নিউজ

সিলেটে প্রবাসী হয়রানী: সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক বৃটেনপ্রবাসীর জমি দখলের অভিযোগ

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ২৪ অক্টোবর : সিলেটে আবারও প্রবাসী হয়রানীর অভিযোগ ওঠেছে। এবার খোদ সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হকের নেতৃত্বে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক আদালতে বিচারাধীন জমি বেদখলের অভিযোগ তুলেছেন বৃটেনপ্রবাসী আনিসুল হক ও তার পরিবার। সিলেট নগরীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সোবহানী ঘাটে ক্রয়সূত্রে মালিকাধীন ২৪ শতক ভূমি বেদখলের শিকার হয়ে ল-নে সংবাদ সম্মেলন করেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয় যে, আদালতে বিচারাধীন এবং ভোগদখলে থাকা অবস্থায় কোনো ধরনের নোটিশ প্রদান ছাড়াই গত ১৫ আগস্ট সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা এসে জোরপূর্বক তাদের জমি দখল করে নিয়েছেন। এসময় বাড়িঘরসহ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয় বলেও অভিযোগ করা হয়।

গত ১৯ অক্টোবর, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে আটটায় পূর্ব লণ্ডনের একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এসব অভিযোগ উত্থাপন করেন ভূক্তভোগী আনিসুল হক। এসময় তার পাশে ছিলেন বোন আবিদা সুলতানা ও তার স্বামী সাইফ আহমেদ এবং মামাতো ভাই সামসুর রহমান মাতাব ও সাঈদুর রহমান সাঈদ।
এদিকে, সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক পরদিন পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগকারীদের ‘দেশদ্রোহী’ হিসেবে আখ্যায়িত করার পাশাপাশি দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বলে দাবী করেছেন।
সিলেটের কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে এ মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। স্থানীয় সময় বিকেল চারটায় নগর ভবনে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে মেয়র আরিফ বলেন, সরকারের বিচারবিভাগের আওতায় আদালত এবং জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের নিস্পত্তিকৃত ও চলমান মামলা বিষয়ে দেশের বাইরে (লণ্ডনে) বসে আনিসুল হক যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেটি দেশদ্রোহীতার শামিল। তিনি বলেন, সিলেট সিটি করপোরেশন বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। আনিসুল হক ভিনদেশে বসে সংবাদ সম্মেলনের অর্থ হচ্ছেÑ তিনি গণমাধ্যম এবং অনলাইন গণমাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন এবং তাঁর মানহানি করছেন বলেও অভিযোগ করেন মেয়র।

মেয়র আরিফুর হক চৌধুরীর পাল্টা ডাকা সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে জানতে চেয়ে সুরমার পক্ষ থেকে ফোনে কথা হয় একজন সাংবাদিকের সাথে। তিনি বলেন, তারা মেয়রের এই সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে জানতেন না এবং তাদের অনেকেই তাতে যাননি। তাদের উক্ত সংবাদ সম্মেলনে ডাকা হয়নি। মেয়র তাঁর পছন্দের কয়েকজন সাংবাদিক নিয়ে তা করেছেন বলে জানান তিনি। প্রবাসীদের ‘দেশদ্রোহী’ লেবেল দেওয়া প্রসঙ্গে তাঁর মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনকিছুর সমালোচনা বা প্রতিবাদ করেলেই তা দেশদ্রোহী হয়ে যাবে — এমনটি মেনে নেওয়া যায় না।

মেয়র আরিফ বলেন, লণ্ডনের সংবাদ সম্মেলনকারী দাবী করেছেন— তার ঘরবাড়িসহ সব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয় এবং আদালতের রায়ের বা ডিক্রির কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সিলেট সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ওইদিন সিসিকের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিট্রেটের কাছে কেউ কাগজপত্র প্রদর্শনের জন্য আসেননি। সংবাদ সম্মেলনকারী সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে দখলদার ও সিসিকে মেয়র হিসেবে আমাকে জমি দখলকারী উল্লেখ করে শুধু আমার বা সিসিকের নয়, সিলেট মহানগরীর সর্বস্তরের জনসাধারণের মানহানি করেছেন।

লণ্ডনের সংবাদ সম্মেলনে ভূক্তভোগী বৃটেনপ্রবাসী আনিসুল তাঁর লিখিত বক্তব্যে বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, আমরা বাংলাদেশের সিলেট নগরির বাসিন্দা। দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে ইংল্যা-ে বসবাস করছি। প্রবাসে থাকলেও বাংলাদেশের প্রতি নাড়ির টান অনুভব করি। সকল প্রবাসীর মতো আমিও দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার চেষ্টা করি। দেশের নানা কল্যাণমূলক কাজেও যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। তবু দেশে প্রায়ই অনাকাঙ্খিত ঘটনার মুখে পড়তে হয় আমাদের। বিশেষত দেশে থাকা আমাদের ভূসম্পত্তি নিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয়।

দেশে তাদের পারিবারিক ভূ-সম্পদ জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছে রাষ্ট্রেরই এক প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, সিলেট নগরীর সোবহানীঘাট এলাকায় আমাদের পরিবারের ২৪ শতক জমি রয়েছে। ১৯৮২ সাল থেকে ক্রয় সূত্রে আমরা এই জমি ভোগদখল করে আসছি।
ভূ-সম্পদের বিস্তারিত তুলে ধরে তিনি বলেন, জমির মূল মালিক ছিলেন নরেশ দত্ত সেনাপতি। কাষ্টঘর এলাকার রজনী ভূষণ চৌধুরী ও রসময় চৌধুরী এই জমি ক্রয় করে ভিটা নির্মাণ করে তাতে বসবাস করেন। পরবর্তীতে রসময় চৌধুরী তার অংশ রজনী চৌধুরীর নিকট বিক্রি করে দেন। রজনী চৌধুরীর মৃত্যুর পর পুরো জমির মালিক হন রনধীর চৌধুরী। ১৯৫৬ ইংরেজির ভূমি জরিপে ভুলবশত এই জমিটি সিলেট পৌরসভার নামে রেকর্ডভূক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু জমিটিতে ভোগদখল থাকা অবস্থায় হঠাৎ কওে লোকমুখে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন রনধীর চৌধুরী। এরপর তিনি সিলেট সদর মুনসেফি ১ম আদালতে ১৯৬৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী পৌরসভার বিরুদ্ধে স্বত্ত্ব মামলা দায়ের করেন। পৌরসভা এ বিষয়ে লিখিত জবাব দিয়ে জমিটি নিজেদের বলে দাবী করলেও প্রমাণের অভাবে মামলাতে হেরে যায়। মামলায় বাদী রনধীর চৌধুরী বিবাদী পৌরসভার বিরুদ্ধে খরচসহ ডিক্রি লাভ করেন।
এরপর রনধীর চৌধুরী এই জমির মধ্যে ১২ শতক গুল মো. এবং আরও ১২ শতক আব্দুর রহিমের কাছে বিক্রি করেন। ১৯৮২ সালে এই দুজনের কাছ থেকে তাদের মালিকানাধীন ২৪ শতক ভূমি ক্রয় করেন আমার বাবা আরকান আলী।

আনিসুল হক আরো জনান, জমি ক্রয় করে আমার পরিবার যথানিয়মে ভোগদখল করতে থাকেন। মালিকানার কাগজপত্র দিয়ে পৌরসভার অনুমতিক্রমেই এই জমিতে দোকানকোঠা নির্মাণ করা হয়। দোকানকোঠায় বিদ্যুৎ সংযোগও নেওয়া হয়। আমাদের মালিক মেনেই ২০২০ সালের ২৭ জুলাই সিলেট সিটি কর্পোরেশন থেকে হোল্ডিং বিবরণী (হোল্ডিং নং ২৩১০/২) প্রেরণের জন্য মেয়র স্বাক্ষরিত নোটিশ প্রদান করা হয়। আমরা যথাযথ নিয়মে হোল্ডি ট্যাক্স প্রদান করি।
সংবাদ সম্মেলনে দাবী করা হয় যে, সপরিবারে প্রবাসে থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই আনিসুল হকের পরিবার সবসময় জমির খোঁজখবর রাখতে পারেননি। এ কারণে সর্বশেষ নামজারিকালে এই জমিটি তাদের নামে নামজারি হয়নি। নামজারি না হওয়ায় ২০০২ সালে তাদের পরিবারের পক্ষে হাসনা বেগম বাদী হয়ে ২০০২ সালে সিলেট জজ কোর্টে একটি মামলা করেন Ñ যা এখনো আদালতে বিচারাধীন আছে।

আনিসুল হক বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আদালতে বিচারাধীন ও আমরা ভোগদখলে থাকা অবস্থায় কোনো ধরনের নোটিশ প্রদান ছাড়াই গত ১৫ আগস্ট সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা এসে জোরপূর্বক আমাদের জমি দখল করে নেন।
লিখিত বক্তব্যে আরো জানানো হয় যে, জমি ফিরে পেতে আদালতে তাদের মামলা চলমান রয়েছ। তারা আশাবাদী আদালতে ন্যায় বিচার পাবেন। কিন্তু আদালতের সিদ্ধান্তের আগে কোনো ধরনের হয়রানি, নির্যাতন ও উচ্ছেদের শিকার না হওয়া ছিলো তাদের নাগরিক অধিকার। প্রবাসী পরিবার হিসেবে মিডিয়ার মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অধীনে বিষয়টি তদন্তের দাবী জানিয়েছেন আনিসুল হকের পরিবার।

মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী

সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য:
যুক্তরাজ্যের সেই সংবাদ সম্মেলনের পাল্টা জবাব দিতে মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) বিকেল ৪টায় নগরভবনে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সরকারের বিচারবিভাগের আওতায় আদালত এবং জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসের নিস্পত্তিকৃত ও চলমান মামলা বিষয়ে দেশের বাইরে (লণ্ডনে) বসে আনিসুল হক যে সংবাদ সম্মেলন করেছেন সেটি দেশদ্রোহীতার শামিল। সিলেট সিটি করপোরেশন বাংলাদেশ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। আনিসুল হক ভিনদেশে বসে সংবাদ সম্মেলনের অর্থ হচ্ছে— তিনি গণমাধ্যম এবং অনলাইন গণমাধ্যম ব্যবহার করে দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

মেয়র আরিফ বলেন, লণ্ডনের সংবাদ সম্মেলনকারী দাবী করেছেন— তার ঘরবাড়িসহ সব স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয় এবং আদালতের রায়ের বা ডিক্রির কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সিলেট সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু ওইদিন সিসিকের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিট্রেটের কাছে কেউ কাগজপত্র প্রদর্শনের জন্য আসেননি। সংবাদ সম্মেলনকারী সিলেট সিটি কর্পোরেশনকে দখলদার ও সিসিকে মেয়র হিসেবে আমাকে জমি দখলকারী উল্লেখ করে শুধু আমার বা সিসিকের নয়, সিলেট মহানগরীর সর্বস্তরের জনসাধারণের মানহানি করেছেন।

মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, সর্বাবস্থায় আদালতে সিদ্ধান্তক্রমেই বর্ণিত ভূমির উন্নয়নকাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত কাউকে নির্যাতন বা হয়রানি করার কোনো প্রমাণ আমি পাইনি। সংবাদ সম্মেলনকারী বারবার তার বক্তব্যে ‘সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী’ অর্থাৎ- আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জমি দখলকারী, জমি দখলে নেতৃত্বদানকারী, ফিল্মি স্টাইলে অভিযানকারী, নাগরিকদের অধিকার হরণকারী ইত্যাদি বলে আখ্যায়িত করে আমার মানহানী তথা সিলেট মহানগরবাসীর মানহানি করেছেন।

মেয়র আরিফ বলেন, জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র— কাউন্সিলর হিসেবে নাগরিকদেও সেবা প্রদানই আমাদের দায়িত্ব এবং আমরা আমাদের সাধ্যমত সে চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, শুধু প্রবাসী নয়, সিলেট মহানগরীর কোনো নাগরিকের কোনো রকম ক্ষয়ক্ষতি হোক— এমন কোনো কাজ করবো না। লণ্ডনে বসে উদ্দেশ্যমূলক এমন সংবাদ সম্মেলন করায় আমি মেয়র ও আমার পরিষদের সকল কাউন্সিলরসহ সিসিকের সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কার্মচারীগণ তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কারণ- মামলা চলাকালীন সময়ে সাব-জুডিস বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা আইনের পরিপন্থী। সংবাদ সম্মেলনের শেষদিকে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ও জায়গা ও জায়গা নিয়ে চলমান মামলার সর্বশেষ অবস্থা উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন।
(সূত্র: সিলেটভিউ২৪ডটকম)

সুরমা প্রিণ্ট ভার্সন
Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close