নিউজ

বন্ধ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তি মিশন!

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।

লণ্ডন, ১৬ জুন: বিরোধী দল এবং সংখ্যালঘুদের ওপরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনৈতিক ও ফ্যাসিবাদী সরকারের নানা রকম অন্যায় অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে গত ১৭ মে বাংলাদেশের সৈন্য জাতিসংঘে পাঠানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যান  স্কট প্যারি, বব গুড, ব্যারি মুর, টিম বার্শেট, ওয়ারেন ডেভিডসন ও কীথ শেলফ প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চিঠি লিখেছেন।

চিঠিতে তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন থামাতে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের সর্বোচ্চ সুযোগ দেওয়ারও অনুরোধ জানাচ্ছি। এতে আরও বলেন, শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে, কিছু এনজিও তার শত শত প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ফ্রিডম হাউস- এমনকি জাতিসংঘেরও প্রতিবেদন রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে প্রত্যাখ্যান করছে। মানুষের ওপর নির্যাতন বেড়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে, সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করা হয়েছে, প্রতিপক্ষকে গুম করা হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা এবং হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের নির্যাতন শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপরই হয়নি, বরং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর হিন্দুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাদের ওপর হামলা, মন্দির ও বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তর করার কারণে হিন্দুরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে খৃস্টান সম্প্রদায়ের ওপরও নিপীড়ন চালানো হয়েছে। কয়েক মাস ধরে হাজার হাজার মানুষ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছে। এই প্রতিবাদীদের একটাই প্রত্যাশা, শেখ হাসিনার সরকার যাতে বিদায় নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের গুম-খুন-নির্যাতনের মূল হোতা, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র্যাব) অসংখ্য প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করেছে, খুন করেছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফ্রিডম হাউজ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অসংখ্য এনজিও র্যাবকে সরকারের ডেথ স্কোয়াড হিসেবে অভিহিত করেছে।

সম্প্রতি ডয়চে ভেলে ও নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, র্যাবের প্রাক্তন সদস্যরা স্বীকার করেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন ছাড়া বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটানো সম্ভব না। চিঠিতে তাঁরা উল্লেখ করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বছর আগে র্যাবকে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্যাংশন জারি করেছে। এরপরও শেখ হাসিনার সরকার জনগণের ওপর নিপীড়ন জোরদার করেছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই সরকারের পিছিয়ে পড়া এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঠেকাতে র্যাবের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা যথেষ্ট নয়। দেশের জনগণের প্রতি শেখ হাসিনার এই অপরাধ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য খারাপ ‘অ্যাক্টরকে’ উৎসাহিত করছে। তারা একত্রিত হচ্ছে এবং চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থকে আঘাত করছে। আমরা চাই বাংলাদেশ অবাধ নির্বাচনের সর্বোত্তম সুযোগটি পাক। এই জন্য ব্যক্তিভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের এই চিঠির রেশ কাটতে না কাটতেই এবার বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য নিয়োগের আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। এইচআরডব্লিউ জাতিসংঘের প্রতি এ আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। উচ্চ পদস্থ এই কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরের আগে এইচআরডব্লিউ থেকে এমন আবেদন অত্যন্ত গুরুত্ব রাখে। সোমবার (১২ই জুন) এইচআরডব্লিউর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ল্যাক্রোইক্স এমন সময়ে বাংলাদেশ সফর করছেন, যখন সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীগুলো দেশটির রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে এবং বিভিন্ন অধিকার কর্মী, গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবার সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হয়রানি করছে। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাবাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশ সফরকালে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের খোলাখুলি উদ্বেগ জানানো উচিত।

এইচআরডব্লিউ আরও বলেছে, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবদান সবচেয়ে বেশি। এই অবস্থান ধরে রাখতে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা যথাযথভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে, জাতিসংঘের হয়ে যারা কাজ করবে তারা কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত নয়। সফরকালে জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সে এই নীতিমালার ওপর জোর দিতে হবে। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। নিরপত্তা বাহিনীর যেসব সদস্য মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত দেশের বাইরে শান্তি রক্ষা মিশনে যেন তারা অংশ না নিতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা ব্যর্থ হয়েছে। শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয় যাচাই-বাছাই করে জাতিসংঘ।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে র‌্যাবের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে এইচআরডব্লিউ। বলা হয়েছে, সামরিক বাহিনী ও পুলিশের কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত এই বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত। ২০১৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটি জানিয়েছিল, জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের এমন অনেক সদস্যকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা র‌্যাবের হয়ে কাজ করেছেন। বিষয়টি উদ্বেগের। এমন পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন যাচাই-বাছাই ব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল জাতিসংঘের ওই কমিটি। ওই যাচাই-বাছাইয়ের উদ্দেশ্য ছিল, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমসহ অন্যান্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যক্তি বা ইউনিটকে যেন শান্তি রক্ষা মিশনে নিয়োগ না দেওয়া হয়, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এইচআরব্লিউ বলছে, জাতিসংঘের উচিত কোনো বাংলাদেশি কর্মকর্তা র‍্যাবের সঙ্গে জড়িত থাকলে, তা প্রকাশ করা এবং বাহিনী–সংশ্লিষ্ট কাউকে শান্তি রক্ষা মিশনে যোগদানে বিরত রাখা। শুধু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নয়, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সব সদস্যের মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিষয় যাচাই-বাছাই করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন বিভাগকে। জ্যঁ পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এইচআরডব্লিউ বলেছে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সরকারের ব্যর্থতা এবং বিশ্বব্যাপী জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার জন্য তারা যে হুমকি সৃষ্টি করেছে, তা চিহ্নিত করতে সফরকালে ল্যাক্রোইক্সকে মানবাধিকার যাচাই বাছাইয়ের বিষয়ে প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। বাংলাদেশের বাহিনীগুলোর জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশগ্রহণ বন্ধ করতে হবে।

এদিকে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (এমইপি) ছয় সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ/ভাইস-প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেল ফন্টেলেসকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার ও তার অনুগত বাহিনী নিজেদের চরিত্র না পাল্টালে বন্ধ হয়ে যাবে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তি মিশন!

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close