নিউজ

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা সিলেটে ক্ষতির মুখে প্রায় ২২ লাখ মানুষ

আনাস হাবিব কলিন্স, সিলেট থেকে।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ গোটা সিলেটের জনপদ। সিলেট নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি অনেকখানি নেমে গেছে। নামতে শুরু করেছে জেলার নি¤œাঞ্চলেও। বিভাগের সুনামগঞ্জে শতভাগ ক্ষতি হয়েছে এবারের বন্যায়। এ জেলায়ও পানি কমতে শুরু করেছে।

পানি নামতে শুরু করলেও ভয়াবহ এই বন্যায় সিলেটে ক্ষয়ক্ষতির কোনো শেষ নেই। নগরীসহ সিলেট জেলার ঘরবাড়ি, ফসল, প্রাণিসম্পদ সবক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। জেলায় বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতির তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এবারের বন্যায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন প্রায় সোয়া ৪ লাখ পরিবারের প্রায় ২২ লাখ মানুষ।

সিলেটে সর্ব বৃহৎ স্বাস্থ্যসেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিলেট এম এজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্যার পানি ঢুকে নষ্ট করে দিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিরীক্ষার যন্ত্রপাতি। এম আর আই, সিটিস্ক্যান, রেডিও থেরাপির মতো মেশিনারিজে পানি ঢুকেছে। ফলে বন্ধ রয়েছে এই সেবা কার্যক্রম। সেই মেশিনগুলো পুনরায় চালু হবে কিনা এখনো নিশ্চিত নয় কর্তৃপক্ষ।

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুবুর রহমান ভুইয়া জানান, হাসপাতালের নিচতলা পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিচতলায় এম আর আই, সিটি স্ক্যান মেশিন, রেডিওথেরাপি মেশিন জলমগ্ন ছিল। রেডিওথেরাপি মেশিনও চালুর চেষ্টা চলছে। এমআরআই, সিটি স্ক্যান মেশিন এর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এখনো কিছু বলা যাচ্ছেনা।

এদিকে, বন্যার পানি নামার সাথে সাথে জেলায় পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বানের পানিতে এ পর্যন্ত সিলেট জেলায় ২ হাজার ১৮৯ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ১৪০টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলেও সিলেটের সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে সকল উপজেলা বন্যা দুর্গত। ১৩ উপজেলার ১০৩ টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯৪ ইউনিয়ন বন্যা কবলিত হয়েছে। সিলেট জেলায় মোট আশ্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা ৩৭৭ টি।

কৃষি অধিদপ্তর সিলেট অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মো. মোশাররফ হোসেন খান জানিয়েছেন, সিলেট জেলায় সর্বোচ্চ ২৬ হাজার ২৭৯ হেক্টর জমির আউশ ধান নিমজ্জিত রয়েছে। এ জেলায় ২৬৬৫ হেক্টর জমির সবজি পানিতে তলিয়ে আছে।

এদিকে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, বন্যায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আংশিক এলাকা, জেলার ১৩টি উপজেলা ও ৫টি পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৯৯টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ৪ লাখ ১৬ হাজার ৮১৯টি পরিবারের ২১ লাখ ৮৭ হাজার ২৩২ জন সদস্য ক্ষতির মুখে পড়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ হাজার ৪৫০টি ঘরবাড়ি।

চলমান বন্যায় সিলেটে হাজার হাজার একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে। বানের পানিতে তলিয়ে বিনষ্ট হয়েছে ঘাস, খড়। ক্ষতি ও সংকটের মুখে পড়েছেন কৃষক ও খামারিরা। এতে করে কোরবানীর ঈদের আগমুহূর্তে খামারিরা চোখে সর্ষেফুল দেখছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এবারের বন্যায় সিলেট জেলায় প্রায় ৮০ ভাগ এলাকাই তলিয়ে যায়। বন্যার পানিতে হাজার হাজার হাঁস-মুরগি এবং বেশ কিছু গরু-ছাগল মারা পড়েছে। হাজার হাজার টন খড় হয় ভেসে গেছে, না হয় পচে বিনষ্ট হয়েছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, বন্যায় সিলেটে প্রণিসম্পদ খাতে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৪৪ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৭ হাজার ৩৫৪ একর চারণভূমি প্লাবিত হয়েছে। এখনও সিংহভাগ চারণভূমি তলিয়ে আছে পানিতে।

বন্যা পরিস্থিতির ক্রমশও উন্নতি হলেও সিলেটের সুরমা-কুশিয়ারার তিনটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট নগরীর নিচু এলাকায় এখনও বন্যার পানি রয়েছে। বাড়ি-ঘর, হাটবাজার থেকে বন্যার পানি ধীর গতিতে নামায় বানভাসীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি ভাবে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও দুর্গম স্থানে বসবাসকারী পানিবন্দী মানুষ ত্রাণ পাচ্ছে না। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখনো লোকজন রয়েছেন।

এদিকে, বানভাসীদের পাশে ত্রাণ নিয়ে একাট্টা সব শ্রেণী-পেশার মানুষ। গত ১৮ জুন থেকে যার পক্ষে যেটুকু সম্ভব, সেটুকু নিয়েই নেমে পড়েছেন মানুষ। রান্না করে খাবার, শুকনো রুটি, বিস্কুট, গুড় ও চিড়া-মুড়ি, নিত্যপণ্য, নগদ টাকা, ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানি নিয়ে বন্যাপীড়িত মানুষের পাশে দাঁিড়য়েছেন তারা। সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ, পেশাজীবী, রাজনৈতিক, সংস্কৃতিকর্মী, প্রবাসী, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগ এবং বন্ধুবান্ধব মিলে বা সাংগঠনিক পর্যায়ে বানভাসি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে অগণিত মানুষ। কেউ রাস্তায় নেমে অর্থ-সহায়তা সংগ্রহ করছেন, কেউ দিয়েছেন একদিনের বেতন। স্বজন-সুহৃদের সম্মিলিত চেষ্টায় যথাসাধ্য খাদ্যপণ্য কিনে নিজের মতো করে দুর্গতদের মাঝে পৌঁছে দিচ্ছেন অনেকে। প্রথমদিকে নৌকা এবং পরিবহন সমস্যা দেখা দিলেও সিলেট ও সুনামগঞ্জের কয়েকটি স্থানে বন্যার্তদের জন্য ত্রাণ বিনামূল্যে পরিবহন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে মালিক সমিতি।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close