মুক্তচিন্তা

তথাকথিত অখণ্ড ভারতের মানচিত্র ও অন‌্যান‌্য জা‌তিরাষ্ট্রের উদ্বিগ্নতা

|| আহমদ কুতুব ||
লেখক: প্রাবন্ধিক। অনলাইন এক্টিভিস্ট

গত ২৮ মে ২০২৩ বয়কট ও বাকবিতণ্ডার মধ্যদিয়ে ভারতের নতুন নির্মিত সংসদ ভবন উদ্বোধন করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দলিত আধিবাসী সম্প্রদায়ের  ভারতীয় রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। এখানেও ভারত সাম্প্রদায়িক চরিত্রের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। এই ইস‌্যুতে প্রায় ১৯টি বিরোধী দল অনুষ্ঠান বয়কট করে। সংসদ ভবনে কথিত অখণ্ড ভারতের একটা মানচিত্র স্থাপন করা হয় সেই মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ম্যাপটাও ডুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আশেপাশের অন্যান্য দেশ বিষয়টি নিয়ে ভারতের সাথে কুটনৈতিক পর্য্যায়ে দেনদরবার করলেও বাংলাদেশ সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি। অনেকের ধারণা বাংলাদেশ শুধু দিয়ে দেয়ার, আর ভারত শুধু নিয়ে নেয়ার পররাষ্ট্র নীতি থাকায়, বাংলাদেশ সরকারের কিছু করার বা বলার জায়গা নেই।  

ভারত বিশাল জনগোষ্ঠী ও বৃহত্তর আয়তন নি‌য়ে এক‌টি দেশ। দেশ‌টি যথেষ্ট সামরিক উন্নতি সাধন করেছে। মুসলিম বিদ্বেষী চেতনায় ভর করে ইসরাইল ও ইসরাইলী মিত্রদের কাছে বেশ সমাদৃত। অসাম্প্রদায়িক মুখোশে ভারতের প্রতিষ্ঠা হলেও ভারত কখনো সাম্প্রদায়িক চরিত্র পরিবর্তন করতে পারেনি। অনেক বুদ্ধিজীবীরা বলেন, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক চেতনার জন্য ভারতের সাথে বারবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে দেশটি। সে বিবেচনায় যাওয়ার পূর্বে প্রমাণ‌্য চিত্র ও যু‌ক্তি কি বলে?

পাকিস্তান ভারতের সাথে থাকবে না, তাই তাঁরা ১৯৪৭ সালে আলাদা মানচিত্র তৈরী করেছে। হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীরা কিছুতেই ভারতের মানচিত্র ভাগ করতে দিবে না। গর্ভধারীনী মাকে হত্যা করে দ্বিখণ্ডিত করা যেমনি পাপ, তেমনি ভারত মাতাকে ভাগ করা মহাপাপ। এই মহাপাপের জিকির তুলে ইংরেজ শাসনে বঙ্গবঙ্গ রুখে দিয়েছিলো বর্ণবাদী সম্প্রদায়। ১৯৪৭ সালে এই ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে সারা দেশকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঠেলে দেয়। সেই দাঙ্গায় অগণিত হিন্দু-মুসলিমের মৃত্যু হয়। কাল্পনিক ভারত মাতার অখনণ্ডমানচিত্র রক্ষায় জীবিত  অসংখ্য মা’কে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিলো। সে তাণ্ডবে গ্রামের পর গ্রাম শহরের পর শহর জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়া হয়েছিলো এমনকি মা’য়ের পেটে নিশ্চিন্তে ঘুমন্ত শিশুকে টেনে বাহির করে হত্যাও করা হয়েছিলো। কিন্তু এত কিছুর পরও কল্পিত মানচিত্র রক্ষা হয়নি। নুতন মানচিত্র ও আইডেনটি পেয়ে পাকিস্তান আত্মতৃপ্তি ও আনন্দেই ছিলো। এত গনহত্যার পরও বঙ্গভঙ্গের মত মানচিত্রভঙ্গ যেহেতু রুখে দিতে পারেনি সেই অন্তরজ্বলার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে আশপাশের রাষ্ট্রগুলোতে অশান্তি ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিরাজ করছে।

জওহরলাল নেহরু ভারত সন্ধানে আত্মকথায় অখণ্ডমানচিত্র উদ্ধারের চেতনার কথা রাখঢাক না করে বলেও দিয়েছেন। তাই দেখা যায় ভারতের জন্মলগ্ন থেকে কাগজে কলমে অহিংস নীতি লেখা থাকেও আচরণে হিংসাত্মক আগ্রাসন নীতি আশপাশের রাষ্ট্র গুলোর সাথে করে থাকে। ভারত আন্তর্জাতিক রীতিনীতিকে তোয়াক্কা না করে সীমান্ত হত্যা, কারবালায় সীমারের মত পানিতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের জনগনকে ধ্বংসের লীলাখেলা নীতিতেই পথ চলে। আশপাশ রাষ্ট্রের জনগণকে মূলা ঝুলিয়ে স্বধীনতার নামে, স্বাত্তশাসনের নামে কিংবা ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে অস্থিতিশীল করে নেয় এবং সেই সুযোগে একটা তাবেদার সরকার বসিয়ে দেয় আর সেই সরকার শুধু ভারতের সেবা করে ধন্য হয়। বাংলাদেশের মানচিত্রকে ভারতের মানচিত্রে ঢুকিয়ে সংসদ ভবনে স্থাপন করা শুধু সন্দর্য্য বর্ধনই নয় বরং ১৯৪৭ সালের কল্পিত মানচিত্র বাস্তবায়নের স্থায়ী পদক্ষেপ। আমাদের দেশের কিছু পোষ্য সাংবাদিক ও চেতনার ফেরিওয়ালা আছেন তারা হয়তো বগলবা‌জিয়ে বলবেন, না, না, তাতে তেমন দোষের কি আছে! তা তো অতীতের ভারতের চিত্রই বটে। এখন আমাদের সমাজে ভণ্ডামী ও ভাড়ামীর সংখ্যাটাই অ‌ধিক।

অখণ্ড ভারতের মানচিত্র কখনো এমনটা ছিলো না। বিষ্ণু পুরানে রয়েছে, “উত্তং যৎ সমুদ্রস্য, হিমশ্ব হিমাদ্রেশ্চৈব”, “বর্ষতদ্ ভারতংনাম ভারতী যত্র সংততি”। মহাসাগরের (বর্তমান ভারত সাগর) উত্তরের ভূখণ্ড হিমালয়ের দক্ষিণের ভূখণ্ড ভারত নামে পরিচিত। বৈদিক যুগে পাঞ্জাব ও পশ্চিম উত্তর প্রদেশ আর্য রাজ্য ছিলো। প্রাচ্যকে অনার্য, মগদ ও বিদেহ রাজ্য বলা হত। পরবর্তিতে মধ্যদেশ ও প্রাচ্যের বদলে ব্রহ্মোত্তর ও আর্যাবর্ত নামে পরিচিত ছিলো।

আরো অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে যেমন বৌদ্ধ যুগে অম্বুদীপ বলা হতো। বিশেষ করে বাংলাদেশ ভারতবর্ষের মানচিত্রে কখনো ছিলো না।
মধ্যযুগে বাংলা একটি মুসলিম স্বধীন রাষ্ট্র ছিলো। যথাক্রমে রাজধানী ছিলো সোনারগাঁওয়ে ১৩৯০ থেকে ১৪১১, পাণ্ডুয়ায় ১৩০০ থেকে ১৪০০ এবং গৌড়ে ১৪০০-১৫০০ সাল পর্যন্ত। আসলে ১৮৯৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার বৃটিশ অধিকৃত সমগ্র অঞ্চলকে বৃটিশদের ভারতীয় সম্রাজ্য বলে চিহ্নিত করা হয়েছিলো।

দামুদর নরেন্দ্র মুদীবাবু ইতিহাসকে বিকৃত করে অযোধ্যার বাবরী মসজিদকে রামমন্দির বানিয়ে নেয়ার সফলতায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেছেন। বৃটিশ সম্রাজ্যের তৈরীকৃত গোলামী  মানচিত্রকে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র বলে চালিয়ে দিয়ে বাবরী মসজিদের মত পাশবর্তী রাষ্ট্রগুলোর স্বত্বাধিকারী হওয়ার চেষ্টা করছেন।

১৮৯৭ সালের বৃটিশের গোলামীর কালো অধ্যায়ে অঙ্কিত মানচিত্রের কল্পিত স্বপ্ন ভেঙ্গে দিয়ে, ১৯৪৭ সালে শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজুল হক, স্যার সলিমুল্লাহ, মওঃ ভাসানী, হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানরা স্বাধীন সার্বভৌম মানচিত্র তৈরী করেছিলেন। এখন ভারতীয় শকুনদের নির্লজ্জ আধিপত্যকে রুখে দেয়ার দায়ীত্ব আমাদের মহান নায়কদের উত্তরসূরী বাংলাদেশের ১৮ কোটি জনতার।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close