নিউজ

ফুটবলে স্বপ্নভঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের অনলাইনে আক্রমণ, বর্ণবাদী আচরণে ক্ষোভ, নিন্দা

ফুটবল গেইমে বর্ণবাদীদের আজীবন নিষিদ্ধের পিটিশনে মিলিয়ন মানুষের স্বাক্ষর, রাশফোর্ডের ম্যুরালস্থলে বিপুলমানুষের বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিবাদ

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ১৫ জুলাই : ইউরো ২০২০-এর ফাইনালে ইতালির কাছে পরাজয়ের পর ইংল্যাণ্ড ফুটবল দলের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা অনলাইনে চরম বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এসব বর্ণবাদী অবমাননার নিন্দা জানিয়েছেন দলটির ম্যানেজার গ্যারেথ সাউথগ্যাট থেকে শুরু রাজপরিবারের সদস্য ও রাজনীতিবিদসহ অসংখ্য মানুষ।

গত ১১ জুলাই, রোববার ওয়েম্বলিতে ইতালির বিরুদ্ধে পেনাল্টি শুট আউটে মার্কাস রাশফোর্ড (২৩), জ্যাডন সানচো (২১) ও বুকায়া সাকা (১৯) গোল করতে ব্যর্থ হওয়ায় এসব বর্ণবাদী হয়রানির টার্গেটে পরিণত হন। ১-১ গোলে খেলা শেষ হওয়ার পর খেলাটি পেনাল্টিতে গড়ায়।
ফুটবলকে কেন্দ্র করে পুরনো ব্রিটিশ বর্ণবাদী আচরণ আবারও মাথাছাড়া দিয়ে ওঠায় সর্বত্র ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় বইছে। মিলিয়ন মানুষ স্বাক্ষরকৃত অনলাইন পিটিশনে এসব বর্ণবাদীদের সবধরণের ফুটবল গেইম থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করার দাবী ওঠেছে। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও এই দাবী বাস্তবায়নে আশ্বাস প্রদান করেছেন। কিন্তু তাঁর দ্বিমুখী আচরণও সমালোচিত হয়েছে। এর আগে তিনি খেলোয়াড়দের ‘নী’ প্রদান বা হাঁটু গেড়ে ব্ল্যাকলাইভ মেটার্সের প্রতি সমর্থন জানানোর সময় কিছু সমর্থকদের ‘বু’ বলে অবজ্ঞাসূচক ধ্বনির প্রতিবাদ করতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তাছাড়া বরিস জনসনেরও বিভিন্ন সময় ব্ল্যাক ও মুসলিম জনগোষ্ঠির প্রতি অবজ্ঞাসূচক মন্তব্যের ইতিহাস রয়েছে।
বর্ণবাদী আপত্তিকর মন্তব্যের ঘটনায় পুলিশ একটি তদন্ত শুরু করেছে এবং দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। যদিও অনেক সমালোচক এমন ঘটনার জন্য কয়েকজন মন্ত্রীর ভ-ামিকে দায়ী করছেন। কারণ টুর্নামেন্টে চলাকালে খেলোয়াড় বড় ধরনের একটি বর্ণবাদবিরোধী অবস্থানকে তারা সমর্থন জানাননি।

ইংল্যাণ্ড দলের ম্যানেজার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কয়েকজনের জন্য এগুলো ভুলে যাওয়ার মতো না। কিছু কিছু মন্তব্য বিদেশ থেকে করা হয়েছে বলে আমাদের জানানো হয়েছে। কিন্তু এগুলোর কয়েকটি এই দেশ থেকেই করা হয়েছে।
বর্ণবাদবিরোধী অবস্থানের জন্য প্রশংসা কুড়িয়েছে ইংল্যাণ্ডের ফুটবল দল। অনেক খেলোয়াড় বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়েও প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিভিন্ন বর্ণের লোকজন নিয়ে গড়া দলটিকে আধুনিক বৃটেনের আরও বেশী বৈচিত্রের প্রতিফলন হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের পর মার্কিন ফুটবলার কলিন কায়েপারনিককে অনুসরণ করে প্রত্যেক ম্যাচের আগে হাঁটু গেড়ে বর্ণবাদ ইস্যুকে তুলে ধরেছেন ইংল্যা-ের খেলোয়াড়রা। বর্ণবাদ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংহতির প্রদর্শন হিসেবে তারা এটি করতেন।
তবে কিছু সমর্থক এমন অবস্থানের সময় ‘বু’ অবজ্ঞাসূচক চিৎকার করেছেন। তবে বিপরীতে কয়েকজন সমালোচকও এই ঘটনাকে খেলাকে রাজনীতিকরণ ও চরম বাম রাজনীতির প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ বলে উল্লেখ করেছেন।

ফুটবল গেইমে বর্ণবাদীদের আজীবন নিষিদ্ধের পিটিশনে মিলিয়ন মানুষের স্বাক্ষর:
ফুটবল গেমস থেকে বর্ণবাদীদের আজীবন নিষেধাজ্ঞা প্রদানের দাবীতে করা একটি পিটিশনে এক মিলিয়নের বেশী মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। আর এর মধ্যে দিয়ে এটি এখন পর্যন্ত সর্বাধিক স্বাক্ষরিত একটি অনলাইন আবেদনের পরিণত হয়েছে।
রবিবার ইংল্যাণ্ডের ইউরো ২০২০ এর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর ফুটবলার মার্কস রাশফোর্ড, জ্যাডন সানচো এবং বুকায়ো সাকাকে উদ্দেশ্য করে সামাজিক যেগাযোগ মাধ্যমে বর্ণবাদী সামাজিক পোস্টের প্রতিক্রিয়ায় বুধবার সকালে এই মাইলফলকটি অতিক্রম করেছে।
পিটিশনে ইংল্যাণ্ডের সমস্ত ম্যাচ থেকে বর্ণবাদী আচরণকারীদের আজীবন নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের সাথে কাজ করতে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

রাশফোর্ডের ম্যুরালস্থলে বিপুলমানুষের বর্ণবাদ বিরোধী প্রতিবাদ:
ইউরো ফাইনালে হারের পর ইংল্যাণ্ডের কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলাররা বর্ণবাদী মন্তব্যের শিকার। তার কড়া জবাব দিয়েছেন রাশফোর্ড। বর্ণবাদীরা তার ম্যুরালেও আক্রমণ করেছে। তবে রাশফোর্ডের ম্যুরালের বর্ণবাদী মন্তব্য ঢেকে দিয়েছেন স্থানীয় মানুষরা।
বর্ণবাদীদের মন্তব্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন মার্কাস রাশফোর্ড। তিনিও সামাজিক মাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, ‘আমার পারফরমেন্স নিয়ে সমালোচনা হোক, আমি পেনাল্টি ভাল করে মারতে পারিনি, আমার গোল করা উচিত ছিল। সেই সমালোচনা আমি মেনে নিতে পারি। কিন্তু আমি কে, কোথা থেকে এসেছি, তার জন্য কিছুতেই ক্ষমা চাইব না।’
তিনি লিখেছেন, ‘আমি মার্কাস রাশফোর্ড, বয়স ২৩ বছর, কৃষ্ণাঙ্গ, দক্ষিণ ম্যানচেস্টারের উইদেনশ-র উইদিংটনের বাসিন্দা। আমার যদি আর কিছু না থাকে, আমার অন্তত এইটুকু আছে।’ বর্ণবাদী মন্তব্য যে তাকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে, এই প্রতিক্রিয়া থেকে তা স্পষ্ট।

রাশফোর্ড পেনাল্টি মিস করার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি বরাবরই পেনাল্টি নেয়ার সময় আত্মবিশ্বাসী থাকি। কিন্তু ফাইনালে আমার সেই আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। জানি, আমি দেশকে হতাশ করেছি। নিজের অনুভূতি প্রকাশের কোনো ভাষা আমার নেই। আমি কেবলমাত্র ক্ষমা চাইতে পারি।’
প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে না পারার জন্য ক্ষমা চাইলেও বর্ণবাদ নিয়ে কোনোরকম আপস করতে রাজি নন তিনি। রাশফোর্ড বলেছেন, উইদিংটনের প্রতিক্রিয়া দেখে আমার চোখে জল চলে এসেছে। এখানেই নিজের ম্যুরাল বিকৃত করার কথা বলেছেন তিনি। তবে বর্ণবাদীরা এই কাজ করলেও স্থানীয় মানুষের একাংশ যত্ন করে সেই কদর্যতা ঢেকে দিয়েছেন প্ল্যাকার্ড আর ভালোবাসার চিহ্ন দিয়ে।

এছাড়া, রাশফোর্ডের উপস্থিতিতে শত শত মানুষের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর জন্মশহরে স্থাপিত ম্যুরালের সামনে। উল্লেখ্য, টাইব্রেকারে পেনান্টি শ্যূটর শেষ কিকে এসে ইংল্যা-বাসী জানলো এবারও শিরোপা জয়ের স্বাধ অধরাই থাকছে তাদের। দীর্ঘ ৫৫ বছর পর বড় কোনো আয়োজনের ফাইনাল খেলেই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাদের।
এবারের ইউরো কাপে ফাইনাল খেলা ইংল্যাণ্ডের জন্য যেমন বিশাল এক অর্জনের ঘটনা। তেমনি এ অর্জনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবে আরও এক সাগর দুঃখবোধ। আবারও পেনান্টিতে হেরে যাওয়া। আবারও অল্পের জন্য শিরোনা হাতছাড়া হওয়ার দুঃখবোধ।
পেনান্টি শ্যূট ৩-২ গোলের ব্যবধানে ইউরো কাপ জিতে নিয়েছে ইতালি। ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে ফুটবলে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের আসর ইউরো কাপ অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০২১ সালে এসে অনুষ্ঠিত হলো সেই টূর্ণামেন্ট।
দীর্ঘ ৫৫ বছর পর এই টূর্ণামেন্ট ইংল্যাণ্ড দল দুর্দান্ত খেলে ফাইনালে উঠতে সক্ষম হয়। ফলে এই ফাইনাল নিয়ে ইংল্যাণ্ডবাসীর উচ্ছাস ছিলো ভিন্ন মাত্রার। ১১ জুলাই, রোববার স্থানীয় সময় রাত ৮টা থেকে খেলা শুরু হলেও ইংলিশ ফুটবল প্রেমীদের উন্মাদনা শুরু হয়ে যায় সকাল থেকেই। ভোর ৬টা থেকেই শত শত ফুটবলপ্রেমী পছন্দেও ভেন্যুতে খেলা দেখার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। ওলস্টার স্কয়ার, ট্রাফালগার স্কয়ারসহ ল-নের বিশেষ বিশেষ স্থানগুলোতে হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী জড়ো হয়। দিনভর চলে বাঁধভাঙ্গা উদযাপন। তাই শেষ মূহূর্তে হেরে যাওয়ার পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়াও হয়েছে অনেকটা অপ্রত্যাশিত। ইতালির সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বর্ণবাদী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন পেনালটি মিস করা তিন ইংলিশ ফটবলার-রাশফোর্ড, সিনজো এবং সাকা।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close