নিউজ

ঢাকা-১৭ উপ নির্বাচন: জাতীয় নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সাল করে নিলো আওয়ামী লীগ

  • প্রতিপক্ষ প্রার্থীর উপর হামলা।
  • কেন্দ্রে এজেন্ট ঢুকতে না দেয়া।
  • ভোট কেন্দ্রে ঢুকে নৌকায় সিল।
  • পুলিশের দলীয় বাহিনীর ভূমিকা।

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।

লণ্ডন, ২০ জুলাই: ঢাকা–১৭ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশন একটা তামাশা করেছেন। দেশের সচেতন নাগরিকরা এটাকে আওয়ামী লীগের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ড্রেস রিহার্সাল বলে মনে করছেন। সেই পুরনো চিত্র। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন। ভোটকেন্দ্র শূন্য, ভোটকেন্দ্র খালি। নির্বাচন  কমিশন যেটা একেবারে পঙ্গু, অথর্ব, বশংবদ, দাসানুদাস তাদের অধীনে জাল ভোট দিয়েও মাত্র ১১ শতাংশ ভোট পড়েছে। কোথাও ভোটার নেই। নৌকার প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের যে কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন, ওই কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরুর পর সকাল ৯টা পর্যন্ত ভোটের হার ছিল শূন্য দশমিক ৬১ শতাংশ। দুপুর পৌনে ১২টায় তা দাঁড়ায় ৩ শতাংশে। বেলা দুইটার পর নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারীরা কেন্দ্রে প্রবেশে করেন। এরপর বেলা সোয়া তিনটায় দেখা যায়, সেখানে ভোট গ্রহণের হার বেড়ে ১০ শতাংশ হয়েছে। গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতরে আজ মোট পাঁচটি কেন্দ্রে ভোট হয়। এর মধ্যে ৬৩ নম্বর কেন্দ্রে ভোট দেন মোহাম্মদ এ আরাফাত‌। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৫৮৮ জন। সকাল ৮টায় ভোট শুরুর পর ৯টা পর্যন্ত সেখানে ভোট পড়ে মাত্র ১৬টি। দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত ভোট দেন ৮৩ জন। আর বেলা তিনটার দিকে এই সংখ্যা হয় ২৭৮। সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল থেকেই কেন্দ্রগুলোর সামনে কোনো লাইন নেই। যাঁরাই ভোট দিতে আসছেন, তাঁদের কোনো অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। নির্বিঘ্নে ভোট দিয়ে চলে যাচ্ছেন। আর নৌকার ব্যাজধারী যেসব ব্যক্তি সকাল থেকে গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা কেন্দ্রে প্রবেশ শুরু করেন বেলা দুইটার পর থেকে। তিন থেকে চারজনের দলে ভাগ হয়ে এসব ব্যাক্তি কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। ভোট দিয়ে তাঁরা ফিরে যান। কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে নৌকার কয়েকজন পোলিং এজেন্টকে ‘খাবার লাগবে’ বলে ফোন করতে দেখা যায়। পরে দুজন–তিনজন করে খাবার নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করেন। ওই ব্যক্তিদেরও ভোট দিতে দেখা গেছে। গুলশান থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফেরদৌস কবির ৬৩ নম্বর কেন্দ্রে দলটির প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন।‌ জাল ভোটের বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে ভোট গ্রহণ শেষে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরাফাত এ রহমান এই কেন্দ্রের ভোটার ছিলেন। তাই এই কেন্দ্র তাঁর জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। নৌকার ব্যাজধারী নেতা–কর্মীদের এই কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশের কারণে সেখানে অন্য চার কেন্দ্রের চেয়ে ভোট বেশি পড়েছে—সাংবাদিকদের এসব কথা শুনে মুচকি হেসে ফেরদৌস কবির বলেন, এটা কোথায় না হয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও তো এটা হয়। তবে নির্বাচন কমিশন থেকে সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণের কারণে তাঁরা পুরোপুরি নিজেদের মতো কাজ করতে পারেননি বলে জানান তিনি। কেন্দ্র থেকে ভোট দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রবীণ এক ভোটার বলেন, ‘ভেতরে তো সব নৌকার লোক। তাঁরা নিজেদের মতো করে যা করার তা–ই করছেন।’ নৌকার ব্যাজধারীদের জাল ভোট দেওয়ার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রটির প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র সাহা বলেন, ‘আমি খেয়াল করিনি।’ গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাকি চারটি কেন্দ্রের মধ্যে একটি কেন্দ্রে (৬৪ নম্বর) বেলা ৩টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ২৬০টি। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৫৮৯ জন। ভোটের হার ১০ শতাংশ। এই কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছিল ১৪৮টি। সকাল ৮টায় ভোট শুরুর পর ৯টা পর্যন্ত ভোট পড়ে ২০টি। গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেকটি কেন্দ্রের (৬৫ নম্বর) মোট ভোটার ছিলেন ২ হাজার ৫৩৯ জন। বেলা ৩টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন ১১৬ জন।‌ ভোটের হার ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। দুপুর ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রটিতে ভোট দিয়েছিলেন ৪৫ জন।‌ তখন ভোটের হার ছিল ২ শতাংশ। একই স্থানে অবস্থিত আরেকটি কেন্দ্রে (৬৬ নম্বর) বেলা ৩টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন ৯০ জন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ১২৯ জন।‌ ভোটের হার ছিল ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেকটি কেন্দ্রে (৬৭ নম্বর) বেলা ৩টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন ৯০ জন। এই কেন্দ্রে মোট ভোটার ৩ হাজার ৫৮ জন। ভোটের হার ২ ছিল ৯৪ শতাংশ। ‌গুলশান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের মোট ৫টি কেন্দ্রে ভোটার ১৩ হাজার ৯০৩ জন। বেলা তিনটা পর্যন্ত এই পাঁচটি কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন ৮৩৪ জন। ভোট গ্রহণের হার ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ।

এর মাঝে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে ফাতেমা খাতুন নামে একজন ভোটার বলছেন, আমার নাম হইছে ফাতেমা খাতুন। এখন আমারে কইছে আকলিমা কইতাম বলে। আকলিমা মনে থাকবো! পরে যদি আমি ভুইলা যাই। পরে আমি কী করমু? কনতো! তারা কয় ধরা খাইতেন না। তারা আপনারে কিছু জিগায় তো না। আরেক মহিলারে যাইতে কইছে, হে কয় আমি ৪ মিনিটে ৫০টা ভোট দিছি, আমি আর কত দিমু! এমনি দিছে কতক্ষণ পরে পরে। কেউ-ই বাধা দেয় নাই। আমি কইছি, তাও মানে না হেরা। আমারে জোরে পাঠাইছে, আমি তো এইগুলা বুঝি না। ভিডিওতে আরেকজন অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে দেখা যাচ্ছে ভোট দিতে যাচ্ছে। ভিডিওটি এ পর্যন্ত প্রায় দেড় মিলিয়ন মানুষ দেখেছেন। প্রায় ৫ হাজার জন দর্শক ভিডিওতে নেতিবাচক কমেন্ট করেছেন। আর নির্বাচন কমিশন বলছেন, ওই ১১ শতাংশ ভোটের মধ্যে নাকি শ্রেষ্ঠ নির্বাচন হয়েছে!

এদিকে আবার নৌকার প্রতিপক্ষ প্রার্থীর উপর হামলা চলাকালীন দর্শকের ভূমিকা নেয়া পুলিশ বলছেন, আমরা আমাদের কাজ করেছি। ঠিকই করেছি। ইনার কর্ডনের দায়িত্ব আমাদের। আউটার কর্ডনের দায়িত্ব আমাদের না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে, হিরো আলমকে একাধিক পুলিশ সদস্য নিরাপত্তা দেওয়ার মতো করে ধরে সামনে এগিয়ে গেলেন। পরে হামলাকারীরা একযোগে ছুটে এল এবং পুলিশ সদস্যরা সেখান থেকে সরে গেলেন। তখন হিরো আলমকে চড়-থাপ্পড়, লাথি দেওয়া শুরু হলো। সরে যাওয়া একজন পুলিশ সদস্যকে একজন সাংবাদিক যখন জিজ্ঞাসা করলেন, হিরো আলমের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে, আপনারা কী করছেন? তখন সেই পুলিশ সদস্য বললেন, ‘আমরা ইনার কর্ডনে। আউটার কর্ডনের বিষয় আমাদের না।’ এর আগে সকালে হিরো আলম তার এজেন্টদের বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেন। বনানী মডেল স্কুল কেন্দ্র পরিদর্শন গিয়ে একতারা প্রতীকের এই প্রার্থী বলেন, ‘যখনই বলতেছে একতারার লোক, হিরো আলমের লোক, তখনই কিন্তু বের করে দিতেছে। এই রকম করে এজেন্ট বের করে দেওয়ার মানে হইল, তারা একতরফা তাদের এজেন্ট দিয়ে সিল মারার চেষ্টা করতেছে।’ পুরো ঘটনা দেখে মনে হয় না, অতি উৎসাহী কর্মীদের নেহাত ‘হাতের সুখ’ নেওয়ার কারণে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাটি ঘটে গেছে। বরং এটিকে সম্পূর্ণ পরিকল্পিত বলেই দেশের সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন। এটি আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য পরিবেশ নিয়ে যে পূর্বাভাস দিচ্ছে তা হিরো আলমের কথাতে খানিকটা বোঝা যাবে। মার খাওয়ার পর হিরো আলম বলেছেন ‘এ রকম পরিবেশ হলে নির্বাচন করার দরকারই নেই’। তাঁর কথা শুনে দেশের সচেতন নাগরিকরা ভাবছেন, এই কথা কি শুধু হিরো আলমের কথা!

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close