নিউজবাংলাদেশহোম

সুইস ব্যাংক রহস্য

#পাঁচ অলিগার্ক ব্যবসায়ী গ্রুপ ওয়াচ লিষ্টে # সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা যারা সরিয়েছে # কেন তড়িঘড়ি করে তারা টাকা সরাচ্ছে? # শেখ হাসিনার সুইজারল্যান্ড সফর একই সময়ে # টাকা সরিয়ে তারা কোথায় রাখছে?

ওয়াশিংটনের ডিপ্লোম্যাট পত্রিকা বাংলাদেশী পাঁচ অলিগার্ক ব্যবসায়ী গ্রূপকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে নিষেধাজ্ঞার আশংকার কথা জানিয়েছে।

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।

লণ্ডন, ৭ জুলাই: বাংলাদেশে হাজার কোটি টাকা লেনদেন করতে পারে এমন কোম্পানির সংখ্যা হাতে গোনা দশটির বেশি হবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গণ মাধ্যম “ডিপ্লোমেট” এই প্রথম পাঁচ অলিগার্ক কোম্পানিকে চিহ্নিত করেছে, যারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের ক্ষমতার ভিত্তি এবং সম্পদ অবৈধ সম্পদ আয় ও ভাগ বাটোয়ারার সঙ্গে জড়িত। এই পাঁচ অলিগার্ক কোম্পানির কেউ কেউ দেশের সম্পদ বাইরে নিয়ে সিঙ্গাপুর সাইপ্রাস আমেরিকার কানাডা ইউরোপের কোন কোন দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। কোন কোন দেশে ধনীদের শীর্ষ তালিকায় তাদের অনেকেই স্থান করে নিয়েছে।

সুইস ব্যাংক সারা পৃথিবীতে এক রহস্য। বাংলাদেশিদের কাছে এক বিরাট রহস্য। বৈধ-অবৈধ বা পাচারকৃত অর্থ গচ্ছিত রাখতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রপ্রধানরা ও বিত্তশালীরা সুইস ব্যাংকগুলোকে পছন্দ করেন। এর কারণ সুইস ব্যাংকগুলো কঠোরভাবে গ্রাহকদের নাম-পরিচয় গোপন রাখেন। পাঠক গত ১৬ই জুন সাপ্তাহিক সুরমা’র প্রতিবেদন থেকে জেনেছেন যে বাংলাদেশের দুর্নীতিবাজ, অবৈধ ও অনৈতিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১৪-১৫ জুন ‘ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক সামিট: সোশ্যাল জাস্টিস ফর অল’ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার নামে সঙ্গী সাথীসহ বিশাল বহর নিয়ে সুইজারল্যান্ডে প্রমোদ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই সফরের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। সুইস ব্যাংকে রক্ষিত অবৈধ অর্থ দুবাই-কাতারে বা অন্য কোন নিরাপদ দেশে ট্রান্সফার করার সাথে কারা কিভাবে জড়িত। সুইস সরকার ১০হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশীরা সরিয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে বলার পরও হাসিনা সরকার নির্বিকার। কোন তদন্ত নেই। কারণ আমেরিকায় লুটপাটের অর্থ যাদের কাছে জমা রেখেছিলো প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলে আলোচিত কয়েকজন, ক্ষমতার শেষ সময় বুঝতে পেরে তারা নাকি সেই টাকা হজম করে ফেলেছিলো। কেবল সামিটের আজিজ খান ও ফরিদের কাছে যা ছিলো ওটাই নাকি তখন তার শেষ সম্বল ছিলো। এজন্য শেখ হাসিনার সাথে বিশেষ বিমানে শামীম ওসমান, শাজাহান খান, বেগম মুন্নুজান সুফিয়ানসহ সরকারের টাকা পাচারকারী হাই অফিসিয়ালদের একটি দল সফর সঙ্গী হয়েছিলো।

সুইস ব্যাংক থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছে তারা

মাত্র এক বছরেই সুইস ব্যাংকগুলো থেকে সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নিয়েছে সরকারের এই দুর্নীতিবাজরা। ২০২১ সালে যেখানে বাংলাদেশি আমানত ছিলে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, ২০২২ সালের শেষে তা কমে এসেছে মাত্র সাড়ে পাঁচ কোটি ফ্রাঁতে। সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। এক বছরে এতো বিপুল পরিমাণ টাকা উত্তোলন করে বাংলাদেশি এই দুর্নীতিবাজরা কী করেছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের আমানত সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২১ সালে। এক বছরের ব্যবধানে এটি নেমে এসেছে সর্বনিম্ন অবস্থানে। এক বছরে ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের আমানত কমেছে প্রায় ৯৪ শতাংশ। যার অর্থ ২০২২ সাল জুড়ে এই বিপুল অঙ্কের টাকা সুইস ব্যাংক থেকে তুলে নিয়েছে বাংলাদেশি এই দুর্নীতিবাজরা।

সুইস ব্যাংক থেকে  কেন তারা তড়িঘড়ি করে টাকা সরাচ্ছে?

যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ ও ভিসা নীতি বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মার্কিন বিধিনিষেধ বা ভিসা নীতির প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। আর মার্কিন মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত বিধিনিষেধ নীতি অনুসরণ করতে দেখা গেছে। এ কারণে অর্থ পাচারকারীরা যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলোয় বিনিয়োগ বা অর্থ গচ্ছিত রাখাকে নিরাপদ বলে মনে করছেন না। একাধিক বিশেষজ্ঞ ও গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি এই পাচারকারীদের  রাখা সব টাকাই অবৈধভাবে উপার্জিত। প্রতি বছর আমানতের তথ্য প্রকাশ করায় এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচার তদারকি সংস্থাগুলো নজর ও তদারকি বৃদ্ধি করায় সুইস ব্যাংকগুলোকে আগের মতো নিরাপদ মনে করছে না তারা। অন্যদিকে সুইস ব্যাংকগুলোতে গচ্ছিত অর্থ নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে নানারকম লেখালেখি হয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা পাচার তদারকি সংস্থাগুলো সুইস ব্যাংক বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থপাচার গভীরভাবে মনিটরিং করে। এ কারণেই এখন তড়িঘড়ি করে সুইস ব্যাংকগুলো থেকে টাকা সরাচ্ছে বাংলাদেশি এই দুর্নীতিবাজরা।

টাকা সরিয়ে দুর্নীতিবাজ বাংলাদেশিরা কোথায় রাখছে?

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, পাচারকৃত এ টাকা সুইজারল্যান্ড থেকে পুনরায় বাংলাদেশে ঢুকেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুইজারল্যান্ডে গোপনীয়তা কমতে থাকায়, বাংলাদেশি দুর্নীতিবাজরা এখন অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য ঝুঁকছেন, দুবাই-কাতার, লুক্সেমবার্গ, কেম্যান আইল্যান্ড, বৃটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা বারমুডার মতো ট্যাক্স হ্যাভেনের দিকে। তবে অন্য দেশগুলোর তুলনায় তারা এখন দুবাইকেই বেশি নির্ভরশীল মনে করছে। কেননা- দুবাই পাচারকৃত অর্থ কোনো দেশের অনুরোধে ফেরত দেয় না। দুবাই বা সংযুক্ত আরব আমিরাতে অর্থ পাচারকারীদের তথ্য প্রকাশ করা হয় না। সেখানে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিয়ে যে কেউ যে কোনো পরিমাণ অর্থ রাখতে পারে। যে কেউ যেকোনো সম্পদের মালিক হতে পারে। দুবাই বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান নীতি হলো- সেখানে বসে যদি কেউ কোনো অপরাধ না করে তাহলে অন্য দেশের অপরাধের জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না। ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিভিন্ন দেশের লুণ্ঠনকারী, দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্তদের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। গত ১৪ বছর ধরে দুবাইয়ে বাংলাদেশি দুর্নীতিবাজদের অর্থপাচারের প্রবণতা এবং ঝোঁক বেড়েছে। তারা কথায় কথায় দুবাই যাচ্ছেন এবং দুবাইতে দোকানপাট, শপিং মল, আবাসন খাতে বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ হচ্ছে। নানা কারণেই সুইস ব্যাংক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডার চেয়ে দুবাইয়ে টাকা রাখাকে তারা সুবিধাজনক মনে করছে।

পাঁচ অলিগার্ক ব্যবসায়ী গ্রুপের উপর নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা

বাংলাদেশের ৫ অলিগার্ক ব্যবসায়ী গ্রুপের উপর মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে শুনা যাচ্ছে! এ সপ্তাহে ওয়াশিংটন ভিত্তিক প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য ডিপ্লোমেটের ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র অবরুদ্ধ’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকার গত ১৪ বছরে ব্যাপক দুর্নীতি ও ভিন্নমত দমনের মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর তার দখলকে সুসংহত করার পথ বেছে নিয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়ে বেড়ে উঠা অতি ধনী শ্রেণি তথা অলিগার্কদের পক্ষে ঝুঁকে পড়া নীতি ও ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার ফলে এদের কাছে ভালো কিছু আশা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশি অলিগার্কদের চিহ্নিত করার ফলে ধারণা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের সাথে আশ্রয় ও প্রশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশ লুটেপুটে খাওয়া পাঁচ অলিগার্ক তথা মাফিয়া ব্যবসায়ী বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, এবং ওরিয়ন গ্রুপ এবার সার্চলাইটের তলায় পড়েছে। জানা গেছে, পাঁচ অলিগার্ক ব্যবসায়ী গ্রুপের উপর নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা আছে। 

উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক ৬টি সংস্থার রিপোর্টে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য এসেছে। এগুলো হলো-যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (আইসিআইজে), পানামা প্যারাডাইস ও পেনডোরা পেপারস, জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) রিপোর্ট এবং মালয়েশিয়া প্রকাশিত সেদেশের সেকেন্ড হোম রিপোর্ট। এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সিঙ্গাপুরে বেশকিছু বাংলাদেশির অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। প্রতি ডলার ১১২ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় ৫ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। গড়ে প্রতিবছর প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close