ফিচার

আমেরিকার শিক্ষা ও বাংলাদেশ: শেষ পর্যন্ত কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়

{সাপ্তাহিক সুরমা’র অনুরোধে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, রাজনীতিবিদ ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে কৃতি ব্যক্তিত্ব এখন থেকে সুরমার পাঠকদের জন্য “বিশেষ কলাম” লিখবেন। এই বিভাগে প্রথম ছাপা হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটি’র সদস্য ড. আবদুল মঈন খান-এর তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ । – সম্পাদক}

লেখক: সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটি’র সদস্য। 

|| ড. আবদুল মঈন খান ||
গত ৬ জানুয়ারি আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি’র ক্যাপিটল হিলের ওপরে চরম ডানপন্থীদের দিনদুপুরের তান্ডব কি আমেরিকার শত শত বছরের গণতন্ত্রের গৌরবময় ইতিহাসে একটি ন্যক্কারজনক অধ্যায়? একটু গভীরে গিয়ে উত্তর দিতে গেলে আমি বলব, একইসঙ্গে হ্যাঁ এবং না। আপনারা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করতে পারেন এটা কেমন উত্তর এবং কিভাবেই তা যুক্তি গ্রাহ্য? আসুন আমরা বরং বিষয়টির নির্মোহ বিশ্লেষণে যাবার চেষ্টা করি।
ইন্টারনেটের কল্যাণে রাতভর (বাংলাদেশ সময়) এই অযাচিত ঘটনা প্রত্যক্ষ করে শঙ্কিত হয়েছি ঠিকই কিন্তু সম্ভবতঃ অবাক হবার কিছু ছিল না, কেননা ফ্রান্কেন্সটাইন সৃষ্টি করলে তার ফল তার জনককেই পেতে হয়। এবং বিগত চার বছর ধরে ঠিক সেটাই সৃষ্টি করেছিলেন প্রেসিডেনট ট্রাম্প নিজের জেদগুলো বজায় রাখার জন্য ।

এখানে মূল যে প্রশ্নগুলো আমাদের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে তা হলো – প্রথমতঃ যে “মুক্ত বিশ্বের” বড়াই আমেরিকা করে থাকে তার কি মৃত্যু ঘটছে ? দ্বিতীয়তঃ পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশের মানুষের অন্তরে কেন এত অশান্তি? কোথায় গেল তাদের সেই “এমেরিকান ড্রীম”? আর সবশেষে, সভ্যতা ও উন্নয়নের শীর্ষে পৌঁছে এখন কি তাদের অবক্ষয় শুরু হল ? হয়ে থাকলে তা কেন?

এ প্রসঙ্গে আমেরিকার বর্তমান “সোসিও-পলিটিক্যাল” প্রেক্ষিত বিবেচনায় আরো কয়েকটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এক, পৃথিবীর সবচাইতে সুরক্ষিত দেশের শীর্ষ সুরক্ষিত স্থান কংগ্রেসে কেমন করে অবলীলায় হাজার হাজার লোক শুধু ঢুকেই পড়েনি, এমনকি স্পীকারের কক্ষ তছনছ সহ মূল হাউজ চেম্বারে হামলা চালিয়ে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের জীবনের ওপর মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে, এমনকি ভাইস প্রেসিডেন্টকে পর্যন্ত নিরাপত্তার জন্য ভূগর্ভস্থ টানেলে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়েছে! এক পর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে এলোপাতাড়ি গোলাগুলি থেকে আত্মরক্ষার জন্যে কংগ্রেস সদস্যদের হাউসের মূল চেম্বারের অভ্যন্তরে বেঞ্চের নীচে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এর চেয়ে লজ্জাজনক পরিস্থিতি আর কি হতে পারে? এখানে খেয়াল করতে হবে, কি ধরণের মানসিকতা হলে অনুপ্রবেশকারীরা কংগ্রেসের দেয়াল ও মেঝেতে রাখা শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী স্মরণিকাগুলো ভাংচুর ও অপবিত্র করতে পারে ! একই সঙ্গে কংগ্রেস প্রাঙ্গণের ভেতরে পাইপগান সহ মলোটভ ককটেল এবং একটি ট্রাকভর্তি বোমা ও অস্ত্রের সন্ধান পায় নিরাপত্তা বাহিনী যা ঘটনাটির প্রচ্ছন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রশ্ন জাগে, অভ্যন্তরীণ যোগসাজশ ছাড়া সেখানে এতবড় নিরাপত্তা ব্যর্থতা কীভাবে হল? পরে শোনা যাচ্ছে আসলেই নাকি (ফেডারেল) ন্যাশনাল গার্ডদের কংগ্রেসের নিরাপত্তায় তাৎক্ষণিক যাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়ে ছিল।
দুই, বর্ণবাদের বিষয়টি। অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রশ্নটি হচ্ছে, “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার” মানবাধিকার আন্দোলনের সময় যদি প্রতিবাদকারীদের ওপর আইন শৃংখলা বাহিনী মুহূর্তে মারমুখী হয়ে ঝঁপিয়ে পড়তে পারে তাহলে শীর্ষ গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেসের ওপর “মাগা” হামলাকারীদের নিয়ন্ত্রণ ও বাধা দেয়ার জন্য কোন নিরাপত্তা বাহিনীকে তাৎক্ষণিক দেখা যায় নি কেন এবং কিভাবে অবলীলায় এ ধরণের নিরাপত্তা ব্যর্থতা সম্ভব হল? এমনকিএটাও লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, কোন কোন নিরাপত্তা কর্মীরা কংগ্রেসে অনুপ্রবেশকারীদের স্বাগত জানিয়েছে।
তিন, এই মারাত্মক হামলাকে দেশের আইনানুগ সরকার তথা সাংবিধানিক আইনসভাকে অকার্যকর করার ক্ষেত্রে ক্যু, এমনকি দেশেদ্রাহের অভিযোগে অভিযুক্ত করাও যুক্তিযুক্ত কি না সে বিষয়টিও এখন আর আলোচনার বাইরে নেই। এবং এক্ষেত্রে প্ররোচনাকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও প্রকাশ্য আলোচনায় চলে এসেছে। শুধু তাই নয়, তাদের সংবিধানের ২৫তম সংশোধনী সহ প্রেসিডেন্টেকে পুনর্বার অভিশংসন করার বিষয়টি নিয়েও এখন আর রাখঢাক নেই।

তবে পাশাপাশি এ কথাও সত্যি যে, চরম বিশৃংখলা ও ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসের পরেও কিন্তু আমেরিকানরাই আবার সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ একটি পরিবেশ অতি দ্রুত ফিরিয়ে এনেছে ও কংগ্রেস তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছে। তদুপরি তাৎক্ষণিকভাবে তারা এই ব্যর্থতার দায়ভার নিশ্চিতকরণ শুরু করে দিয়েছে। এসব দায়িত্বসম্পন্ন কার্যকর পদক্ষেপের কারণ হল একটিই। আর তা হচ্ছে শত শত বছর ধরে তারা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে এবং সম্পূর্ণ স্থিতিশীল কিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে যা কোন ব্যক্তির ওপরে নির্ভরশীল নয়, বরঞ্চ সেগুলো প্রায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাজে সংগঠিত অপ্রত্যাশিত “শক এবজর্ভ” করার ক্ষমতা রাখে। আমরা দেখলাম সকাল হবার আগেই কংগ্রেস সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পূর্ণ প্রক্রিয়াকরণ সমাধা করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে তাঁর সঠিক জায়গায় বসিয়ে দিয়েছে, যে ঐতিহ্য আমরা এখনও সৃষ্টি করতে পারিনি। মনে রাখতে হবে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই গণতন্ত্রের প্রতীতি আমরাও যেদিন অর্জন করতে পারব, সেদিনই আমরা একটি গর্বিত জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো।
ঢাকা, ১২ জানুয়ারী,২০২১।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close