মুক্তচিন্তা

প্রসঙ্গ গাজীপুর নির্বাচন: প্রশাসনের একটু নিরপক্ষ ভূমিকার সুযোগে নৌকার প্রতি ভোটারের প্রচণ্ড ঘৃণার প্রতিফলন

|| আহমত কুতুব ||
লেখক: প্রাবন্ধিক, অনলাইন এক্টিভিস্ট।

বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধিনে সুষ্ঠু ও নিরপক্ষ নির্বাচন যে করা সম্ভব নয় তা ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।
গাজীপুর নির্বাচনে ভোট ডাকাতি না হওয়ার প্রধান দুইটি কারণ হচ্ছে —
(১) নির্বাচনের একদিন পূর্বে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা।
(২) এই নিষেধাজ্ঞায় কী ঘটতে যাচ্ছে তাঁর পরিস্কার ধারণা না থাকায় সরকার ও প্রশাসন সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলো আর এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন শেষ হয়ে যায়। দলীয় সিদ্ধান্ত বিলম্বিত হওয়ায় ভোট ডাকাতি সম্ভব হয়নি।

নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনার ও প্রশাসন নির্বাচনী এলাকায় লেভেল ফিল্ড তৈরী করেনি। বিরোধী প্রার্থীদের প্রচারে ব্যাপক বাঁধা ও প্রতিরোধ করা হয়েছে। এই বাঁধা ও প্র‌তিরোধের ধরণ দেখে মানুষের ধারাণা ছিলো শেষমেশ ভোট ডাকাতিই হবে এবং তাঁর প্রস্তুতিও প্রতিয়মান ছিলো।

জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামী মেয়র ছিলেন। ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রচণ্ড অত্যাচারি মেয়রের খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর এই  মিয়াদে সাধারণের কান্না বা চিৎকারের আওয়াজ সরকার দেখেও দেখেনি, শুনেও শুনেনি। সরকার তুলা দিয়ে কান বন্ধ করে রাখে ও দলীয় চশমা পড়ে অন্ধ হয়ে থাকে। দুর্নীতি-নির্যাতন-অপশাসন ও সাধারণের কোনো কথা শুনেও নাই, দেখেও নাই। ২০২১ সালে জাহাঙ্গির আলম শেখ মুজিবকে নিয়ে মন্তব্য করায় দলীয় আফিমের নেশা কেটে যায় ও তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অবশ্য পরে মুসলেকা দিয়ে দলে ফিরিয়ে আনা হয় । কিন্তু শেখ মুজিবকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যকারী ক্ষমাযোগ্য প্রাণী হতে পারে না, ফলশ্রুতিতে দলের প্রার্থীতা হারাতে হয়। দলে ফিরিয়ে নিলেও তিনি যে ক্ষমাযোগ্য প্রাণী নয়, মনোনয়ন না দিয়ে সে কথা বুঝিয়ে দেয়া হয় তাকে।
বেঁকে বসলেন জাহাঙ্গীর আলম। নিজেই প্রার্থীতা ঘোষণা করে বসলেন। আওয়ামী লীগের চরিত্র হচ্ছে সোনার ছেলেদের দিয়ে হত্যা, গুম, খুন ও লুঠতরাজ করিয়ে অপকর্মগুলো সযত্নে ফাইল বন্দী করে রাখা আর যখনই কেউ মেরুদণ্ড সোজা করার চেষ্টা করে তখনই ঘাড়টা মটকে দেয়া। জাহাঙ্গীর আলমের বেলায়ও সযত্নে রক্ষিত অপকর্মগুলো বিচারপতি এস কে সিনহার মতো সামনে এনে তাকে ধ্বংস করার কৌশল নেয় সরকার। কিন্তু জাহাঙ্গীর আলম তো আওয়ামী তৈরী অপরাজনীতির দুর্দান্ত দুষ্টু সৈনিক। তিনি বুঝে ফেলেন, দল তার রাজনৈতিক কেরিয়ার ধ্বংস করে দিবে তাই তিনি মা’কে নিয়ে বিকল্প পথে হাটেন। আওয়ামী লীগও অনেকটা সুস্থিরে ফুরফুরে মেজাজে মেনে নেয় এবং তারা মনে করে, রাজনীতি অনভিজ্ঞ বৃদ্ধা মহিলা, তাছাড়া জাহাঙ্গীর আলমের পাহাড়সমান দুর্নীতি ও নির্যাতন ভোটের মাঠে পাত্তা পাবে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে টের পায় অংকের সমীকরণ পাল্টে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ দেরীতে হলেও বুঝতে পারে, সাধারণ মানুষ জাহাঙ্গীর আলমের দুর্নীতি ও নির্যাতন থেকেও শতগুণ বেশি আওয়ামী লীগ ও নৌকাকে ঘৃণা করে। তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের হাতে তখন বিকল্প  দু’টি রাস্তা খোলা ছিলো। (১) প্রতিরোধ ও ভয় ভীতি দেখানো এবং (২) ভোট ডাকাতি। সে পথেই আওয়ামী লীগ হাট ছিলো। আক্রমন-গাড়ি ভাঙচুর, ত্রাস ও এজেন্টেদেরকে ভয় দেখিয়ে ভোট কেন্দ্র থেকে দুরে সরিয়ে নিরাপদ ডাকাতির জন্য ভোট কেন্দ্রকে প্রস্তুত করা হয়েছিলো।
অন্যদিকে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কথা আগে থেকে সরকারের জানা থাকলেও নির্বাচনের পূর্ব পর্যন্ত চেপে রাখার চেষ্টা করছিলো কিন্তু বেরসিক আমেরিকা গাজীপুর নির্বাচনের আগের দিন তা প্রকাশ করে দেয়, আর তার সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে নির্বাচনে। সাধারণ মানুষ টের পেয়ে যায় অন্তত ভোটের বাক্স ছিনতাই হবে না। কেন্দ্রগুলোতে এজেন্ট না থাকলেও সাধারণ মানুষ নিরবে নৌকার প্রতি ঘৃণা প্রকাশের সুযোগ হাতছাড়া করেনি।

গাজীপুরের ভোটাররা জানতো ভোটপ্রয়োগ না করলে নৌকা ও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হবে। আওয়ামী মুখে আজমত উল্লার গুনগান ও প্রশংসা সাধারণের মনে তার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা তৈরী করে। নিশ্চিত বলা যায় — আজমত উল্লাহ যদি সতন্ত্র পার্থী হতেন ও আওয়ামী লীগ থেকে কিছুটা দূরে থাকতেন তা হলে গাজীপুরে বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো, কেননা সাধারণ মানুষ মনে করে, আওয়ামী লীগে কোনো ভাল মানুষ বাস করে না। জাহাঙ্গীর আলমও ধোঁয়া তুলসী পাতা নয় কিন্তু ঐ যে কথায় আছে- আঘাত করতে না পারলেও থুতু ফেলে মনের ঘৃণা প্রকাশ করা যায়।

জাহাঙ্গীর আলমকে ভালবেসে মানুষ ভোট করেনি, সে সাধারণ মানুষের ভালবাসার পাত্রও নয়, সে যে দুষ্ট আওয়ামী চরিত্রের মানুষ এবং যে কোনো সময় পাল্টি দিবে তা যেনেও শুধু নৌকার প্রতি থু থু নিক্ষেপের জন্য ভোটাররা এই অনভিজ্ঞ বৃদ্ধা মহিলাকে সমর্থন করেছে। বাংলাদেশের বাকি নির্বাচন গাজীপুরের মত না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি কেননা ইতিমধ্যে সরকার তাঁর নির্বাচনী ছক তৈরী করে নিবে।

গাজীপুর নির্বাচন বাংলাদেশের ভোটারদের একটা চিত্র ফোটে ওঠেছে। প্রতিরোধ, ভাঙচুর, ভয়, ভীতিপূর্ণ নির্বাচন হলেও যদি শুধু মাত্র ভোট ডাকাতি ও রাতের আঁধারে বাক্স ভরে দেয়া না হয়, তা হলে বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে ভোটাররা নিরবে নিভৃতে গাজীপুরের ভোটারদের ম‌তো নৌকার প্রতি ঘৃণায় থু থু নিক্ষেপ করবে।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close