ইতালির পাসপোর্ট: হুমকির মুখে হাজারো পরিবার
।। আঁখি সীমা কাউসার, ইতালি থেকে ।।
লণ্ডন, ১৬ জুন : ইতালীর নাগরিকত্ব অর্জনের সময় বেআইনি সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে হুমকির মুখে পড়েছেন বিপুল সংখ্যক ইমিগ্রান্ট। এই অভিযোগে ইতালীয় নাগরিকত্ব বাতিলের হুমকির মুখে পড়েছে হাজারো বাংলাদেশী ইতালিয়ান ও তাঁদের পরিবার।
২০১৮ সালে একটি ইমিগ্রেশন জালিয়াতির ঘটনায় তদন্ত শুরু হয়েছিলো। জালিয়াতির ওই ঘটনায় কয়েক হাজার বাংলাদেশী পাসপোর্ট, পুলিশ রিপোর্টসহ নানা ডকুমেন্ট তৈরীর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছিল। তদন্ত করতে গিয়ে ইতালি পুলিশ আটককৃতদের কাছ থেকে আরো কয়েকটি দেশের ভূয়া ও জাল ডকুমেন্ট উদ্ধার করে। করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর এখন সেই তদন্তের ধারাবাহিকতায় ইতালির ইমিগ্রেশন তাদের তৎপরতা পুনরায় শুরু করেছে। সেই তদন্তে ইতিমধ্যে ইমিগ্রেশনের চার ইতালিয়ান কর্মকর্তাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে দেশটি ফৌজদারী অপরাধে বিচার করছে। তাদের কম্পিউটারে যাদের তথ্য পাওয়া গেছে, সেই কয়েক হাজার পাসপোর্ট আবেদনকারীর বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে কয়েকশো পাসপোর্ট আবেদনকারীকে চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। কয়েকজন কমিউনিটি নেতার সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলছেন, গত দুই বছরে বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসীর ইতালির নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছে, আইনি প্রক্রিয়ায় এমন অনেক মামলা চলমান রয়েছে। কয়েকজনকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলেও জানা গেছে। তিনি বলেন, স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ার কারণে কেউই প্রকাশ্যে আলোচনা করছে না এমনকি আইনের আশ্রয় নিয়ে ইমিগ্রশনের নোটিসকেও চ্যালেঞ্জ করছেন না। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, এইসব নোটিস যারা পাচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগ এরজন্য দায়ী নয়। কিন্তু নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে হলে আইনগতভাবে বিষয়টা মোকাবেলা করতে হবে।
অপর একজন অভিজ্ঞ কমিউনিটি নেতা বলেন, এককভাবে আইনগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব নয় কারণ, ইতালিতে শীর্ষস্থানীয় কোনো ল’ফার্মকে দিয়ে ইমিগ্রেশন কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তের মোকাবেলা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ভুক্তভোগীরা গ্রূপ হয়ে একসঙ্গে মোকাবেলা করলে সুফল পাওয়া সম্ভব। যা পরবর্তীতে অন্য সকল ভুক্তভোগীর জন্য রেফারেন্স হিসেবে কাজ করবে। একমাত্র এভাবেই ইমিগ্রেশনের এই জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, পাসপোর্ট বাতিলের চিঠি পাওয়া অনেকেই ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যে কিংবা ইউরোপের অন্য দেশে মাইগ্রেট করেছেন সপরিবারে। ইতালিতে তাঁদের পুরোনো ঠিকানায় এইসব চিঠি পড়ে থাকলেও তারা জানতে পারছেন না। আবার জেনেও অনেকে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁরা তৃতীয় দেশের নাগরিকত্ব কিংবা স্হায়ী আবাসনের অনুমতি পাওয়ার পর আর ইতালির নাগরিকত্ব নিয়ে কোনো উদ্বেগ বোধ করেন না।লন্ডনে বসবাসরত একজন ইতালির নাগরিক বলছেন, এই ধারণাটা পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ কোনো না কোনো কারণে যুক্তরাজ্যে কোনো আইনগত জটিলতায় পড়লে তাদের ইমিগ্রেশনের ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধান হতে পারে। সেক্ষেত্রে সব কিছু হারানোর সম্ভাবনা থাকতে পারে যখন তাদের সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যরা বড়ো ধরণের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হতে পারেন। তার মতে, ইমিগ্রেশনের এই চিঠিকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারেনা, কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একজন আবেদনকারী যেকোনো অবস্থায় দ্রুত তার আবেদনের নিস্পত্তি চাইবে। ইটা অন্যায় হতে পারেনা। কিন্তু আইনগতভাবে এটা মোকাবেলা করা না হলে ইমিগ্রেশনের আশংকা বা অনুমান বিনা চ্যালেঞ্জ-এ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
বেক্সিটের আগে বিভিন্ন দেশের মানুষ ইতালির নাগরিকত্ব পেয়েই সপরিবারে ব্রিটেনে যান কয়েক হাজার পরিবার। এই ব্যাপারে কোনো পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও বলা যেতে পারে, গত ছয় বছরে ইতালির পাসপোর্ট পাওয়ার সাথে সাথে লন্ডনে চলে যাওয়ার যে ঢল নেমেছে, তা ছিলো চোখে পড়ার মতো। এই প্রবণতা যাদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলো বাংলাদেশী মাইগ্র্যান্ট। ইতালি সরকার ওই তদন্তের সংঘে জুড়ে দেয় তাদের আশঙ্কা। খোঁজ খবর নিতে শুরু করলো কেন লন্ডনে যাওয়ার এত ঢল ? আর এত পাসপোর্ট কিভাবে পেল তারা ? যেমন ভাবা তেমন কাজ শুরু হতে লাগলো তদন্ত, সত্যিকারে তদন্ত, আস্তে আস্তে প্রশাসন জেনে গেল কিছুটা উল্টো পথে মিথ্যা তথ্য, পুলিশ ভেরিফিকেশন আনা হয়েছে সেখানেও ভুয়া কাগজপত্র ছিল, ঘুষ দিয়ে পাসপোর্ট বের করেছে কয়েক হাজার মাইগ্রান্ট। শুধুমাত্র বাংলাদেশীরা নয় ,তদন্তে উঠে এসেছে অন্যান্য দেশের নাগরিকরা অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছে । যেমন নিজ দেশে সপরিবারে থাকছেন, ছেলে মেয়ে স্কুল ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে তারপরেও এখানে এসে উকিল ধরে ,ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে নাগরিকত্ব বের করেছে, এমন তথ্যও আছে প্রশাসনের কাছে ।
চলতি বছর এপ্রিলে ব্যক্তিগত কাজে এক ফ্যামিলি ইতালি আসে। ফেরার সময় তার পাসপোর্ট আটকে দেয় ইতালি ইমিগ্রেশন। কারণ তিনি নাগরিকত্ব আবেদনের সময় প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিলেন, ঘুষ দিয়ে তার নাগরিকত্ব আবেদন করে সফল হন। ইতালির ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে প্রতারণা করে কম সময়ে পাসপোর্ট বের করা যায় এটা একশ্রেণীর দালালদের কর্ম বলে জানা গেছে। এখন বিপদ হচ্ছে সেই ব্যক্তি যেখানে তার পুরো পরিবার ব্রিটেনে আর তিনি আটকা পড়েছেন ইতালিতে! তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিলে তার নাগরিকত্বের আবেদন করেছিলেন।
জানা গেছে, ইতালির রাজধানী রোমের পাবলিক প্রসিকিউটর অফিসের ২০২০ সালের ২০ জুলাই জারি করা একটি চিঠির কপি কয়েকটি মিডিয়ার হাতে এসেছে বলে জানা গেছে। ঐচিঠিতে ১০ জনের একটি জালিয়াত চক্রের নাম প্রকাশ করা হয়েছে; এদের মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা ও বাইরের দালাল রয়েছে। চিঠিতে ৪৮৬টি পাসপোর্ট আবেদনের রেফারেন্স নম্বরের উল্লেখ আছে। এ রকম আরও বেশ কিছু চিঠি ইতালির বিভিন্ন শহর থেকে ইস্যু করা হয়েছে। মূলত কভিডের আগে এ নাগরিকত্ব বাতিলের চিঠি দেওয়া হলেও নতুন করে আবারও গত দুই মাস থেকে এ চিঠি দেওয়া
হচ্ছে।
ব্রিটেন প্রবাসী ইতালী নাগরিকদের কয়েকজন ২০২০/২০২১ এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন । তাদেরকে ইতালি এয়ারপোর্টে নাগরিকত্ব বাতিল করে দিয়েছ। এবং তাদেরকেও বলে দেয়া হয়েছিলো, দশ বছর ইতালিতে অবস্থান করে আবার পাসপোর্টের জন্য আবেদন করতে ।
রোমে বাংলাদেশ কমিউনিটিতে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে,যারা বাংলাদেশী প্রবাসীদের সমস্যা নিয়ে কাজ করে, আগামীতে আরো দুই থেকে আড়াই হাজার ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিল হতে পারে ।এর মধ্যে ইতালির প্রশাসনের নজরে অন্যান্য দেশের নাগরিকসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি আছেন। বিশ্বস্ত একটি সূত্র থেকে জানা গেছে যে‘,ইতালি থেকে ব্রিটেনে যাওয়া অনেক বাংলাদেশি ইতালি দূতাবাসে নিবন্ধন করেননি, মানে ইতালির সরকারের হিসাবে তারা ইতালিতেই আছেন তাদের ব্যাপারেও এরি মধ্যে যারা এখনো ইতালি ত্যাগের বিষয়ে ইতালি সরকারকে কিছু জানাননি, তারা কিন্তু বড় রকমের বিপদের মুখোমুখি হতে পারেন। তাদের অনেককেই নানা করণে ইতালি সরকার ইতালির ঠিকানায় চিঠি দিয়েছে, সে চিঠির খবরই জানেনি অনেকেই। এখন ইতালিতে যাওয়ার পর পাসপোর্ট আটকে রাখা হচ্ছে।’
এই ব্যাপারে আমরা কথা বলেছি লন্ডনে ইতালি কউন্সিলর কমিটির নির্বাচিত সদস্য (কাউন্সিলর) গোলাম মাওলা টিপুর সঙ্গে। তিনি বিষয়টির সত্যতার কথা জেনেছেন এবং কোনো অবস্থাতেই এই ধরণের চিঠি পাওয়ার পর বসে থাকা ঠিক হবেনা বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, এটা একারণে উদ্বেগজনক যে ইমিগ্রান্টদের জন্য এটা অস্তিত্বের প্রশ্ন। আইনগতভাবে দেখলে ও আইনজীবীদের (অবশ্যই ইতালিয়ান ল’ফার্ম) পরামর্শ নিলে প্রতিকার পাওয়ার সর্বাত্মক সুযোগ থাকবে। তিনি বলেন, যারা এটা গুরুত্ব দেবেননা, তারা শুধু নিজের জন্যই নয়, বরং, অন্যদের জন্যও বিপদের কারণ হতে পারেন।