বেহিসাবী টাকায় বাজার সয়লাব: আরেকদফা মুদ্রাস্ফীতির মুখে বাংলাদেশ
সুরমা প্রতিবেদন: শেখ হাসিনার দেউলিয়া সরকার চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়েছে। ঈদ উপলক্ষে নতুন করে এবার আরও ১৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাপিয়ে বাজারে ছেড়েছে। গত কোরবানি ঈদেও ২৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাপিয়েছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এত টাকা ছাপানোর ঘটনা দেশের ইতিহাসে অতীতে কখনো হয়নি। বাংলাদেশে বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বা মুদ্রাস্ফীতির জন্য ৯৯.৯% দায়ী এই অতিরিক্ত টাকা ছাপানো। এর ফলে টাকার পরিমাণ বাড়ছেই। আগে যেখানে ৫০০ টাকার নোটই বাজারে বেশি পাওয়া যেতোনা, এখন দেখা যায় ১০০০ টাকার নোটে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। এর ফলে টাকার মান কমছে, জনগণের জমানো টাকার চরম ক্ষতি হচ্ছে। প্রতি সেকেন্ডে জনগণের সঞ্চয়ের টাকার মান কমে যাচ্ছে। আজকে কেউ ১০ টাকা দিয়ে একটা চকলেট না কিনে টাকাটা ব্যাংকে রাখলো। দুইদিন পরে দেখা গেলো চকলেটের দাম হয়ে গেছে ২০ টাকা। অর্থাৎ লোকটা সঞ্চয় করে লাভবান তো হলোই না, উল্টা সঞ্চয় করে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। প্রচলিত নিয়মে যদি কেউ কোনো ব্যাংকে হিসাব খুলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে টাকা জমা রাখেন অথবা সরকারি বন্ড বা সঞ্চয়পত্র কিনে রাখেন, তাহলে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে তিনি আসল টাকাসহ কিছু মুনাফা পাওয়ার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর কারণে দেশে যে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি হয়েছে, তার কারণে তিনি এখন মেয়াদান্তে দেখতে পাবেন, ব্যাংক বা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে মুনাফাসহ তিনি যে অর্থ পেয়েছেন, তা দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যই তিনি কিনতে পারছেন না। একারণে যেকোনো দেশের সরকারের টাকা ছাপানোর ক্ষমতা থাকলেও সরকার তার যত ইচ্ছা তত টাকা ছাপায় না। অনেক হিসেব-নিকেশ এবং গবেষণার উপর ভিত্তি করে তাদেরকে টাকা ছাপাতে হয়। টাকা উৎপাদনের পরিমাণের সঙ্গে জড়িত দেশের মানুষের উপার্জন, অর্থনৈতিক চাহিদা, দেশের সম্পদ ইত্যাদি, এর বেশি উৎপাদন করলেই শুরু হয় সমস্যা, দেশের অর্থনীতি ভারসাম্য হারাতে শুরু করে। সাধারণত যেকোনো দেশ তাদের মোট জিডিপির উপর ভিত্তি করে অর্থের মোট চাহিদা এবং যোগান নির্ধারণ করে এবং সে মোতাবেক টাকা ছাপায়। অন্যথায় মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়ে। যেমন ধরুন, একটা দেশে সম্পদ বলতে রয়েছে ১০টা পেন্সিল। আর সেই দেশ বছরে ২০ টাকা ছাপায়। পরিবহন খরচ, খুচরা মূল্য পাইকারী মূল্য ইত্যাদি জটিলতা বাদ দিয়ে ধরে নিই প্রতিটি পেন্সিলের মূল্য ২ টাকা। তাহলে দেশের মোট সম্পদ আর মোট কারেন্সী ভারসাম্যপূর্ণ হল। পরের বছর ঐ দেশটি সর্বমোট ৪০ টাকা ছাপালো, কিন্তু মোট সম্পদ বলতে ১০টি পেন্সিলই রইলো। যেহেতু দেশে নতুন কোনো সম্পদ নেই, ওই ১০টি পেন্সিল কেনার জন্য বরাদ্দ হল ৪০ টাকা, অর্থাৎ প্রতিটি পেন্সিলের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেল। আবার ধরুন, একটি দেশে মাত্র দু’জন লোক থাকে এবং দুজন মিলে ১০০ কেজি চাল উৎপাদন করতে পারেন। এখন ওই দেশে যদি ১০০ কেজি চালের বিপরীতে ১০০০ টাকা ছাপানো হয় তাহলে ১ কেজি চালের দাম পড়বে ১০ টাকা। কিন্তু ওই দেশ যদি ১০০০ টাকা না ছাপিয়ে ২০০০ টাকা ছাপায় এবং চালের উৎপাদন বৃদ্ধি না পায় তাহলে ওই চালের দাম হয়ে যাবে ২০ টাকা। মানে পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। কিংবা ধরুন, একটি দেশ বছরে ১০০০ টাকা করে ছাপায় এবং সে দেশে চালের কেজি ৫০ টাকা করে। তাহলে ঐ ১০০০ টাকা দিয়ে মোট ২০ কেজি চাল কেনা সম্ভব। এখন যদি চালের উৎপাদন একই রেখে ঐ দেশ বছরে ২০০০ টাকা করে ছাপায়, তাহলে চালের কেজি প্রতি দাম বেড়ে হবে ১০০ টাকা। এভাবেই দেশের মোট সম্পদের তুলনায় অতিরিক্ত টাকা উৎপাদন করলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, টাকার দাম বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। প্রশ্ন হলো- দেশে হঠাৎ করে টাকার ঘাটতি কেনো হলো? সরকার বলছে, দেশে তারল্য সঙ্কট নেই, তাহলে ছাপানো টাকাটা গেল কোথায়? এই টাকা দেশে ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে বের হয়ে আছে; দুর্নীতির কারণে, টাকা পাচার হওয়ার কারণে। দেশের অনেক ব্যাংক সরাসরি দুর্নীতির সাথে জড়িত হওয়ার ফলে ওই সব ব্যাংক বসে যাওয়ার উপক্রম। মাত্র কয় বছর পূর্বে চতুর্থ প্রজন্মের একটি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হলে সরকারকে ওই ব্যাংক রক্ষায় অর্থের জোগান দিতে হয়েছিল। ইদানীং বেশ কয়েকটা ইসলামিক ব্যাংককেও সরকারের টাকার জোগান দিতে হচ্ছে, মূলত একটি গ্রুপের নিয়মবর্হিভূতভাবে ঋণ নেয়ার জন্য, অথচ ওই ব্যাংকগুলোর পারফরম্যান্স বেশ ভালো ছিল। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় এবং শ্রেষ্ঠ ব্যাংক, যার ফাইন্যান্সিয়াল হেলথ্ দেশের অন্য যেকোনো ব্যাংকের চেয়ে ভালো ছিল। অথচ সেই ব্যাংক এখন ধার করছে। কারণ তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির মাধ্যমে চলে গেছে। ডলারে কনভার্ট হয়ে টাকা ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম থেকে বের হয়ে গেছে, অর্থাৎ মানি মার্কেটে নেই। যে কারণে দেশে এখন ডলারের ক্রাইসিস হচ্ছে; অর্থাৎ ডলার ক্রাইসিসের সাথেও এর সম্পর্ক রয়েছে। পাচারকৃত টাকাটা যদি রিকভার করে সিস্টেমে আনা যেতো তাহলে ক্রাইসিস থাকত না। কিন্তু যেহেতু রিকভার না করে উল্টো অতিরিক্ত টাকা ছাপানো হচ্ছে, ফলে ভবিষ্যতে পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে এনে দেশে বিনিয়োগ করা হলে মুদ্রাস্ফীতি আরও বাড়বে।
দুর্নীতি ও অর্থ পাচার না কমিয়ে এভাবে অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর কারণে জিম্বাবুয়ে, ইন্দোনেশিয়া ও ভেনিজুয়েলাসহ অনেক দেশকেই সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। জিম্বাবুয়েতে রবার্ট মুগাবে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার দুর্নীতিবাজ সরকারের মত বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা ছাপানো শুরু করে। আর এটি সে দেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। যেখানে ২০০৬ সালে একজন জিম্বাবুইয়ান নাগরিক মাসে ২০২ মার্কিন ডলার আয় করত, যার মূল্য ছিল জিম্বাবুয়ের মুদ্রায় ১৭ হাজার ২০০ ডলার, ২০০৮ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় মাসে ৪১ মার্কিন ডলার। অথচ জিম্বাবুয়ের মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৩ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে দেশটিতে দৈনিক মুদ্রাস্ফীতি দাঁড়ায় ১৫৭ শতাংশ, যার অর্থ, আজকে যদি কোনো দ্রব্যের দাম ১০০ টাকা হয়, সেটি আগামীকাল হবে ২৫৭ টাকা। ২০১৫ সালের দিকে জিম্বাবুয়েতে ১ মার্কিন ডলারে ৩৫ লাখ কোটি জিম্বাবুইয়ান ডলার পাওয়া যেত। অথচ তা দিয়ে এক কাপ চাও পাওয়া যেত না। একসময় পরিস্থিতি এমন হয় যে, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের হাজার হাজার কাগজি নোট রাস্তার পাশে পড়ে থাকত। দেশটিতে এক কেজি চাল কিনতেও বস্তা ভরা টাকা নিয়ে যেতে হত। আর এর ফলে দেশটির অর্থনীতি চরম মাত্রায় ভেঙে পড়ে এবং বেকারত্ব ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।এছাড়া অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর ফলে পৃথিবীর যে দেশে মুদ্রাস্ফীতি হয়, সে দেশের মুদ্রার দাম অন্যদেশের মুদ্রার তুলনায় কমে যায়। আর এসব সমস্যার কথা মাথায় নিয়ে একটি দেশ যত্ ইচ্ছা তত টাকা ছাপায় না। বরং সকল দেশই চেষ্টা করে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য। কারণ উৎপাদন বাড়লে একদিকে যেমন বেকারত্ব হ্রাস পাবে, অন্যদিকে এসময় কিছু অতিরিক্ত অর্থ ছাপালেও তা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি সৃষ্টি করবে না। আর এতে করে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। অর্থাৎ সরকার ইচ্ছেমতো টাকা ছাপালেই কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
একটা দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন করতে বেশি করে টাকা তৈরি করা কোন সমাধান নয়, সমাধান হল উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এর ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। উল্টোভাবে উন্নয়ন করতে গেলে উন্নয়নও উল্টোভাবেই হবে! অর্থের অধিক যোগান শুধুমাত্র মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তোলবে। দীর্ঘমেয়াদে কোন সমাধান করতে পারবে না।