সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হায়দার খান নান্না’র অকাল মৃত্যু
- বিভিন্ন সংগঠনের শোক।
- সুরমা’য় দোয়া মাহফিল।
লণ্ডন, ১৩ আগস্ট: প্রাণবন্ত তরুণ, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ রিয়া হায়দার খান নান্না হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকস্মাৎ চলে গেলেন। গত ০৮ আগস্ট মঙ্গলবার তিনি কিছুটা অসুস্থ বোধ করেন। ০৯ আগস্ট, বুধবার সন্ধ্যায় মেসিভ হার্ট অ্যাটাক হলে চিকিৎসার জন্য তাঁকে অ্যাম্বুলেন্সে করে দ্রুত স্থানীয় নিউহাম জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই তিনি রাত আনুমানিক ১০টার দিকে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো মাত্র ৪৬ বছর।
গাজীপুরের কৃতি সন্তান মোহাম্মদ রিয়া হায়দার খান নান্না খুবই সজ্জন, বন্ধুবৎসল ও পরোপকারী মানুষ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত ছিলেন। নয় ভাই-বোনের পরিবারের মধ্যে এক ভাই যুক্তরাস্ট্রে আর তিনি নিজে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছিলেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি সিলেটে ছিলেন। সিলেটের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণের সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বাংলাদেশের ক্রীড়া অঙ্গণের সঙ্গেও তিনি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের হয়ে তিনি ফার্স্ট ডিভিশন ক্রিকেট লীগে খেলেছেন।
পরবর্তীতে বিলেতে এসেও তিনি কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বিলেতের অন্যতম প্রধান সাপ্তাহিক ‘সুরমা’র সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। দীর্ঘদিন তিনি ‘সুরমা‘র সাথে একনিষ্ঠভাবে জড়িত থেকে সাংবাদিক বন্ধুদের সার্বক্ষণিক সঙ্গ দিতেন ও ‘সুরমা‘কে সবরকমের সহযোগিতা করতেন।
শিল্প-সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও মিডিয়া বিষয়ে নিবেদিতপ্রাণ মোহাম্মদ রিয়া হায়দার খান নান্না‘র সাথে বিলেতের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মিডিয়াঙ্গনের অনেকেরই বন্ধুত্ব ছিলো। তাঁর সাথে অনেকেরই অনেক আগে থেকেই পরিচয় ও সখ্যতা ছিলো। রিয়া হায়দার খান নান্নার এই অকাল মৃত্যর খবর শোনে তাঁরা শোকাভিভূত হয়ে পড়েছেন। ‘লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব’ সভাপতি ও ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’ সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরী, ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ যুক্তরাজ্যে’র সদস্য সচিব কবি দিলু নাসের, ‘সাপ্তাহিক সুরমা’ সম্পাদক শামসুল আলম লিটন, ‘সাপ্তাহিক বাংলা পোস্ট’ সম্পাদক তারেক চৌধুরী, ‘সাপ্তাহিক দেশ’ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ, ‘জাসাস যুক্তরাজ্যে‘র সাবেক সভাপতি এমাদুর রহমান এমাদ ও ‘দ্যা ইউনাইটেড বেঙ্গল মুভমেন্ট’ এর আহবায়ক হাসনাত আরিয়ান খানসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও ক্রীড়া সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেছেন।
সুরমা পরিবারের ঘনিষ্ঠ প্রিয়জন ও সহযোগী ব্যক্তিত্ব রিয়া হায়দার খান নান্নার অকাল মৃত্যুতে সুরমা পরিবারের সদস্যরা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোকাভিভূত সুরমা’র প্রধান সম্পাদক ফরীদ আহমেদ রেজা চোখের জলে ভেসে মরহুমের জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘আল্লাহ আমাদের মাফ করুন এবং তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। তাঁর স্বজনদের ধৈর্য ধরার তাওফিক দিন, আমাদের সবাইকে নিজেদের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের তাওফিক। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।’
সুরমা’র ইংরেজি সেকশনের এডিটর সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।
সুরমা’র স্পেশাল কন্ট্রিবিউটর ডরিনা লাইজু লিখেছেন, ‘গত পরশুদিন ভাইয়ের সাথে দেখা হলো, কথা হলো, এটা কিভাবে মেনে নেয়া যায়!’
সুরমা’র বার্তা সম্পাদক কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ লিখেছেন, ‘নান্না ভাইয়ের নিথর বডি দেখার পরও ভাবছিলাম ডাক্তার হয়তো বলবেন খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থায় রয়েছেন তিনি। কারণ তখনও মুখে নল লাগানো ছিলো। লিটন ভাই, ময়েজ ভাই ও আমি ডাক্তারের জবানীতে অবিশ্বাস্য বিষয়টি শোনার পর একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম মাত্র। কারণ এতক্ষণে সবকিছু ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এম্বুলেন্সে তুলে হসপিটাল পর্যন্ত তারা কী কী করেছেন বলে সবশেষে অনেকটা অস্ফুটে ডাক্তার “সরি” বলে যা বললেন তা আমাদের কান পুরোপুরি নিতে পারেনি। কিন্তু আমরা বুঝে যাই হতভাগা নান্না ভাই অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন! গুরুতর অবস্থায় নান্না ভাইকে বার্থ হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শুনে আমরা প্রথমে সেখানে ছুটে যাই এবং অপেক্ষা করতে থাকি। কিন্তু অবস্থা এতই খারাপ ছিলো যে এম্বুলেন্স ক্রুরা সেদিকে না গিয়ে পাশের নিউহ্যাম হসপিটালে যেতে বাধ্য হয় এবং তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে নান্না ভাই মা’বুদের দরবারে চলে যান। অবশেষে বার্থ হসপিটালের রিসিপশনে থাকা নাইট ম্যানেজার আমাদের কাছ থেকে বিবরণ শুনে আমাদের বসতে দিয়ে অনেক ঘেঁটেঘুটে সন্ধান বের করে আমাদের নিউহ্যাম হসপিটালে যেতে বলেন। সেখানে নান্না ভাইর বডি দেখে তাদের নিশ্চিত করি যে আমরা যাকে খুঁজছি তিনিই সেই ব্যক্তি। ধারণা করা হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু ডাক্তার এটাকে আনএস্পেক্টেড ডেথ উল্লেখ করে করনার রিপোর্টের আগে মৃত্যুর নির্দিষ্ট কোনো কারণ বলতে চাননি। আমাদের এমন একজন ভ্রাতৃপ্রতিম প্রাণজ বন্ধুকে হারিয়ে আমরা সত্যি শোকাভিভূত। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন এবং আমাদের প্রিয় নান্না ভাইকে জান্নাত নসীব করুন।’
বিস্মিত সুরমা’র ক্রীড়া সম্পাদক কবি শরীফুজ্জামান লিখেছেন, ‘হাসিখুশি একজন মানুষ এভাবে নিরবে চলে গেলেন। অবাক লাগছে!’
শোকাভিভূত কবি আহমেদ ময়েজ তাঁকে উৎসর্গ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘দীর্ঘশ্বাসে আমাদের পিঠ ঠেকে আছে’ শিরোনামে মর্মস্পর্শী কবিতা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘প্রিয় এম আর খান: শবদেহের কাছে পঙক্তিগুলো অর্থহীন জেনেও প্রশ্বাসে তার বিস্তারণ হয়।’
‘দীর্ঘশ্বাসে আমাদের পিঠ ঠেকে আছে’
মানুষের মন ছুয়ে যাওয়া এমন কাজ করেছিলে বলে
সবার বিষন্ন মুখ আজ জড়ো হচ্ছে নতুন পারদে
কষ্টগুলো সঞ্চারণ হয়ে হেঁটে যাচ্ছে পথ থেকে পথে, দেশ ছেড়ে দেশান্তরে।
জানি তোমার জীবনে কোনো বিশেষণ নেই
অথচ এমন এক বিশেষত্বে আবৃত ছিলো সরল মুখ
কোনো বৈভব-ঐশ্বর্য থেকে কম ছিলো এমন বলা যাবে না
আমাদের ভালোবাসা জীবন্ত কবর দিয়ে
শবদেহ গোর থেকে হেসে ওঠে
নিজের ভাবনা কতো অসহায়, কতো অর্থহীন
দুনিয়াদারীর মোহে নিরন্তর হিসাব কষি এইতো জীবন, এইতো …
আমাদের পিঠ ঠেকে আছে এক দীর্ঘশ্বাসে।
লেখক ও গবেষক ফারুক আহমেদ সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘আমি বাকরুদ্ধ। নান্না ভাই, আল্লাহতালা তোমাকে জান্নাতবাসী করুক।’
প্রাবন্ধিক আহমেদ কুতুব লিখেছেন, ‘আদর-আপ্যায়ন শ্রদ্ধায় বিনম্র নান্না ভাইকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা জান্নাতে উঁচু মাকামের মেহমান করুন।’
কবি হিলাল সাইফ লিখেছেন, ‘নান্না ভাই, এভাবে চলে গেলেন! চলে যেতেই হলো? সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। জানি, আমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কিছু যায় আসে না। আপনি বড় ভালো মানুষ ছিলেন। সহজেই যে কাউকে আপন করে নেবার অসামান্য ক্ষমতা ছিলো আপনার, যা সবার থাকেনা। আপনার আত্মাটাও অনেক বড় ছিলো। নিশ্চয়ই মহান আল্লাহপাক আপনাকে জান্নাতের অনেক বড় জায়গায় স্থান করে দেবেন। মনটা গভীর শোকে ভারাক্রান্ত হলো! আপনার হাসিমাখা মুখ, কথার ফুলঝুড়ি আর বারেবারে এটাসেটা খাবার অনুনয় বিনয় খুব মিস করবো। আমি গভীর শোকাহত। আর কিছু বলতে পরছি না…একজন ভালো মানুষের প্রস্থান হলো। মহান আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতে ভালো রাখুন।
এছাড়া তাঁর সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব ও শুভাকাঙ্খীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের শোক প্রকাশ করেছেন।
সুরমা’য় দোয়া মাহফিল
মোহাম্মদ রিয়া হায়দার খান নান্না’র অকাল মৃত্যুতে শোকাভিভূত সুরমা পরিবার গত ১১ আগস্ট শুক্রবার বিকাল ৫ টায় মরহুমের স্বরণে ও তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সুরমা অফিসে তাৎক্ষণিকভাবে এক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেন। এতে মরহুমের বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্খীরাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। তাঁরা মরহুমের সাথে তাদের স্মৃতিচারণ করেন ও মরহুমের বিভিন্ন গুণাবলী তুলে ধরেন। সবশেষে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে সবাই দোয়া করেন। বিশিষ্ট কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও আলেমে দ্বীন প্রফেসর আবদুল কাদির সালেহ মোনাজাত পরিচালনা করেন।
উল্লেখ্য, হাসপাতালের সকল আনুষ্ঠানিকতা ও লণ্ডনে প্রথম জানাযা শেষে পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী মরহুমের মরদেহ দেশে (গাজীপুরে) পাঠানো হবে। হাসপাতাল থেকে মরদেহ বুঝে পেলে জানাযার তারিখ সবাইকে জানিয়ে দেয়া হবে। সুরমা পরিবারের পক্ষ থেকে সম্পাদক শামসুল আলম লিটন মরহুমের মরদেহ গ্রহণ ও লণ্ডনে জানাযা শেষে দেশে বসবাসরত পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সকল দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।