি অ্যাপ ডাউনলোড করে খুব সহজেই এমটিএফইতে রেজিস্ট্রেশন করতে পারতেন। রেজিস্ট্রেশনের পর তাদের নিজস্ব ওয়ালেটে ট্রেডের জন্য ডলার রাখতে হতো। ডলারের পরিমাণ অনুযায়ী তাদের প্রতিনিয়ত লাভ দেওয়ার প্রলোভনও দেওয়া হতো। বিজ্ঞাপনে এমটিএফই বলতো, কেউ যদি ২৬ থেকে ৬০ ডলার বিনিয়োগ করেন, সেক্ষেত্রে তিনি প্রতিদিন ০.৩৯ ডলার থেকে ০.৬০ মার্কিন ডলার লাভ করতে পারবেন। একইভাবে ৬১ থেকে ২০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ০.৯৮ ডলার থেকে ২.০৫ ডলারের লাভ, ২০১ থেকে ৫০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫.০৯ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৫০১ থেকে ৯০০ ডলার বিনিয়োগে প্রতিদিন ১০.৯৩ থেকে ১৪.৬৪ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৯০১ থেকে ১৫০০ ডলার বিনিয়োগে ১৮-২৪.৪০ ডলার পর্যন্ত লাভ, ৩৫০১ থেকে ৫০০০ ডলার বিনিয়োগে ৮৫ থেকে ১২৫ ডলার পর্যন্ত এবং ৫০০১ ডলার থেকে ১০ হাজার পর্যন্ত বিনিয়োগে প্রতিদিন ১১০ থেকে ১৬০ ডলার পর্যন্ত লাভ হতে পারে বলে লোভ দেখানো হয়।

দেশজুড়ে জাল বিছালেও প্রশাসন ছিল নিশ্চুপ

২০২১ সালের পর থেকে এমটিএফই বাংলাদেশে ভার্চুয়ালি কার্যক্রম চালালেও তা কেন প্রশাসনের নজরে এলো না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের আনাচে-কানাচে সভা-সেমিনার করে কোম্পানিতে যুক্ত হলে কেমন সুবিধা মিলবে– এর জাদুকরি বয়ানও দেওয়া হয়েছিল। এসব সেমিনারে উপস্থিত থাকতেন এমটিএফইর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে বিনিয়োগ করে কীভাবে ‘শিকড় থেকে শিখরে’ ওঠা যায়, সেই গল্প শোনাতেন তারা। নিয়ম না থাকলেও প্রলুব্ধ করতে দেশের বিভিন্ন জেলায় তিনশর বেশি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ দেওয়া হয়। অনেকে আবার ফেসবুকসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এমটিএফইর সভা-সেমিনারের ছবি প্রকাশ করে অন্যদের আকৃষ্ট করতেন। শুধু এমটিএফই নয়, আরও অনেক প্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্রিপ্টোকারেন্সি ও জুয়ার আড়ালে অর্থ তুলছেন।

দেশের সচেতন জনগণ সরকারকে প্রশ্ন করছেন, গোয়েন্দাকাজে ব্যবহারের কথা বলে ইসরায়েল থেকে পিকসিক্স এর প্যাগাসাসসহ আরও কিছু যন্ত্রপাতি হাঙ্গেরী, গ্রীস ও সুইজারল্যান্ড হয়ে বাংলাদেশে নেয়া হলো। মোবাইল ট্রাক করা, ম্যান অন দ্যা মিডল, আইপি এবং ব্রাউজার বের করা, কথা রেকর্ড করা, মেসেজ, কললিস্ট, গ্যালারি ও কনটাক্ট লিস্ট বের করার কথা বলে আরও কয়েকটা সরকারি প্রতিষ্ঠান জনগণের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে ব্যাপক হার্ডওয়ার ও সফ্টওয়ার কিনলো, ট্রেনিং নেওয়ার নামে কর্মকমর্তাদের সরকারি খরচে বিদেশে পাঠানো হলো, কিন্তু এর থেকে দেশের জনগণ কী পেলো? জনগনের ট্যাক্সের পয়সা আর রেমিটেন্সের টাকায় এতো কিছু কেনার উদ্দেশ্য কি ছিলো, শুধু বিরোধী দলের মিছিলে কে কে গেলো তাদের মোবাইল নম্বর যোগাড় করে মামলা করার সময় কাজে লাগানো?

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close