মুক্তচিন্তা

সরি! এটা আপনাদের তৈরি করা নরক

।। পিনাকী ভট্টাচার্য ।।

লেখক: অনলাইন এক্টিভিস্ট।

{সম্প্রতি বাংলাদেশের বিভিন্ন পূজা মণ্ডপ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলার ঘটনায় ফ্রান্স প্রবাসী পিনাকী  ভট্টাচার্য’র প্রায় আট মিনিটের একটি ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ভিডিওটির প্রথমে দেখা যায়, টিভিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক মহিলা দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলছেন, “আমার প্রথম পরিচয় আমি হিন্দু না, বাংলাদেশে নাগরিক। এই দেশে শুধু ধর্ম পরিচয়ের জন্য বছরে একটা উৎসব যেখানে আমরা সিদুর ফেলি, সেটা হলো না।এটা এই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, এটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অপমান। আমার প্রথম পরিচয় আমি এ দেশের নাগরিক, আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।” এই ভিডিওতে হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন মহিলার উপরের বক্তব্যের পর পিনাকী ভট্টাচার্যের বক্তব্য শুরু হয়। তার বক্তব্যটি নিচে দেয়া হলো: – সম্পাদক}

খুবই ইন্টারেস্টিং কথা বলেছেন এই হিন্দু ভদ্র মহিলা। দুটো ক্যাচ পয়েন্ট আছে এই বক্তব্যে। প্রথমটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। তিনি প্রশ্ন করেছেন, এটা কি বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ, এটা কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ? দুঃখজনক হলেও এর উত্তর হচ্ছে, এটাই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।

তিনি সম্ভবত ইতিহাস জানেন না। জানেন না, পাকিস্তান আমলে এ ভূখণ্ডে হিন্দুদের কোনো প্রতিমা ভাঙার ঘটনা ঘটেনি। হিন্দুদের প্রতিমা ভাঙার ঘটনা ঘটে প্রথম এই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে, খোদ ঢাকা শহরে দূর্গা পূজার দ্বিতীয় দিনে। শেখ মুজিবের কাছে হিন্দু সম্প্রদায় প্রতিমা ভাঙার বিচার চেয়েছিল। কোনো বিচার পায়নি হিন্দু সম্প্রদায়। কারণ যারা ভেঙেছিল, তারা ছিল আওয়ামী লীগ করা মানুষ। কেনো এটা ঘটেছিল?

বাঙালি জাতিবাদী রাজনীতির চরম উত্থানের সময় পরধর্মের প্রতি ঘৃণাবাচক হিংসা প্রকাশের মূল জাতিবাদী রাজনীতির অভ্যন্তরীণ ঘৃণার উপাদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই জাতিবাদী রাজনীতি তো ঘৃণা শেখায়। ভিন্নমতকে শক্র ভাবার শিক্ষা তো এখান থেকেই শুরু।

আপনার বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এমন একটা বাংলাদেশ, যেখানে হিন্দুদের মন্দির ভাঙা হয়, মুসলমানদের জাতীয় মসজিদে জুম্মাবারে ঢুকে গুলি করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হয়, সাওতালদের গ্রামে পুলিশ নিজের হাতে আগুন লাগিয়ে দেয়, পাহাড়িদের বাঙালি হয়ে যেতে বলা হয়, তারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করে অস্ত্র নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এ বাংলাদেশ গড়েছে তো আপনার বঙ্গবন্ধু।

এটা ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশে যে বাঙালি জাতিয়তাবাদীদের শাসন চলছে, সেই শাসকদের অংশ হিসেবে আপনারা, মানে হিন্দুরাও তো জাতীয় সংখ্যা গুরু। বাঙালি জাতির অংশ হিসেবে আপনার সম্প্রদায়গত অবস্থান তো নির্যাতিতের নয়। আজকে আপনি রাষ্ট্রের নাগারিক বলে নিজের সুরক্ষা দাবি করছেন, অথচ অবাক বিষয়, আপনারা নাগরিক হিসেবে নয়, বরং কিছুদিন আগে হিন্দু হয়ে আলাদা সুরক্ষার দাবি তুলেছিলেন। হিন্দু বৌদ্ধ খৃস্টান ঐক্য পরিষদ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাংলাদেশে হিন্দুদের জন্য আলাদা আসন দাবি করেছিল। বাংলাদেশে জাতীয় হিন্দু মহাজোট তো আরেক কাঠি সরেস, তারা স্পষ্টভাবে আলাদা নির্বাচনের ব্যবস্থা, পৃথক মন্ত্রণালয় এবং সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসনের দাবি জানিয়েছিল। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্বের বিরুদ্ধে হিন্দু মহাজোট নামে এই রাজনৈতিক দল বাংলাদেশকে প্রকাশ্যেই অখণ্ড ভারতের অংশ করার মিশন নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করছে বলে দাবি করেছে। কি ভয়ানক কথা!

আপনারা তো ঐতিহাসিকভাবে বর্তমান ফ্যাসিস্ট শাসক আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে কাজ করে আসছেন। এর প্রতিদান হিসেবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করেছে। কিছুদিন আগে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী এবং প্রো অ্যাকটিভিস্ট শাহরিয়ার কবীর, যাকে অনেকে মুরগি কবীর বলে ডাকে, ইনডিয়ার টেলিগ্রাফ খবরের কাগজে একটা সাক্ষাৎকারে বলেছেন, হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণের ফলে বাংলাদেশের হিন্দুরা ঘুরে দাড়িয়েছে। শাহরিয়ার কবীর মুখ ফসকে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অবস্থান সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে ফেলেছেন। হাসিনা হিন্দু সম্প্রদায়কে কিভাবে শক্তিশালী করেছেন সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, হাসিনার আমলে হিন্দুদের জন্য কংক্রিট জব অপরচুনিটি দেয়া হয়েছে, বিশেষ করে শিক্ষা এবং প্রশাসনে।

আপনার (সেই হিন্দু ভদ্র মহিলার উদ্দেশ্যে) দুর্ভাগ্যের জন্য তো এতোদিন মুসলমানদের দায়ী করে এসেছেন। এটা যে রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা, সে কথাটা এতোদিন বোঝেননি। আপনার সমস্যা যে, এটা নাগরিক অধিকারের সমস্যা, রাষ্ট্রের সমস্যা-—এটা এতোদিন পরে বুঝলেন। এ কথা তো আমরা অনেক দিন থেকে বলে আসছি। এই রাষ্ট্রকে হাসিনা যখন ক্রমাগত দুর্বল করেছে, ইনস্টিটিউশনগুলোকে একে একে ভেঙেছেন— সেটাকে আপনারা কেনো অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছেন। কেনো আপনারা বলতে পারেন না, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষকে ভোটের অধিকারহীন করে রেখে শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েম করেছে। কখনো একবার প্রতিবাদ করেছেন? করেননি।

বরং এটাকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ধরে নিয়ে উল্লসিত হয়েছেন। শত শত গুম, ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড হবার সময় নিশ্চুপ বসে থেকে এখন নাগরিক, রাষ্ট্র, নাগরিক অধিকার- এসব বলছেন। ২০১৩ সালের ৫ মে মাদ্রাসার ছাত্ররা এসেছিল ঢাকায় নবীর অপমানের প্রতিবাদ করতে। পাখির মতো গুলি করে মারা হয়েছিল কতোজনকে এখনও কেউ জানে না। ওরা নাগরিক ছিল না? ওদের রাষ্ট্র না?

ভারতের আগ্রাসী আঞ্চলিক রাজনীতির বিরুদ্ধে একবারও কি দাড়িয়েছেন? গুজরাটের কসাই মোদিকে স্বাগত জানাননি আপনারা? যারা মোদিকে ঠেকাতে গিয়ে  জীবন দিল, তাদের জন্য কখনো শোক প্রকাশ করেছেন? যে রাষ্ট্রে আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে দেয়, আপনি আপনার নেতা নির্বাচন করতে পারেন না, নির্ভয়ে চাইলে নেতাকে বদলাতে পারেন না কোনো অবস্থায়। আজকে কোন রাষ্ট্রের  কাছে আপনি নাগরিক অধিকার চাইছেন? সে রাষ্ট্র তো না্ই!

২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বর নৈশভোটের সাথে সাথে সেই রাষ্ট্রের মৃত্যু হয়েছে। মৃতের কোনো শক্তি থাকে না। তাই রাষ্ট্রের আপনাকে রক্ষার কোনো অধিকার এবং শক্তিও নেই। সেই রাষ্ট্রকে যারা বাচাতে গেছে কোনো শঙ্কা না করে তাদের আপনারাই বলেছেন পাকিস্তানের দালাল, স্বাধীনতা বিরোধী।

আর আওয়ামী লীগ আমলে যতোগুলো হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে তার সবগুলো করেছে আওয়ামী লীগের লোকেরা। আর ক্রমাগত দোষ দিয়ে গেছেন চিহিৃত সাম্প্রদায়িক শক্তির। এইবারও আওয়ামী লীগের লোকেরা কুমিল্লায় ঘটনা ঘটিয়েছে। এটা আমার কথা নয়, কুমিল্লার হিন্দু সম্প্রদায়ের কথা। কেনো আওয়ামী লীগের নাম মুখে নেন না? আপনাদের ভাসুর লাগে? উল্টো কেনো অন্যের ওপর দোষ চাপান?

আজ আপনি কাঁদতে কাঁদতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলছেন। আপনি লিখে রাখেন, আপনার কন্যাও একদিন কাঁদতে কাঁদতে শেখ হাসিনার আদর্শের গল্প শোনাবে। এই রাষ্ট্রই তো চেয়েছেন? সে রাষ্ট্র নামের আমরি রাজত্ব পেয়েছেন। এই নরক বানানোর কাজে আপনারাই তো সবচেয়ে উৎসাহী হাত  লাগিয়েছেন। তবে কেনো আজ এই নরককে পছন্দ করছেন না? নগর পুড়লে দেবালয়ও বাঁচে না। বাংলাদেশ নামের যেই রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে হত্যা করা হয়েছে, সেই গলিত রাষ্ট্রের দুর্গন্ধের ওপর আপনাদের নিত্যদিন কাটবে।

সরি! এটা আপনাদেরই তৈরি করা নরক। এটা আপনাদের প্রাপ্য ছিল।
প‍্যারিস: ২০ অক্টোবর, ২০২১

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close