নিউজ

দুর্নীতির শ্বেতপত্র- পর্ব-এক# ৫৮২ কোটি টাকার সার চুরি- জালিয়াত পোটন ও তার সহযোগী ৬ মন্ত্রী-আমলা

(কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড।তাই সাপ্তাহিক সুরমা দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশের শুরুটা করছে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে একটি ভয়াবহ জালিয়াতির প্রামাণ্য প্রতিবেদন দিয়ে- সম্পাদক)

সুরমা প্রতিবেদন।। একবছর পার হলেও ৭২ হাজার মেট্রিক টন সার এখনো চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বিসিআইসির গুদামে গিয়ে পৌঁছেনি! পরিবহন কোম্পানির গাড়ি থেকে এই বিপুল পরিমান সার কোথায় গেছে, কেউ জানেনা। ৫৮২ কোটি টাকার সার চুরি-ডাকাতি বা আত্মসাতের কোনো মামলা হয়নি। কেউ গ্রেফতার হয়নি। জালিয়াতির নায়ক ও তার চক্র নিরাপদে থাকার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বিসিআইসির চেয়ারম্যানসহ দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-আমলাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়কে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

ক্যাপশন: সার কেলেঙ্কারীর প্রধান হোতা যার দিকে অভিযোগের তীর সেই কামরুল আশরাফ খান পোটন (উপরে বামে)। এছাড়া সাগর চুরির এই ঘটনায় সহযোগী অন্যান্য আলোচিতদের মধ্যে ডানের সারিতে উপরে শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ হুমায়ুন, মাঝে শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা, ডানে নীচে বিসিআইসির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. সাইদুর রহমান ও বামে নীচে সারচুরি ও ধামাচাপা দেয়ার সময় বিসিআইসির চেয়ারম্যান মি. এমদাদুল হক।

জানা গেছে, ছয় মাস আগে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসিকে।এখানেই শেষ। কিছুই করেনি তারা। দুদক নীরব। কারণ পরিবহন কোম্পানীর মালিক ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে নরসিংদী পলাশের (জাতীয় সংসদ আসন নং-২০০) এমপি কামরুল আশরাফ খান, আওয়ামী লীগ নেতা এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ এমপি’র ভাই। প্রায় ১০ বছর দেশের সার ব্যবসার নিয়ন্ত্রক এই কামরুল। এই সেক্টরের মাফিয়া হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করেছেন। কিন্তু নানা কায়দায় সকল অপকর্ম করেও রয়ে গেছেন ধরা ছোয়ার বাইরে।

বাংলাদেশ সার আমদানির পরিমান ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত বছর আমদানিকৃত সারের প্রায় ৫শতাংশ একজন ব্যক্তি ও তার চক্র আত্মসাৎ করলেও চারদিকে শুনশান নীরবতা এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় একটি মাত্রা সংযোজন করেছে। সার ব্যবসায় জড়িত ও নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক সূত্র বলেছে, শুধু এই ৫৮২ কোটি নয় বরং গত ১০ বছরে এই চক্র সার ব্যবসা- বিতরণ  ও ভর্তুকী থেকে এর চেয়ে কয়েকগুন লুটপাট করেছে। প্রতিবছর প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকী আর ৩৫/৪০ হাজার কোটি টাকার সার বাণিজ্যের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রক এই সার জালিয়াত চক্রকে নিয়ে সাঁড়াশি তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে কেঁচো খুঁড়তে অজগর।

যেখান থেকে শুরু-
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সরকারিভাবে আমদানি করা ৭২ হাজার মেট্রিক টন রাসায়নিক সার বন্দর থেকে খালাস হয়েছিল ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৫ মের মধ্যে। গুদামে পৌঁছে না দিয়ে আত্মসাৎ করেছে পরিবহনের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স পোটন ট্রেডার্স। এতে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৫৮২ কোটি টাকা। পোটন ট্রেডার্স যে সার আত্মসাৎ করেছে, তা উঠে এসেছে সারের আমদানিকারক শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান রসায়ন শিল্প সংস্থার (বিসিআইসি) দুটি তদন্তে। ওই দুটি তদন্তে পোটন ট্রেডার্সের অপকর্ম ও দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হলেও ‘বিশেষ কারণে’ তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এবার দেখে নেয়া যাক এই অপকর্ম সংগঠনকালে কে কোথায় কিভাবে নীরব থেকে এই সারচুরি বা ডাকাতিতে সাহায্য করেছেন। অথবা তাদের প্রশাসনিক ও আইনত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।

পোটন ট্রেডার্সের কোনো অফিসিয়াল ওয়েবসাইট নাই/ এতো বড় কোম্পানী শত শত কোটি টাকার সার পরিবহন করে তার কোনো ওয়েবসাইট না থাকার কারণ কি হতে পারে? জানা গেছে কাগজ সর্বস্ব এই কোম্পানির অফিস দেখানো হয়েছে বিসিআইসি ভবনে(রেফারেন্স: বিডি ট্রেড ইনফো)। এখান থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, এই চক্রটি সরকারের মদদপুষ্ট ও সরাসরি নিয়ন্ত্রণে।

কারা জড়িত-

এককভাবে কেউ কোনো অপরাধ করতে পারেনা। ৫৮২ কোটি টাকার সার চুরির বিশাল জালিয়াতির সময়টাতে বিসিআইসির চেয়ারম্যান ছিলেন মি. এমদাদুল হক। তিনি একজন অতিরিক্ত সচিব(গ্রেড-১, মানে সচিবের সমমান)। বিসিআইসি শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সংস্থা। এই সময়ে মন্ত্রী ছিলেন এবং আছেন মি. নুরুল মজিদ হুমায়ুন। আর সচিব ছিলেন ও আছেন  জাকিয়া সুলতানা (১৬ মে ২০২১ থেকে)/ আর ওই বছরের প্রথম থেকে সংস্থাটির চেয়ারম্যান  মোঃ সাইদুর রহমান (ইনিও গ্রেড-১ অর্থাৎ সচিবের সমমান), এছাড়া কৃষি মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও তার মন্ত্রণালয়ের সচিব শুধু বিনা স্বার্থেই নীরব ছিলেন(?) এটা বিশ্বাস করার কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ খুঁজে পাওয়া যায়না।

সার বুঝে নেয়ার কথা কৃষি মন্ত্রণালয়ের। কারণ কৃষকদের মাঝে ভর্তুকির সার বিতরণ এই মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ/ তারা সময়মতো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অথবা দুদককে কেলেংকারীর নায়কদের গ্রেফতার, সার উদ্ধার ও বিচার করতে বলেছে, এমন প্রমান পাওয়া যায়নি। বরং জানুয়ারী’২৩-এ এ ঘটনা জানাজানি হলে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বললেন, “আমরা পোটন ট্রেডার্সকে সার পরিবহন থেকে বাদ দিয়েছি!” রাষ্ট্রের এতবড়ো অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে এই সামান্য ব্যবস্থা এবং এই চক্রের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করার অর্থ অপরাধবিজ্ঞানে স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা আছে।     

হাইকোর্ট ও দুদকের ভূমিকা!

৫ জানুয়ারী’২৩ একটি খবরের কাগজে ৫৮২ কোটি টাকার সার কেলেঙ্কারী নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হলে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ-এর দৃষ্টিতে আনেন। কোর্ট রুল জারি করে দু’মাসের(৬০ দিন) মধ্যে বিস্তারিত জানাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে নির্দেশ দেন। তারপর কয়েক দফা ৬০ দিন গেলেও তারা কেউই কোনো কিছুই জানায়নি। শেষে গত ১৫ জুন কোর্টের একই বেঞ্চ ভীষণ বিরক্ত হলেন। খুবই ক্ষুব্দ হয়ে নানা কথা বললেন। কিন্তু সারচুরির জন্য দুই মন্ত্রী-সচিব-বিসিআইসি’র সংশ্লিষ্ট কর্তাদের আদালত অবমাননা অথবা দুদকের ব্যর্থতার জন্য আদালতের অপর্যাপ্ত ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। পুরো কেলেঙ্কারি ও তার নেপথ্যের সকল অপরাধীকে তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনার প্রয়োজন কোনো শর্তসাপেক্ষ নয় বরং জনস্বার্থে জরুরী অভিমত দিয়েছেন অভিজ্ঞ মহল।দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান একজন দক্ষ আইনজীবী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এই মামলায় তাঁর কোনো কঠোর ভূমিকা দেখা যায়নি।

হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বেও ৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাত ও জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) আদালতে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করেনি। ১৫ জুন সর্বশেষ আদালত এ ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আদালত “রাগান্বিত” হয়ে বলেন, ‘টাকা কি বাতাসে খেয়েছে? কারা এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত, কারা এ টাকা আত্মসাৎ করেছে—তাদের নাম দিন। দুর্নীতিবাজদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। প্রয়োজনে কোর্ট থেকে সরাসরি জেলে ঢুকায়ে দেব।’ উচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ আইনগত কর্তৃত্ব থাকা সত্ত্বেও আদালতের নির্দেশ অবমাননার জন্য দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হতাশাজনক। ৯ জুলাই আদালত আবারো রিপোর্ট দিতে নির্দেশ দিলেও জালিয়াতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা খুবই সীমিত বলে মনে করা হচ্ছে।

পোটনের কনেকশন-

এই সারচুরির ঘটনার মুলনায়ক কামরুল কারিশমায় ৭২ হাজার টন সার যেভাবে গায়েব হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কারিশমা তিনি দেখতে পেরেছেন দুদক, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিসিআইসি সবাইকে হাইকোর্ট দেখিয়ে। তবে সার কেলেংকারীর ওয়াকিবহাল মহল অবশ্য তার কারিশমার চেয়ে ভাগ বাটোয়ারায় দক্ষতার প্রশংসা করছেন। 

সার কেলেঙ্কারীর হোতা পোটনের সাথে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অর্থমন্ত্রী, শাসক দলের নানা পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে।নিজের ভাই আওয়ামী এমপি আনোয়ারুল আশরাফ খান- ২০০৮ ও ২০১৮ (বর্তমান)’র সংসদে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি। ১৪’তে ওই আসন জাসদকে (ইনু) দেয়ার কারণে আনোয়ার আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাননি। ওই আসনে প্রার্থী হন জাসদ ইনুর প্রার্থী। ফলে ভাই পোটনকে স্বতন্ত্র দাঁড় করিয়ে আনোয়ার জিতিয়ে আনেন। দুই ভাইয়ের আওয়ামী কতৃত্ব গত ১৫ বছরে পলাশে কায়েম করেছে একচ্ছত্র দখলদারিত্ব। পোটন জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতির চেয়ার তার দখলে নিতে চান।

২০১৬ সালে ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি প্রার্থী হলেও ফুটবল মাফিয়া কাজী সালাউদ্দিনের সাথে পেরে উঠেননি। দেশের সকল ফুটবল ক্লাবকে স্বনির্ভর হওয়ার জন্য তিনি একটি করে ফিক্সড ডিপোজিটের মাধ্যমে আর্থিক সাহায্যের অঙ্গীকার করেছিলেন। এইভাবে সার কেলেঙ্কারীর জন্য অভিযুক্ত একজন জালিয়াত মাফিয়া নরসিংদীর শান্ত জনপদ পলাশ থেকে ক্রীড়াঙ্গন সর্বত্র দখলদারিত্ব কায়েম করে। আর বাংলাদেশের প্রাণ কোটি কোটি কৃষক ও কৃষির প্রাণশক্তিকে নিজেদের অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ার কাজে ব্যবহারের প্রয়াস চালায়। এই দুর্নীতি ও জালিয়াতির ঘটনা শুধু শ্বেতপত্রেই নয়, দুর্নীতির ইতিহাসেও আজীবন চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close