ফিচার

মন্তব‍্যকথা: বাকস্বাধীনতার হিস্টিরিয়া ও কর্পোরেট ম্যানস্লটার

।। মোহাম্মদ শাহ আলম ।।
হিস্টিরিয়াগ্রস্ত সিলেক্টিভ বাকস্বাধীনতাবাদীদের স্বস্তি ফিরে এসেছে বোধ করি, আপাতত। তবে অপরাজনীতির গন্ধ শুঁকছেন এখনো অনেকেই। রাজনীতি খোদ নিজেই পুরোপুরি একটা অপচর্চা রূপেই হাজির যেখানে; বাকপটুতার সাথে মিথ্যা কথন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে জনগণের সাথে ঠকবাজি, শঠতা, প্রতারণা, প্রতিদ্বন্দ্বির সাথে শত্রুতার আচার, সরকারের পরিচালনা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার দায়দায়ীত্বকে “ক্ষমতা” উপভোগ ও “ক্ষমতা” জাহির করার উপায় হিসেবে জানা ও মানা – রাজনীতি যেখানে এই, সেখানে রাজনীতি থেকে আলাদা করে অপরাজনীতি খোঁজা! আহা! সাধু! সাধু!

স্বস্তির কারণ, নাইমুল আবরার খুনের মামলায় মতি গ্যাংয়ের জামিন হয়েছে। গ্রেফতার হয়ে দিন কয়েকের জন্য তাদের ফাটকে যেতে হয়নি। ফাটকে যে যেতে হবে না, পরোয়ানা জারি হলেও, সেটা আমাদের বোধের অগম্য ছিলো না। তবু হিস্টিরিয়াগ্রস্ত পোগতিশীলরা মাতম শুরু করেছিলো, একটি বিশুদ্ধ খুন-মামলাকে (homicide case) বাকস্বাধীনতার আচ্ছাদন পরিয়ে। ইস্তক বৃদ্ধ আইনজ্ঞ মাকাল হোসেনও এ দলে শামিল। বিস্ময়কর!

১লা নভেম্বর হতভাগ্য রেসিডেন্সিয়াল বালক নাইমুল খুন হয় অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণভাবে ছড়িয়ে রাখা বিদ্যুত তারের স্পর্শে। পত্রিকান্তরে ঘটনার বিস্তারিত জানার পরই ক্ষুদ্রস্য ক্ষুদ্র নাগরিক হিসেবে অতি ক্ষীণ কন্ঠে সোস্যাল মিডিয়ায় আওয়াজ দিয়েছিলাম এটা খুন, এই খুনের দায় মতি গ্যাং এড়িয়ে যেতে পারে না। এই খুন (homicide) কর্পোরেট ম্যানস্লটার।

খুনের শিকার নাইমুলের পিতা ৬ নভেম্বর আদালতে মামলা দায়ের করেন। মোহাম্মাদপুর থানার পুলিশ প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউররহমানসহ ১০ জনের নামে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর বাদীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত গ্যাঙ দশমের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন। যাদের নামে পরোয়ানা জারি হয়েছে, তারা হলেন প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক, হেড অব ইভেন্ট এণ্ড একটিভেশন কবির বকুল, নির্বাহী শুভাশীষ প্রামাণিক, নির্বাহী শাহপরাণ তুষার, কিশোর আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মহিতুল আলম, ডেকোরেশন ও জেনারেটর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের জসীম উদ্দিন, মোশাররফ হোসেন, সুজন ও কামরুল হাওলাদার।

দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া এই মৃত্যকে আমরা কেন খুন বলছি? মৃত্যু মাত্রেই দুর্ঘটনা, সুঘটনা নয়। কারণ, জন্মিলে মরিতে হয়, মৃত্যু অমোঘ ও অবধারিত, যথা সময়ে আসবেই এই সত্য জেনেও আমরা কেউ মৃত্যুর সাক্ষাৎ পেতে চাই না। তবে সব মৃত্যুই শুধু মৃত্যু না, মৃত্যুর পেছনে অন্য অনাকাঙ্খিত কারণ হাজির থাকলেও। কোন মৃত্যু খুন আর কোন মৃত্যু খুন নয়, সেটা আইনই নির্ধারণ করে রেখেছে। এবং সেটা বুঝতে পারার জন্য সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন বিচারবোধ থাকলেই চলে। ওইটুকু বুঝার জন্য বড় আইনজ্ঞ হবার দরকার পড়ে না। আইনও কাণ্ডজ্ঞানের অতিরিক্ত কিছু না। Law is codification of common sense।

আইনের খুঁটিনাটি জটিল ভাষার দিকে না গিয়ে সাধারণভাবে বলা যায়, যে মৃত্যুর সাথে কারণ হিসেবে কারো কোন ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ক্রিয়াকাণ্ড যুক্ত থাকে সেটাই খুন। আইনের ভাষ্যে খুন (homicide) তিন শ্রেণীর। একজনের বেপরোয়া (reckles) ক্রিয়া, অবহেলা (negligence), অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, অথবা যে কোন ধরনের ক্রিয়াকর্মে অনিচ্ছাকৃতভাবে অন্যের মৃত্যু ঘটলে সেটা থার্ড ডিগ্রি মার্ডার তথা আইনের পরিভাষায় “ম্যানস্লটার”। পূর্ব পরিকল্পিত হত্যকাণ্ডকে ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার এবং পূর্ব থেকে হত্যার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু উত্তেজনাকর মুহুর্তে জিঘাংসা তাড়িত হয়ে বেপরোয়া ক্রিয়ার মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে একজন অন্য একজনকে হত্যা করলে বা এভাবে একজনের আক্রমণের শিকার হয়ে আরেক জন মারা গেলে এই হত্যাকাণ্ড সেকেণ্ড ডিগ্রি মার্ডার বলে গন্য হয়। অপরাধের মাত্রা বা গুরুত্ব-লঘুত্ব বিবেচনার দিক থেকে “ম্যানস্লটার”কে “মার্ডার” তুলনায় অপেক্ষাকৃত লঘু গন্য করা হয়।

“ম্যানস্লটার” আর “মার্ডার”এর প্রভেদ অধুনা বা নতুন কিছু না। প্রাচীন এথেনিয়ান আইন প্রণেতা ডারকো সেই খৃস্টপূর্ব সপ্তম শতকে এর আইনী ফারাক নির্ণয় করে দিয়ে গেছেন এবং common law legal term হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আছে। অতএব হতভাগ্য বালক নাইমুলের খুনকে নির্দোষ ও দায়হীন দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেবার সুযোগ নাই। তার পিতামাতা ও পরিজনের এর বিচারিক প্রতিকার পাওযার অধিকার অাছে।

তবে, দায় কার? এধরনের খুনের দায় বর্তায় সেই ব্যক্তি বা বর্গের উপর, ব্যবস্থাপনার দায়ীত্বে থেকে যত্নশীলতা বা সতর্কতার গুরুতর লঙ্ঘনের ফলে সৃষ্ট ব্যবস্থাপনার সর্বোত ব্যর্থতার দায় যার বা যাদের। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সর্বাগ্রে আসে প্রথম আলো তথা মতি গ্যাং। দ্বিতীয়ত আসে যৌথভাবে সেই ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠান, আলোকায়ন ও অন্যান্য প্রয়োজনে বিদ্যুত সংযোগের কাজ যারা করেছে। এতে দায়টা একক কোন ব্যক্তির না হয়ে সমষ্টিগতভাবে তথা কর্পোরেটের উপর আসে।

আইনে এটাই কর্পোরেট ম্যানস্ললটার। সোজা কথায় যে খুন সংঘটিত হয় কোম্পানী বা সংস্থার ক্রিয়া কর্মের ফলে, কর্তব্যে অবহেলা (negligence) এবং বেপোরয়া (reckless) কর্মের ফলে। মতিউর রহমান এখানে ব্যক্তি হিসেবে অভিযুক্ত নয়, অভিযুক্ত juristic person তথা সংশ্লিষ্ট কর্পোরেট বোডির অংশ হিসেবে।

বিজ্ঞ মাকাল হোসেন গং এটা বোঝেন না বা জানেন না, আমাদেরকে এটা বিশ্বাস করতে হবে! তবে কেন তিনি মতি গ্যাংয়ের পেছনে সারিবদ্ধ হলেন! কারণ, তিনি যেমন “বিশিষ্ট” নাগরিক, মতি গ্যাংরাও “বিশিষ্ট” নাগরিক। বার্ডস অব এ ফিদার – এক পালকের পাখী। এক ঝাঁকে থাকতেই হবে। অবিশিষ্ট নাগরিকের সন্তান নাইমুলের প্রাণের মূল্য এদের প্রাণের চাইতে তুচ্ছ। অবিশিষ্ট নাগরিক নাইমুলের পিতা বিচারিক প্রতিকার পেতে পারে না। আসুন বিশিষ্ট নাগরিকের খেঁতা পুড়ি!

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close