নিউজ

সিরাজুল আলম খান- একটি স্বপ্ন একটি আদর্শ ও বাংলাদেশ

।। শামীম আহমদ ।।

স্বাধীনতার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সকল কার্যক্রমে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী

মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম  প্রধান সংগঠক সিরাজুল আলম খান। ৬ জানুয়ারি ১৯৪১ সালে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার আলীপুর গ্রামে জাতির এই কৃতি সন্তান জন্ম গ্রহন করেন এবং ৯ জুন ২০২৩  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু বরন করেন। পিতা মরহুম খোরশেদ আলম ছিলেন স্কুল পরিদর্শক। মাতা সৈয়দা জাকিয়া খাতুন।

১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে এস এস সি পাস করেন এবং ১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে স্নাতক ভর্তি হন এবং ফজলুল হক হলে থাকতেন। গনিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন, কিন্তু কনভেনশন মুভমেন্টে অংশগ্রহণ করার জন্য তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করার ফলে মাস্টার্স করতে পারেন নি।

১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালীন সময়েই তরুণ রাজনীতিবিদ সিরাজুল আলম খান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাই তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন শোষণ থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে মুক্ত করার একমাত্র সমাধান। সেই পরিকল্পনা নিয়ে প্রয়াত আব্দুর রাজ্জাক এবং প্রয়াত কাজী আরেফ আহমদকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নিউক্লিয়াস বা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলন ,বঙ্গবন্ধু উপাধি, বাংলাদেশের মানচিত্র, ২ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ এবং ২৩ মার্চ জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ এবং পাকিস্তানের পতাকা প্রত্যাখ্যান করে দেশের প্রতিটি জেলা উপজেলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ; এক কথায় বলতে গেলে স্বাধীনতার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত সকল কার্যক্রমে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী।

এমনকি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ছাত্রলীগের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ নেতা কর্মী মনে করতেন মুক্তিযুদ্ধই পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের অবসানের একমাত্র পথ এবং এই মতবাদের নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। তাঁর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের আন্দোলন মুক্তিযুদ্ধকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলে ছিল। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের শাসকদের বাধ্য করা ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুল পরিকল্পনাকারী এবং নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান।

সিরাজুল আলম খাঁনের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং পরিকল্পনা সাফল্যমন্ডিত হয়, বাংলাদেশের ভৌগলিক স্বাধীনতা অর্জিত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত এবং ২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে।

১়০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে এলে বাংলাদেশের জনগন আনন্দে ফেটে পড়ে,আমরা আশায় বুক বাঁধি  যে এবার আমরা গড়বো আমাদের কাংখিত সোনার বাংলাদেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র নেতারা সিরাজুল আলম খাঁনের নেতৃত্বে দেশ গড়া ও দেশ পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে জাতীয় সরকার গঠন এবং ১৫ দফা দাবী উপস্থাপন করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলকে সম্পৃক্ত করে দেশ গঠনে  সবার সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেই সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর কাছে এই প্রস্তাবটি করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বার বার অনুরোধ করেছিলেন দেশ পরিচালনা ও প্রশাসনে যোগ্যতা অনুসারে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ করতে।

কিন্তু কেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় সরকার এবং ১৫ দফা কে গ্রহন করেন নি এবং তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং প্রিয় ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান সহ সেই সব ছাত্র নেতাদের ত্যাগ করেছিলেন তা আজো পরিষ্কার করে বলা যায় না। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী মরহুম তাজ উদ্দিন কে কে মন্ত্রীত্ব থেকে কেন সরিয়ে দেওয়া হল আজ অবধি জাতি জানতে পারেনি।

১৯৭২ সালে ছাত্রলীগ ভাগ হয়ে যায় এবং নিউক্লিয়াসের সাথে সম্পৃক্ত এবং স্বাধীনতাপন্থী বলে পরিচিত নেতা কর্মীসহ ছাত্রলীগের বেশিরভাগ নেতা কর্মী সিরাজুল আলম খাঁনের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্রলীগ সংগঠিত হন। তারই ধারাবাহিকতায় ৩১ শে অক্টোবর ১৯৭২ সিরাজুল আলম খান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ প্রতিষ্ঠা করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়  একটি শোষনহীন, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য  তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।সিরাজুল আলম খান বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৭ বৎসর কারাভোগ করেন। কনভেনশন মুভমেন্ট এর কারনে ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে প্রথম কারাভোগ করেন।

পরবর্তীতে ১৯৭৬-১৯৭৯ পর্যন্ত এবং ১৯৯২ সালে বিদেশ যাবার সময় গ্রেফতার হন এবং প্রায় ৪ মাস পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান। সিরাজুল আলম খানের পরামর্শেই জেনারেল এরশাদ বিচার বিভাগ ও প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করেন এবং উপজেলা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর অবদান কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। তিনি হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। লক্ষ লক্ষ অনুসারী  তৈরী করেছেন,দেশ স্বাধীন করেছেন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ কেন্দ্রবিন্দুতে থাকার সুযোগ পেয়েও রাষ্ট্রের কোন সুযোগ সুবিধা গ্রহন করেননি। এই জাতির জন্য জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। বিয়ে করেন নি। লোভ-লালসার রাজনীতির এই দুঃসময়ে সম্পদের পাহাড় গড়ার সুযোগকে তিনি পায়ে ঠেলে দিয়েছেন। ক্ষমতার হাতছানি বা কোন লোভ লালসা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি।

তিনি মুলত ১৯৮৩ সাল থেকেই রাজনীতি থেকে নীজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু লেখালেখির মাধ্যমে এবং বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যোগাযোগ রেখে একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার চেষ্টা আজীবন অব্যাহত রেখেছেন। তাঁর লিখা রাজনৈতিক বই এর মধ্যে “বাঙালির তৃতীয় জাগরন” এবং “স্বাধীনতা-সশস্ত্র সংগ্রাম  এবং আগামীর বাংলাদেশ” উল্লেখযোগ্য।

সিরাজুল আলম খানের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয় ১৯৭২/৭৩ সালে। বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নং রোডের বাসা থেকে ৮/১০ টা বাসা পরে একই রাস্তায় ছিল আমার খালু কাজী শামসুল হক সাহেবের বাসা এবং এই বাসার প্রায় উল্টা পাশে অর্থাৎ  ২৩ নং রোডে ছিল শেখ ফজলুল হক মনি ভাইয়ের বাসা।

স্কুল কলেজের লম্বা ছুটি আমি ঢাকায় ধানমন্ডিতে  কাটাতাম তাই আমি অনেক প্রসিদ্ধ রাজনৈতিক নেতাদের সাথে  পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। ১৯৮১ সালে তিনি জার্মানিতে সফরে এলে আমার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং সেই সম্পর্ক এবং যোগাযোগ সব সময় অটুট ছিল।

হে বীর যতদিন লাল সবুজের পতাকা থাকবে ততদিন এই দেশ, এই জাতি পরম শ্রদ্ধায় এবং কৃতজ্ঞতায় তোমাকে স্মরণ করবে। স্বাধীনতার রূপকার,মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক, জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খাঁনের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

তাঁকে লাল সালাম ।

লেখক: সহ সভাপতি, বাংলাদেশ জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি ও সভাপতি, বাংলাদেশ জাসদ যুক্তরাজ্য।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close