নিউজ

সাংবিধানিক ক্যু

চারটি কারণে হাসিনা সরকার সম্পূর্ণ অবৈধ

সুরমা প্রতিবেদন।।
লন্ডন, ৪ অক্টোবর; নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা যে কথাটি স্পষ্ট ভাবে বলতে পারছেন না, সেটা হচ্ছে- শেখ হাসিনার সরকার সাংবিধানিকভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ। অন্তত চারটি কারণে শেখ হাসিনার সরকার সাংবিধানিকভাবে অবৈধ ও তার গত ১০ বছরের শাসন আইনগতভাবে সম্পূর্ণ অবৈধ (VOID) বলে বিবেচিত। এভাবে বেআইনি শাসন বা কর্মকাণ্ড ফৌজদারী কার্যবিধি অনুসারে দণ্ডনীয় অপরাধ। বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনেক দেশেই এসব অপরাধে শাস্তির দৃষ্টান্ত রয়েছে।

সামরিক ক্যুদেতা শব্দটি ঘুরেফিরে আলোচিত হলেও সাংবিধানিক ক্যুদেতা আলোচনার আড়ালেই থেকে গেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ২০১১ সালে এটা ছিল দ্বিতীয় সাংবিধানিক ক্যুদেতা। প্রথম সাংবিধানিক ক্যুদেতা ঘটে ৭৫ এর চতুর্দশ সংশোধনী। প্রথমটিতে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ভেঙে ও পরেরবার সুপ্রিম কোর্টের বাধ্যতামূলক নির্দেশনা পাস কাটিয়ে কৌশলে দলীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা ও তার সাংবিধানিক বৈধতা লাভের চেষ্টা করা হয়েছে।

যে চারটি কারণে শেখ হাসিনা ও তার সরকার সরকার সাংবিধানিক বৈধতার সীমা অতিক্রম করেছে, তা হলো:
এক। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে সংবিধান সংশোধন।
দুই। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপব্যাখ্যা ও শপথ ভঙ্গ করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা।
তিন। সংবিধানে পরিবর্তন এনে পরবর্তী সংসদের হাত পা বেধে দেয়া।
চার। সর্বোপরি সংবিধান থেকে অবৈধভাবে গণভোটের বিধান তুলে দিয়ে প্রজাতন্ত্রকে একনায়কতন্ত্রে রূপান্তর।

তিনি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ত্রয়োদশ সংশোধনী সংক্রান্ত মামলায় সংক্ষিপ্ত আদেশ (রায়) অমান্য ও বিকৃত করেছেন। সংসদীয় কমিটিকে দেওয়া নিজের বক্তব্যের সঙ্গে নির্বাহী প্রধান হিসেবে সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষজ্ঞদের ভাষায়, ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে সরকার প্রধান প্রতারণার আশ্রয় নেন।

সংক্ষিপ্ত রায়ে যা বলা হয়েছিল:

আপিল বিভাগের ২০১১ সালের ১০ মে প্রদত্ত আদেশে বলা হয়েছে, ‘সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী প্রসপেক্টেভলি (বা ভবিষ্যতের জন্য) বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হলো। যা সাধারণত আইনসিদ্ধ নয়, প্রয়োজন তাকে আইনসিদ্ধ করে, জনগণের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তাই সর্বোচ্চ আইন—এ সকল সনাতন তত্ত্বের ভিত্তিতে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন পূর্বে উল্লেখিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে সংসদ ইচ্ছা করলে এরই মধ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারকদের বাদ দিয়ে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে পারে।’

সংসদীয় কমিটি ও শেখ হাসিনার ডিগবাজি :

আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে সরকার ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ১৫ সদস্যের একটি বিশেষ সংসদীয় কমিটি গঠন করে, যার ১২ জনই ছিলেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতা। কমিটির প্রধান ছিলেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও সচিব ছিলেন বাবু সুরন্জিত সেনগুপ্ত। কমিটি একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, রাজনৈতিক নেতা, সম্পাদক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ মোট ১০৪ জনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রেখেই ২০১১ সালের ২৯ মে সংবিধান সংশোধনের সর্বসম্মত প্রস্তাব করে। পরের দিন কমিটি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে এ সুপারিশ বদলে যায়। 
যেখানে সংসদীয় কমিটি সর্বসম্মতভাবে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রেখেই সুপারিশ করে সেখানে একদিন পর ৩১ মে প্রধানমন্ত্রী একটি সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে এবং পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে, এ ব্যবস্থার অধীনে পরবর্তী দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংসদের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে (প্রথম আলো, ১ জুন ২০১১)। তার এই একটি ডিগবাজি দেশকে দীর্ঘমেয়াদী সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকটে ঠেলে দেয়, যে সম্পর্কে রায়ে আগাম সতর্ক (জনগণের নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার আশংকা) করা হয়েছিলো।

সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র বক্তব্য: 

এ সম্পর্কে তৎকালীন আপীল বিভাগের বিচারপতি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) সাপ্তাহিক সুরমার উত্তর আমেরিকা বিশেষ প্রতিনিধি এম হুমায়ুন কবিরকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, , প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা। এটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বলা হয়েছে। কারণ সংক্ষিপ্ত আদেশে এটা খুবই স্পষ্ট পরবর্তী দুটি নির্বাচন বাদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হল। আর অনেকে এখানে “মে বি” শব্দ দুটোকে বাধ্যতামূলক নয় বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এটা সঠিক নয়। কারণ এই শব্দ দুটো এখানে মেন্ডেটরি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কারণ এটা অপারেটিভ পার্টের অংশ, আর এটা অনুসরণ না করা হলে কি পরিণতি হতে পারে সেই কনসিকোয়েন্স আদেশে উল্লেখ করা আছে।

সংবিধান এখন আ’লীগের দলীয় ইশতেহার- খালেদা জিয়া

এবিষয়ে বিশেষ সংসদীয় কমিটিতে সংসদের বিরোধী দল বিএনপি প্রতিনিধি দেওয়া, এমনকি বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া কমিটিকে সাক্ষাৎকার প্রদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হলো পঞ্চদশ সংশোধনীর বিল পাশ করে। শেখ হাসিনা সরকার তার মহাজোটের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার ব্যবহার করে বিলটি পাশ করেন। এতে সংক্ষুব্দ হয়ে বিলটি পাশের পরে বেগম খালেদা জিয়া (২০১১ সালের ৩০ জুন) সংসদে বলেছিলেন, এই সংবিধান আমি ছুঁড়ে ফেলবো, কারণ এই সংবিধান এখন আওয়ামীলীগের দলীয় ইশতেহার।
এই বক্তব্যের কারণে সরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলে ও তার বিচারের হুমকি দেয়।

সুজন সম্পাদকের বক্তব্য:
নির্বাচন ও মানবিক অধিকার নিয়ে বাংলাদেশে নেতৃস্থানীয় বেসরকারী সংস্থা সুশানের জন্য নাগরিক সুজন। সংগঠিনটির সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম থেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট কথা বলছিলেন এবং নিবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক নির্মমতা, নৃশংসতা, ডামাডোল, নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম আর ক্ষমতাশালী মহল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিতর্ক আড়ালেই থেকে গেছে। সম্ভবতঃ তাঁর এই ভূমিকার কারণেই ৪ আগস্ট ২০১৮ ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শিয়া বার্নিকাট মি. মজুমদারের বাড়ি থেকে ফেরার পথে প্রাণঘাতী হামলার স্বীকার হন।   
সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার সুরমাকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের সংক্ষিপ্ত আদেশ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে আদালত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সংসদের সম্মতির শর্ত দেননি। বরং আদালত তার সংক্ষিপ্ত আদেশে ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা এবং জনগণ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সম্মতি দিয়েছেন। অর্থাৎ আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।
নানা বিজ্ঞজনের পর্যালোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ অমান্য করেই পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছে, অর্থাৎ এটি হলো অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধন। এটি অসাংবিধানিক সংবিধান সংশোধনী হওয়ার আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর সুবাদে গণভোট অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক হলেও পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের সময়ে তা করা হয়নি। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭খ অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অনুচ্ছেদ অসংশোধনযোগ্য করা হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করে সংবিধান সংশোধন করা সংসদ সদস্যদের সাংবিধানিক অধিকার, যা খর্ব করা যায় না, অর্থাৎ এক সংসদ ভবিষ্যৎ সংসদের হাত-পা বেঁধে দিতে পারে না।
সাংবিধানিক অপরাধ ও তার পরিণতি:
প্রশ্ন হচ্ছে, সুপ্রিম কোর্টের আদেশ উদ্দেশ্য মূলক ভাবে অপব্যাখ্যা অথবা অমান্য করে ক্ষমতা চিরস্থায়ী  করা হলো। এর মাধ্যমে সংবিধান অনুসারে প্রতিকার বা সাংবিধানিক পরিণতি কি? কারণ এরফলে নবম ও দশম নির্বাচন হলো তত্ত্বাবধায়কের বদলে ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে। দশ বছরে সরকারকে অসংখ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যকর করতে হয়েছে।
সুপ্রীম কোর্টের রায় বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের অপর দুই বিভাগ (সংসদ ও নির্বাহী বিভাগ) সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। এর অন্যথা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসম্পর্কে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী নির্বাচন অবৈধ। তার মানে হচ্ছে দশম ও একাদশ নির্বাচন অবৈধ। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার অবৈধ, তাদের সকল কার্যক্রমও অবৈধ। তবে এইভাবে সংসদ, সরকার ও তাদের কার্যক্রম যে অবৈধ হলো, তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবে কোর্ট। যারা সুপ্রিম কোর্টের রায় অমান্য করেছে এবং সংবিধান অবমাননা করেছে, তাদের ব্যাপারে কোর্টের বাংলাদেশ এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতীতে অনেক সিদ্ধান্ত (নজির) রয়েছে।

খায়রুল হকের কর্ম-অপকর্ম:

খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির আসনে বসে যে সংক্ষিপ্ত আদেশ (রায়) দেন, অবসরে গিয়ে প্রায় দেড় বছর পর পূর্ণাঙ্গ রায় দেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি পরবর্তী দুই নির্বাচন সম্পর্কে আগের নির্দেশনা বাদ দিয়ে দেন। পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে পাবার আগেই সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধন বিল পাশ করে। রায় পরিবর্তন, এবং অবসরে গিয়ে রায় প্রদানের বৈধতা নিয়ে তিনি প্রশ্নের মুখোমুখি, যে প্রশ্নের জবাব তিনি কখনো দেননি। এছাড়া সংক্ষিপ্ত আদেশ( রায়ের অপারেটিভ পার্ট) উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য বেআইনী বিল করে সরকার যে সাংবিধানিক অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছিল, সেটাও পূর্ণাঙ্গ রায় পাবার আগেই; এসব গুরুতর বেআইনী কার্যক্রমের বিষয়ে তাঁর নীরবতা জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। পুরস্কার হিসেবে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান পদ ও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বিপুল অংকের অর্থ গ্রহণের কারণে খায়রুল হক ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন। বাংলাদেশে গত এক দশকের রাজনৈতিক সংকটের অন্যতম প্রধান কারিগর হিসেবে তাঁকে চিহ্নিত করা হয়, পাবলিক ডোমেনের নানা আলোচনায়।      

বিচারপতি খায়রুল হককে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়েছিলো একজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে। তিনি আপিল দায়েরের প্রায় ছয় বছর পর ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করেন এবং অবসর গ্রহণের আট দিন আগে, মাত্র দশ দিনের শুনানির ভিত্তিতে বিভক্ত আদেশটি দেন। এমিকাস কিউরীদের মোটামুটি সর্বসম্মত (৮ জনের মধ্যে ৭জন) মতামতকেও তিনি উপেক্ষা করে আদালতে খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। 
এদিকে বিভক্ত আদেশটি সমর্থনকারী অন্য তিনজন বিচারপতিকেও পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি করা হয়, যার মধ্যে একজনকে আবার প্রধান বিচারপতি করা হয় আরেকজন বিচারপতিকে ডিঙ্গিয়ে। এর ফলে প্রধান বিচারপতি এবং সরকারের মধ্যে এক ধরনের যোগসাজশ ছিল বলে অনেকের মনে ধারণা জন্মে (অধ্যাপক রিদওয়ানুল হক, ‘পলিটিক্স অব আনকনস্টিটিউশনাল অ্যামেন্ডমেন্টস,’ ডিও আই: ১০)। বিচারপতি হকের সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রণয়নের ক্ষেত্রে আত্মস্বার্থ ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ আছে, কারণ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে তিনিই হতেন এর প্রধান উপদেষ্টা।

বিশিষ্টজনদের বক্তব্য-

সুজন সম্পাদক গত ২৮ আগস্ট  প্রথম আলোতে প্রকাশিত “তত্ত্বাবধায়ক সরকার–সম্পর্কিত রায় নিয়ে ‘বিভ্রান্তি’ শীর্ষক নিবন্ধে এই রায় ও পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট আইনজীবি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতামত রেফারেন্সসহ তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেন- প্রয়াত এম জহিরের মতে, ‘আগামী দশম ও একাদশ নির্বাচন হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। কিন্তু বিচারকদের না জড়ানোর জন্য সংসদ সংশোধনী আনতে পারবে বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে।’ (বাংলা নিউজ, ১০ মে ২০১১)। এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন–এর (২ জুন ২০১১) এক প্রতিবেদনে ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের উদ্ধৃতি দেওয়া হয়: ‘আগামীতে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে—এটি আপিল বিভাগের আদেশ, পর্যবেক্ষণ নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বেআইনি হলেও প্রয়োজন এটাকে আইনানুগ করেছে বলে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে…সরকার নিজেদের সুবিধার জন্য রায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশকে পর্যবেক্ষণ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে…বলছেন আগের অংশ জাজমেন্ট পরের অংশ জাজমেন্ট নয়…কেন এটা বলছেন বোধগম্য নয়…অবশ্য পলিটিক্স করতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয়। নিজে বিশ্বাস না করলেও অনেক সময় বলতে হয়।’

একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে সংবিধান-বিশেষজ্ঞ প্রয়াত মাহমুদুল ইসলামের তাঁর কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ গ্রন্থে বলেছেন, ‘একটি নিন্দিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আগামী দুই সংসদ নির্বাচনের জন্য জিইয়ে রেখে আপিল বিভাগ বিচারিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আইনসভার সংবিধান প্রদত্ত দায়িত্ব পালনের ওপর হস্তক্ষেপ করেছেন, যা সুপ্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক আইন শাস্ত্র, আইনের শাসন ও ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থী।’ এই বক্তব্যে তিনি ভবিষ্যতের জন্য বাতিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে পরবর্তী দুই নির্বাচনে ব্যবহারের আদালতের আদেশের সমালোচনা করেছেন।

এ ছাড়া সাবেক আইনমন্ত্রী প্রয়াত আবদুল মতিন খসরু সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ সংসদীয় কমিটির ২৪তম বৈঠকে সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করেন যে পরবর্তী দুই নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান হলো আদালতের আদেশ এবং বিচারপতিদের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে বাদ দেওয়া হলো পর্যবেক্ষণ। একই বৈঠকে কমিটির সদস্যসচিব এ কে মোহাম্মদ হোসেন বলেন, পরবর্তী দুই নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে জীবন্ত রাখা না হলে আদালত বিচারপতিদের বাদ দিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী সংশোধনের পর্যবেক্ষণ দিতেন না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, ‘তাহলে তো আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে হবে।’

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close