নিউজবাংলাদেশ

ব্রিটেনে বাজেয়াপ্ত হতে পারে ভূমিমন্ত্রীর তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ

  • চেলসি মালিকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে বৃটিশ সরকার।
  • ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ‌দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যা বলল যুক্তরাষ্ট্র।

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।

লণ্ডন, ২২ ফেব্রুয়ারি- মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে দেশে বিদেশে তোলপাড় চলছে। ব্রিটিশ মুদ্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যে রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রোববার প্রকাশিত ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউসের করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে ব্লুমবার্গের বিশ্লেষণে এই পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি গণমাধ্যম সংবাদটি খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে।

ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লণ্ডনের উত্তর-পশ্চিম এলাকায় একটি প্রপার্টি ২০২২ সালে ১১ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি হয়। রিজেন্টস পার্ক ও লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড থেকে একদমই কাছে অবস্থিত ওই প্রোপার্টিটি ব্রিটেনের রাজধানী লণ্ডনের সবথেকে ধনী এলাকায় অবস্থিত। এই প্রপার্টির মালিক বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। বর্তমানে ওই প্রোপার্টির দাম ১৩ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি। বাংলাদেশে যে মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে, তার অধীনে কোনো নাগরিক, বাসিন্দা এবং সরকারি কর্মচারী বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি দেশের বাইরে পাঠাতে পারেন না। নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ ও অনুমোদন ছাড়া কোনো করপোরেশনও বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করতে পারে না।

এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১৬ সাল থেকে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি প্রোপার্টির রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। এসব প্রোপার্টির মধ্যে রয়েছে লন্ডনের একদম কেন্দ্রে থাকা বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার কয়েকটি অ্যাপার্টমেন্টও। ইংল্যান্ডের সবথেকে বড় বাংলাদেশি কমিউনিটির বাস এই টাওয়ার হ্যামলেটসেই। লিভারপুলে কিছু ছাত্রাবাসও রয়েছে তার। নিউইয়র্কে সদর দপ্তর থাকা আন্তর্জাতিক এই মার্কিন সংবাদ সংস্থা যুক্তরাজ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর প্রায় আড়াইশ প্রপার্টির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে। যখন এই প্রপার্টিগুলো কেনা হয়, তখন যুক্তরাজ্যজুড়ে তীব্র আবাসন সংকট চলছিল এবং এর ৯০ ভাগই ছিল সদ্য তৈরি নতুন বাড়ি। এই লেনদেনগুলি এমন একটি সময়ের মধ্যে ঘটেছিল যখন বৃটিশ সরকার বিদেশি সম্পত্তির মালিকানাকে আরও স্বচ্ছ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

এদিকে গত নির্বাচনী হলফনামায় মোট ২.৪ মিলিয়ন ডলার সম্পদের কথা উল্লেখ করেন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। তার স্ত্রী রুখমিলা জামানের সম্পদ বলা হয় ৯ লাখ ৯৩ হাজার ডলার। কিন্তু এতে তিনি বৃটেনে থাকা তার সম্পদের পরিমাণ ঘোষণা করেননি। বাংলাদেশের মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের থাকায় এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক সাইফুজ্জামান চৌধুরী সম্পর্কে বিশেষ কোনো মন্তব্য না করেই বলেন, বাংলাদেশে বসবাস করার সময় কারো বিদেশে সম্পদ জমা করার বিধান নেই। এটা একটা সাধারণ নিয়ম যে, আমরা নাগরিকদের এটি করার অনুমতি দিই না। এ বিষয়ে মন্তব্য করার অনুরোধ জানালে সাইফুজ্জামান চৌধুরী বা তার স্ত্রী কেউই কোনো জবাব দেননি। ব্লুমবার্গ তাদের প্রতিবেদনে উল্লিখিত কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, যাদের মধ্যে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্য সম্পত্তি কেনার সঙ্গে জড়িত আর্থিক সেবা ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু সংগস্থা জানায়, এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। তবে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে বিস্তারিত মন্তব্য দেয়নি তারা।

এদিকে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ক্ষেত্রে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক আরও শক্তিশালী হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রোপার্টি ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরা। তবে ক্রেতাদের শনাক্ত করা বেশ কঠিন। প্রোপার্টি মার্কের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাথান এমারসন বলেন, যদি কেউ এরইমধ্যে ‘পলিটিক্যালি এক্সপোজড’ হন, তাহলে তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে। কিন্তু ক্রেতাদের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে সবসময় তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট হওয়া যায় না। কেউ আমাদের অফিসে এলে আমরা কীভাবে বুঝবো যে তিনি কোনো দেশের মন্ত্রী কিনা।

যাই হোক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে  সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ‘পলিটিক্যালি এক্সপোজড পার্সন’-এর তালিকায় পড়েছেন। যুক্তরাজ্যের ২০১৭ সালের অর্থ পাচার আইনে এ বিষয়টিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সাপ্তাহিক সুরমাকে ব্রিটিশ আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আফজাল সৈয়দ আলী বলেন, ইংল্যান্ডের আইনের অধীনে Politically Exposed Person (PEP) বা রাজনৈতিকভাবে উন্মুক্ত ব্যক্তি নামে একটি ধারণা রয়েছে। এটি ২০১৭ সালের মানি লন্ডারিং রেগুলেশনের অধীনে চালু করা হয়েছিল। PEP-তে এমন লোকদের একটি বিস্তৃত নেট রয়েছে যাদেরকে যুক্তরাজ্যে আর্থিক অপরাধ আইন এবং অপরাধ আইনের অধীনে তদন্ত করা যেতে পারে। এই আইনের অধীনে প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হবে National Crime Agency, Revenue Customs, Financial Conduct Authority, Director of Serious Fraud, Office অথবা Director of Public Persecutions. ইংল্যান্ডের হাইকোর্ট কোনো সম্পত্তির ব্যাপারে কোনো প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আবেদনের ওপর অব্যক্ত সম্পদ আদেশ নামে পরিচিত একটি আদেশ দিতে পারেন। তবে আদেশ দেওয়ার সময়, হাইকোর্টকে অবশ্যই সন্তুষ্ট হতে হবে যে রাজনৈতিকভাবে উন্মোচিত ব্যক্তির সম্পত্তি রয়েছে এবং এই জাতীয় সম্পত্তির মূল্য ৫০ হাজার পাউন্ডের বেশি। এই আইনটি ভূমিমন্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ব্যারিস্টার আলী আরও বলেন, আমার মতে দেশের বিরোধী দলগুলো ছাড়াও যেসব সংগঠন সরকারের নিয়োগপাপ্ত লোকদের সংগঠিত অপরাধের বিষয়ে উদ্বিগ্ন তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিটিশ হাইকমিশনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যের উপরোক্ত সংগঠনের পরিচালকদের চিঠি দিতে পারেন। এ বিষয়টি তদন্ত করে ব্লুমবার্গের এই প্রতিবেদনের সমর্থনে প্রমাণ হিসেবে সরবরাহ করতে পারেন। যুক্তরাজ্যে Politically Exposed Person (PEP) বা রাজনৈতিকভাবে উন্মুক্ত ব্যক্তিদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের অনেক উদাহরণ আছে।

চেলসি মালিকের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে বৃটিশ সরকার

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ২০২২ সালে ইংল্যান্ড ফুটবল ক্লাব চেলসির মালিক রোমান আব্রামোভিচের সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে। কেবল সম্পত্তি বাজেয়াপ্তই নয়, তাকে বৃটেনে ব্যবসা করতে কিংবা ভ্রমণ করতেও দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে বৃটিশ সরকার। আব্রামোভিচের ৯৪০ কোটি পাউন্ড সম্পদ রয়েছে বৃটেনে। নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকলে সে সম্পত্তি আর নিজের দখলে নিতে পারবেন না আব্রামোভিচ।

সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ‌দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যা বলল যুক্তরাষ্ট্র

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে ২০০ মিলিয়ন পাউন্ডের সম্পদ পাচার নিয়ে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ব্লুমবার্গে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এই বিষয়ে কথা বলেন। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রোববার ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারের লোকদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি একটি ওপেন সিক্রেট। মন্ত্রীপরিষদের সাবেক এক মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ উঠেছে। যার মূল্য ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড, যা দেশের বৈদেশিক রিজার্ভের এক শতাংশের সমতুল্য। এটি অনেক ঘটনার মধ্যে একটি। বাংলাদেশ সরকারকে জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র কী ধরনের পদক্ষেপ নিবে? জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার জানান, আমরা এই রিপোর্টের বিষয়ে অবগত রয়েছি। বাংলাদেশ সরকারকে বলব, তাদের সব কর্মকর্তা যেনো দেশটির আইন এবং অর্থনৈতিক বিধি-বিধান মেনে চলে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে।

উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানসহ বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবসায়ীর সম্পদ যুক্তরজ্যের মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট অনুয়ায়ী বাজেয়াপ্ত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সাপ্তাহিক সুরমা জোগাড় করার চেষ্টা করছে।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close