মুক্তচিন্তা

জ্যোতিবসুর স্মৃতিকথা ‘যতদূর মনে পড়ে’

পিছন ফিরে দেখা

|| নজরুল ইসলাম বাসন ||
সুরমার সাবেক সম্পাদক

ভারতের (পশ্চিম বাংলায় এক সময় ক্ষমতাসীন ছিল।) কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসিস্ট) নেতা ও প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যেতি বসু তার ‘যতদূর মনে পড়ে’— স্মৃতি কথায় লিখেছেন, তিনি যখন ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন এসেছিলেন তখন ইণ্ডিয়া লীগ ও সীম্যান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের মাধ্যমে  তার সাথে  ইস্ট লণ্ডনে বসবাসরত শ্রীহট্ট জেলা থেকে আগত জাহাজীদের সাথে দেখা সাক্ষাত হত। তখন তিনি ঐ সব জাহাজিদের চিঠিপত্র লিখে দিতে সাহায্য করতেন। ভারতীয় ছাত্ররা মজলিশ নামে একটি  সংগঠন গড়ে তুলেন। মজলিশ সংগঠনের মুখপত্রের তিনি ছিলেন প্রথম সম্পাদক, এই প্রচারপত্রের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন ইস্যু তুলে ধরা হত। ব্যারিস্টারি পরীক্ষা দিয়ে তিনি ভারতে ফিরে যান এবং কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালে তিনি এমএলএ নির্বাচিত হন, তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি মুসলিম লীগ নেতা মূখ্যমন্ত্রী। এর পর জ্যেতি বসুকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৭৭ সালে তিনি কংগ্রেসের সিদ্ধার্থ শংকর রায়কে হারিয়ে তিনি পশিচম বঙ্গের ক্ষমতা বাম ফ্রন্টের ঘরে নিয়ে আসেন এবং দীর্ঘ তিনি দশকের উপর বাম ফ্রন্ট পশ্চিম বঙ্গে রাজত্ব করে। জ্যেতি বসু একাই ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালে তৃণমুল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জি বুদ্ধ দেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বাধিন বামফ্রন্টকে হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন।

৯০ এর দশকে মুখ্যমন্ত্রী জ্যেতি বসু একবার লণ্ডন এসেছিলেন আমি তখন লণ্ডনের সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক। ভারতীয় দূতাবাসে এক অনুষ্ঠানের এক অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রন জানানো হল। আমি মুক্তিযোদ্ধা মা আ মুকতাদিরকে (মরহুম) নিয়ে সেই অনুষ্ঠানে গেলাম। সেখানে তার সাথে দেখা হয়েছিল। আমি এক ফাকে সাপ্তাহিক সুরমার একটি কপি সুরমা তুলে দিলাম। যতদূর মনে পড়ে আগ্রহভরে তিনি পত্রিকাটি দেখেছিলেন। মিসেস জ্যেতি বসুও তার পাশে বসা ছিলেন তিনি চোখেও ঔ্সুক্য নিয়ে পত্রিকাটি দেখছিলেন। বিলেতে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের বসবাস থাকলেও বাংলাদেশের বাঙালিদের মত তারা দেশের রাজনীতি,সংস্কৃতি, বাংলা মিডিয়া নিয়ে সক্রিয় নয়। মিসেস বসু হয়তো একটু অবাক হয়েছিলেন বাংলা পত্রিকা দেখে।

(বামে) জ্যোতিবসুর সঙ্গে লেখক নজরুল ইসলাম বাসন ও (ডানে) মুক্তিযোদ্ধা মরহুম ম আ মুকতাদির

প্রায় তিনি দশক আগের এই স্মৃতি মনে পড়লে এখন আফসোস হয় এই কিংবদন্তীর একটি সাক্ষা্কার কেন নিয়ে রাখলাম না।  পশ্চিম বঙ্গের বাম ফ্রন্টের এই কমিউনিস্ট নেতা দীর্ঘদিন পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তার দল কমিউনিস্ট পার্টি ও বামজোট ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। তৃণমুল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে বুদ্ধ দেব ভট্টাচার্যে্যর কমিউনিস্ট পার্টি বাম ফ্রন্ট পরাজয় বরণ করে। বর্তমানে বামজোট ও কমিউনিস্ট পার্টি তৃণমুল কংগ্রেস ও বিজেপির আধিপত্যের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। ভারতের পশ্চিম বঙ্গের বাম রাজনীতির ইতিহাসে বর্তমান সময় একটি করুন অধ্যায় অতিবাহিত হচ্ছে। পশ্চিম বঙ্গের বাম রাজনীতিতে জ্যেিতি বসু প্রকাশ্যে রাজনীতির সফল ধারার স্রষ্ঠা আর চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশাল আন্দোলন খতমের রাজনীতির ধারা। ৬০ এবং ৭০ দশকে পশ্চিমবঙ্গে চারু মজুমদার শ্রেনীশত্রু খতমের যে নকশাল আন্দোলন শুরু করেন এতে কলকাতার  শিক্ষিত তরুনদের মাঝে প্রভাব পড়ে। খতমের রাজনীতির এই ধারাকে মাও সে তুঙ এর চিন্তাধারা ও  চীন বিপ্লবের প্রভাব বলে বাম রাজনীতির বিশ্লেষকরা মনে করতেন। ১৯৬৭ সালে দার্জিলিং এর শিলিগুড়ির নকশালবাড়ী গ্রাম থেকে চারু মজুমদার এই সশস্ত্র বিপ্লব শুরু করেন। তাই এই সশস্ত্র বিপ্লব ষ্ক্রনকশালম্ব আন্দোলন নামে এখনও পরিচিত। পশ্চিম বঙ্গের নকশাল কমিউনিস্ট বিপ্লবিদের খতমের রাজনীতি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। বিরোধী পক্ষ নকশাল আন্দোলনকে গলাকাটা রাজনীতি বলে অভিহিত করেছেন।

নকশাল আন্দোলনের ঢেউ বাংলাদেশে ও এসে পৌছেছিল, ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সিরাজ শিকদার এই লাইনের রাজনীতির সমর্থক হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সিরাজ শিকদারের মৃত্যুর পর তার সর্বহারা পার্টির সদস্যরা রাজনীতি থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় এবং ডাকাতিতে লিপ্ত হয়। জাসদের গণবাহিনী ও অন্যান্য চরমপন্থী সশস্ত্র গ্রুপের সর্বহারা পার্টির সংঘর্ষ চলতেই থাকে। ক্রমশ বাংলাদেশের উত্তর বঙ্গে খতমের রাজনীতির অস্ত্র ডাকাতদের হাতে চলে যায়।  বাংলাদেশের নকশাল রাজনীতি ডাকাতিতে পরিনত হয়, অসংখ্য মেধাবী তরুনরা বাংলাদেশে উগ্র বাম রাজনীতির এই ধারার করুন পরিনতির শিকার হয়। জাসদের গণবাহিনী, হক-তোয়াহা, মতিন-আলাউদ্দিন, টিপু বিশ্বাস, মোফাখ’খার চৌধুরীর কমিউনিস্ট গ্রুপ গুলো শ্রেনী শত্রু খতমের লাইন অনুসরণ করলেও বাংলাদেশে মনি সিং ও তোয়াহা, মতিন আলাউদ্দিন পরে প্রকাশ্যে রাজনীতিতে চলে আসেন, জাসদের নেপথ্যের সংগঠক সিরাজুল আলম খান এখনও রহস্যের বেড়াজাল দিয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। কোন ঘোষনা ছাড়াই জাসদের গণবাহিনী বিলুপ্ত হয়ে যায়,বিভিন্ন সময়ে জাসদের নেতা আ স ম আব্দুর রব, মরহুম শাজাহান সিরাজ ও হাসানুল হক ইনু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকারের মন্ত্রীত্ব  গ্রহন করেন। এদিক দিয়ে পশ্চিম বঙ্গের কমিউনিস্ট নেতা জ্যেতি বসুর রাজনীতি ছিল ভিন্ন, তিনি তার দল ও জোটকে নিয়ে সংসদীয় রাজনীতি করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যেতি বসু ও তার সাথীদের এবং বাংলাদেশের নেতৃত্ব স্থানীয় বামপন্থী নেতাদের রাজনীতি নিয়ে গবেষকদের অনেক কাজ এখনও বাকী রয়ে গেছে।

প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যেতি বসু লন্ডনে অধ্যয়নকালে ফ্যাসিবাদ বিরোধী দার্শনিক হ্যারহ্ব লাস্কির বক্তৃতা বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ছাত্রদের মাঝে আলোচিত হত। জ্যোতি বসু এ বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা করতেন। জ্যেতি বসুর সাথে পণ্ডিত নেহরুর বন্ধু কৃষ্ণ মেননের পরিচয় ঘটে। কৃষ্ণ মেনন একাধারে ছিলেন কূটনীতিক, নীতি নির্ধারক ও রাজনীতিক। নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কৃণ’স

 ১৯৩৬ সালে কমিউনিস্ট নেতা ভুপেশ গুপ্ত জেল থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডন পড়তে আসেন। তিনি লন্ডনের কমিউনিস্ট পার্টির যোগাযোগ স্থাপন করেন। এর মধ্যে ছিলেন হ্যারি পলিট, রজনি পাম দত্ত, বেন ব্রাডলি। বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টি ইন্ডিয়া লীগকে ও ভারতীয় ছাত্রদের সহযোগিতা করতেন। Mole in the Crown বইয়ের লেখক মাইকেল কারিট কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করতে ভারতে চলে আসেন। ভারতে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়েছিলেন। তিনি সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা হওয়ায় ভারতের গভর্ণরের সেক্রেটারি ও হয়েছিলেন। তার কমিউনিস্ট পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি পদত্যাগ করেন। বেঞ্জামিন ফ্রান্সিসি ব্রাডলি ও ভারতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক আন্দোলনে জড়িত থাকার কারনে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, ষ্ক্রমীরাট ষড়যন্ত্র মামলাম্ব নামে পরিচিত এই মামলায় তার জেল হয়েছিলো বলে জানা যায়।

প্রয়াত জ্যোতি বসু তার যতদুর মনে পড়ে স্মৃতি কথায় লন্ডনে থাকা কালে শুধু কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জড়িত হওয়া নয়, তিনি বিভিন্ন নেতাদের সাথে পরিচিত হওয়ারও সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন ভি কে কৃষ্ণ মেনন তাকে নেহরুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেণ। এ সময় বিজয় লক্ষি পন্ডিত এর সাথেও পরিচয় ঘটে। তিনি লিখেন তখন লন্ডনে  ট্রাফালগার স্কোয়ারে ২৬ শে জানুয়ারি একটি নিয়মিত বার্ষিক অনুষ্ঠান হত। ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনে থাকার  এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন বলে জ্যেতি বসু লিখেছেন। লন্ডনে ভারতীয়দের মজলিশ নামে একটি সংগঠন ছিল। এই সংগঠনের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন কর্মকান্ড চালাতেন পূর্ব লন্ডনে ভারতীয় জাহাজিদের গণস্বাক্ষরতাও তারা শুরু করেছিলেন। জ্যেতি বসু ঐ সময়ে শ্রীহট্ট থেকে আসা জাহাজীদের সংস্পর্শে এসেছিলেন বলে তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন। তিনি জাহাজী সিলেটীদের চিঠি পত্র লিখে দিতেন, এবং দাপ্তরিক কাজে সহযোগিতা করতেন। জ্যেতি বসু ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০১০ সালের ১৭ই জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। ভারতের বামপন্থী রাজনীতির দিকপাল জ্যেতি বসু সংসদীয় গণতন্ত্রের ভেতরে থেকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি অনুসরণ করেছিলেন।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close