ইমরান খানের বিদায়: পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ কোন পথে
।। আখলাক আহমেদ ।।
লেখক: ডিপলোমেটিক এডিটর
সাপ্তাহিক সুরমা।
কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর অবশেষে পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাদ পড়েছেন, তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শেহবাজ শরীফ নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এবং দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার ধারা অব্যাহত রয়েছে। দেশটির ৭৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কখনোই পূর্ণ পাঁচ বছরের মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেননি, আবার কাউকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমেও অপসারিত হতে হয়নি। ইমরান খানই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি সংসদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে অপসারিত হলেন। এই দুঃখজনক পরিসংখ্যানটি সৃষ্টি হয়েছে হয়েছে দেশের ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্রমাগত অন্তর্দ্বন্দ্ব, সরকারী আমলাদের মধ্যে ভয়াবহ দুর্নীতির সংস্কৃতি এবং নিজেদের বিশেষ প্রিভিলিজ রক্ষার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সামরিক সেনাপতিদের ঘন ঘন হস্তক্ষেপের মাধ্যমে। তাইতো বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে।
যারা ২০১৮ সালে ক্যারিশম্যাটিক ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক নেতা বনে যাওয়া ইমরান খানকে ভোট দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই আশা করেছিলেন যে তিনি এই ব্যর্থতার অশুভ চক্রগুলি শেষ করবেন। তিনি ভুট্টো বা শরীফ পরিবার থেকে আসেননি, যে রাজনৈতিক পরিবারগুলি পাকিস্তানের রাজনীতিতে গত পাঁচ দশক ধরে আধিপত্য বিস্তার করে আসছিল। একজন সত্যিকারের রাজনৈতিক বহিরাগত হিসাবে তার মর্যাদা, যুবসমাজকে লক্ষ্য করে তার দূর্নীতি বিরোধী প্রচার ও ইনসাফভিত্তিক নয়া পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি নেতা হিসেবে তাঁকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছে এবং জনগণ বিশ্বাস করেছে দেশের স্থানীয় দুর্নীতিকে আক্রমণ করার জন্য তিনি হবেন সবচাইতে যোগ্য ব্যক্তি। ইমরান পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে চিরস্থায়ী খেলোয়াড় ও সময়ে সময়ে হস্তক্ষেপকারী সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদ পেয়েছেন বলেও মনে হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের সাড়ে তিন বছর পর করোনা উত্তর পরিস্থিতিতে ইমরান খান কঠিন অর্থনৈতিক সময়ের শিকার হয়েছেন। উত্তরাধিকার সূত্রে ইমরান পেয়েছিলেন প্রায় শুন্য এক রাজকোষ, আগেকার সরকার সমূহের পূঞ্জীভূত ঋণের সূদ মেটাতে গিয়ে তার সরকারের প্রায় দেউলিয়া হবার অবস্থা, রুপির ভীষণ দরপতনের ফলে খাদ্যদ্রব্য সহ মুদ্রাস্ফীতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। করোনায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন থেমে গেছে, বেকারত্ব বেড়েছে; সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সরকারের ঋণ ও ঘাটতি।
ইমরান কিছু সামাজিক সূরক্ষামূলক কর্মসূচির প্রবর্তন করেছিলেন যেমন স্বাস্থ্য সূরক্ষা কার্ড, এহসাস কর্মসূচি, করোনায় দুই কোটি পরিবারকে নগদ অর্থ প্রদান ইত্যাদি। আফগানিস্তানের সমাধান মিলিটারিলি হবে না বলে তার ঐতিহাসিক উক্তি সঠিক হয়েছে এবং তার জনপ্রিয়তার পারদ উপরে উঠতে সহায়তা করেছে। কিন্তু তার ক্রমবর্ধমান সাহসী আবার অনেকের কাছে বিতর্কিত পররাষ্ট্রনীতিও পাকিস্তানের সামরিক কর্তা ব্যক্তিদের সাথে তার সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলতে সাহায্য করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে একটি বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা দীর্ঘদিন ধরে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের সাথেই ভাল সম্পর্ক পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিবেচনায় পাকিস্তানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিরুদ্ধে চীন হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী মিত্র এবং চীনের বিনিয়োগ পাকিস্তানের অর্থনীতির ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা এটাও জানে যে টঝ এবং ঊ.ট. পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি বাজার, এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে সুসম্পর্ক, যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মঙ্গলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সামরিক বাহিনী আশা করেছিল অক্সফোর্ড শিক্ষিত ইমরান পাশ্চাত্যের সাথে ভালো বোঝাপড়া করতে পারবেন এবং পূর্বের সরকার সমূহের মতোই বা আরো ভালো ভাবে আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে সুবিধা এনে দিতে পারবেন।
ইমরান খানকে দেখা গেল তাদের প্রত্যাশার বিপরীতে হাঁটতে। স্বাধীনচেতা ইমরান যেরকম খোলাখুলিভাবে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করেছিলেন তা ভোটার ও সমর্থকদের খুশি করতে সক্ষম হলেও ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসে নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলতে শুরু করে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে তিনি তার মূল ভোটারদের আমেরিকা বিরোধী অবস্থানে থেকে দেশের স্বার্থ রক্ষায় চেষ্টা করছিলেন বলে জানিয়েছিলেন এবং পাশ্চাত্যকে এও বলেছিলেন, ‘আমরা কি তোমাদের গোলাম?’। তবে পাশ্চাত্যের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় যখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রথম দিনে মস্কোতে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এ কাজের মাধ্যমে তিনি ওয়াশিংটনে এবং পাকিস্তানের জেনারেলদের মধ্যে বিপদের ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন। যদিও সেই সফরটি হঠাৎ করে হয়নি, এটি ছিল দীর্ঘ-পরিকল্পিত, সেনাবাহিনীর সমর্থিত এবং এর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রাশিয়ান প্রাকৃতিক গ্যাস সুরক্ষিত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতশত্রু ভারতের ক্রমাগতভাবে আমেরিকার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে পাক সামরিক বাহিনী রাশিয়ার দিকে একটু হেলতে শুরু করেছিল। ইমরান এর সাথে তুরষ্কের এরদোগানের চিন্তা ও মনের মিল আর এরদোগানের সাথে পুতিনের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ওয়াশিংটনে এই বার্তা পৌঁছে দেয় যে এখনি রাশ টেনে ধরা না হলে ইমরান আরেক এরদোগান হতে যাচ্ছে। এটা চাউর হয়েছিল তবে ইমরান এই সন্দেহকে নিরুৎসাহিত করতে খুব কমই করেছেন যে তিনি রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনের ভক্ত। এই সন্দেহ দৃঢ় বিশ্বাসে পৌঁছে যখন পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দায় ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকে।
ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্তাব্যক্তিরা পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত কে ডেকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয় ইমরান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে পাকিস্তানের সাথে আমেরিকার সম্পর্ক উন্নয়ন অসম্ভব। অল্পদিনেই এই হুমকি বাস্তব রূপ লাভ করতে শুরু করে। ইমরান দেখলেন তার সংসদীয় জোট ভেঙ্গে যেতে শুরু করেছে, মিত্ররা দূরে সরে যাচ্ছে এবং সামরিক বাহিনীর টপ ব্রাস তাকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য বিরোধী দলীয় আইন প্রণেতাদের কাছে তাদের সমর্থন পৌঁছে দিয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে ইমরান “পশ্চিম” এর নেতৃত্বে তার সরকার উৎখাতের যে ষড়যন্ত্র চলছে তা জনসমক্ষে বলে ফেলেন, এমনকি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল এর বাইরে গিয়ে টিভি ভাষণে আমেরিকার নাম বলে ফেলেছিলেন। মদিও তিনি পরক্ষনেই শুধরে নিয়েছিলেন কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে গেছে। সবাই বুঝে যায় তিনি অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে চেয়েছিলেন তাকে কূটনৈতিক ধাক্কা দিয়ে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। ওয়াশিংটন দ্রুত তার কিস্তি গুটিয়ে আনে, এমন কাউকে ক্ষমতায় আনে যারা দূর্নীতি করলেও আমেরিকার কথার বাইরে যাবার সাহস রাখে না। ফলাফল ইমরান খান আউট, শেহবাজ শরিফ ইন ।
ইমরান খান তার সমর্থকদের এক নয়া পাকিস্তানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। স্বপ্ন ছিল বড়, সাড়ে তিন বছর ধরে এর অনেক গুলো বাস্তবায়ন ও করেছিলেন কিন্তু অত্যন্ত ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা তার অবস্থান কে লেজেগোবরে করে দেয়। তার সমর্থকদের মতে নতুন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ, “পুরানো পাকিস্তান” এর প্রতি প্রত্যাবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করছেন, এক দূর্নীতি গ্রস্ত পরিবার কেন্দ্রিক, সামন্ততান্ত্রিক পাকিস্তান। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ৭০ বছর বয়সী ছোট ভাই শেহবাজ শরীফ একজন ঝানু রাজনীতিবিদ এবং পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ পাঞ্জাবের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীও। তাঁর পরিবার পাকিস্তানের বৃহত্তম ধনী পরিবারের অন্যতম এবং তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে দূর্নীতি বিস্তর অভিযোগ। তবুও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার প্রাথমিক কাজ হবে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা যদিও করোনা পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় হুমকিগুলো তার সম্মুখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকবে। কিন্তু আমেরিকা ও আর্মির আশির্বাদ পুষ্ট এই নতুন সরকার আমেরিকা ও চীন উভয়ের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্রমবর্ধমান দুঃসাধ্য কাজটিতে কতটা সফল হবে তার উপরে তাদের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে। যদিও ইমরানের প্রতি প্রবল জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে এবং এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে ইমরান খান প্রবল প্রতাপে ফিরে আসবেন, তবুও ক্ষমতাসীন সরকার এই ঝুঁকি নেবে না। আগামী দিনগুলোতে পিটিআই এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে এবং ইমরানের দলকে তছনছ করে দেয়া হবে যাতে করে পরবর্তী নির্বাচনে তেহরিক ইনসাফ আর ফিরে আসতে না পারে। পাকিস্তানের দূর্ভাগ্য একটি সৎ নেতৃত্ব পেয়েও তারা ধরে রাখতে পারল না। আমেরিকা দাস পছন্দ করে, স্বাধীনচেতা আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন কাউকে নয়।