সুরমার সঙ্গে মুজিবুর রহমান মঞ্জু: ‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ সেক্যুলার ভাবনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বরং সহযোগী হবে
‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ – এই শ্লোগান নিয়ে মুজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্চ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি মুখে এই চ্যালেঞ্জের কথা উচ্চারণ না করলেও নতুন মোড়কে এমন ধারার রাজনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে আমরা মনে করি। জনাব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি, তিনি বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের রুকন এবং কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরা সদস্য থাকাকালীন দল থেকে তাকে বহিঃষ্কার করা হয়। জামায়াত নেতা ব্যারিষ্টার আব্দুর রাজ্জাক এ বছর জামায়াত থেকে পদত্যাগ করলে এর জের হিসেবে মুজিবুর রহমান মঞ্জুকে বহিঃষ্কার করা হয় বলে অনেকের ধারণা।
‘জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’-এর নেতা মুজিবুর রহমান মঞ্জু গত ১৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে বেড়াতে আসেন।
এ উপলক্ষে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সুরমার পক্ষ থেকে তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি অনেক কিছুই খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেন। তিনি এও বলেন, জন-আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ-এর সঙ্গে সেক্যুলার ভাবনা কোনো সাংঘর্ষিক নয় বরং সহযোগী হবে। বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নিম্নে তুলে ধরা হলো:
সাপ্তাহিক সুরমা: জন আকাঙ্ক্ষা আর জন বাসনাই বলুন সেটা বুঝার জন্য কোন ধরণের উপকরণকে আপনারা গুরুত্ব দেবেন?
মুজিবুর রহমান মঞ্জু: আমাদের থিমটা হলো ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ অর্থাৎ এদেশের গণ মানুষ নিজের দেশটাকে কেমন দেখতে চায়? তারা নাগরিক হিসেবে দেশ থেকে কী চায়? সেটাই আমরা বুঝাতে চেয়েছি। আমাদের লক্ষ্য হলো জন মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ টা গড়ার জন্য কাজ করা। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা বা বাসনা বোঝার জন্য আমরা রাষ্ট্রের কাছে মানুষের যে মৌলিক অধিকার গুলো রয়েছে অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্হান, জীবনের নিরাপত্তা, ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার বা সুশাসন, ধর্মীয় স্বাধীনতা এগুলোকে সবচাইতে বেশী গুরুত্ব দেব।
সুরমা: মুক্তিযুদ্ধটা জন আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ছিলো, সেটা বুঝতে এতো বছর লাগলো কেন? ১৯৮২ সালে ছাত্রশিবির ও জামায়াতের মধ্যে এমনই এক ক্রান্তিকাল আমরা দেখেছি, যার মধ্যে ৭১-এর বিষয়টিও উল্লেখ রয়েছে। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাংলার সাধারণ মানুষজন বুঝেন কিন্তু আপনাদের ঘরানার মধ্যে এটি না-বুঝার তীব্রতা এতো প্রকট কেন?
মুজিবুর রহমান মঞ্জু: দেখুন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে কেবল একটি পৃথক দেশ পাওয়া মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিলনা। মানুষের আকাঙ্ক্ষা ছিল এই স্বাধীন দেশটাতে পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য থাকবে না এখানে সকল নাগরিকের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। ভাষা, জাতীয়তা বা ধর্মের ভিত্তিতে নয় বরং মানুষ হিসেবে প্রত্যেক নাগরিকের মানবিক মর্যাদা সমুন্নত থাকবে এবং দেশে নযায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করা হবে। মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোন বিষয় নয় এটি একটি রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারাবাহিক সাফল্য বা পরিণতি। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তা যথাসময়ে উপলব্ধি না করলে ভুলের মাশুল অনেক চড়া হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মাঝে কম বেশী ভুল সবাই করেছে। যার ফলে চড়া মূল্যও সবাই দিয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের মহা নায়ক শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করে যে ভুল করেছেন তার ফল মারাত্মক অশুভ হয়েছে। বিএনপি কেয়ারটেকার সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে সেই কেয়ারটেকার ব্যবস্থা বাতিল করে যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে তার ফল তাদেরকে ও সমগ্র জাতিকে ভোগ করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। জামায়াত স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়নি বরং বিরোধিতা করেছে। সেই স্বাধীন দেশে একই নাম নিয়ে একই নেতৃত্ব বহাল রেখে রাজনীতি করেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রসঙ্গে তারা নিজেদের কোন অবস্থান পরিস্কার করতে পারেনি। ৭১-এ তারা কী সঠিক করেছে ? না ভুল করেছে তা আজও তাদের নিজের কাছেও পরিস্কার নয়। এই ভুলের জন্য তাদের কে শুধু চড়া মূল্যই দিতে হয়নি রাজনীতিতে তারা আওয়ামীলীগ বিএনপি সহ সবার কাছে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে কোনঠাসা হয়ে আছে।
৮২ সাল শুধু নয় ৭৭ সালেই শিবির গঠনের সময় থেকে ৭১ প্রসঙ্গ আলোচনায় এসেছে। যার ফলে ছাত্রসংঘ নাম বদলিয়ে ছাত্রশিবির করা হয়েছিল। ছাত্রশিবির জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন নয় – এটা শুরু থেকেই বলার অন্যতম কারণ ছিল ৭১-এ জামায়াতের প্রশ্নবিদ্ধতা যাতে শিবিরকে স্পর্শ না করে। অতএব এই উপলব্ধি শুধু আমি বা আমরা করেছি তা বলা ঠিক হবেনা। উপলব্ধিটা অল্প বিস্তর সব সময় ছিল। একটি আদর্শবাদী, নিয়মতান্ত্রিক সংগঠন হবার কারণে উপলব্ধির বিষয়টা এতদিন বাইরে আসেনি এটা আপনি বলতে পারেন। তাছাড়া আরেকটি বিষয় আমি বলতে পারি তা হলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে যারা দাবীদার তাদের অপ রাজনীতি, দুর্নীতি, লুটপাট ও দূঃশাসনের কারণে মানুষ স্বাধীনতার সুফল পায়নি। জামায়াত সহ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধীতাকারী অনেক নেতৃত্ব এ কারণেও একথা বলার সুযোগ পেয়েছে যে স্বাধীনতা যুদ্ধে শুধু দেশে ভাগ হয়েছে জাতির কোন মুক্তি আসেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদেরকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তাকারী প্রতিবেশী ভারতের স্বাধীনতাত্তোর ভূমিকাও এই উপলব্ধি না বোঝাকে প্রকট করার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বলে আমরা মনে করি।
সুরমা: আমরা যদি বলি ইসলামী রাষ্ট্র বলতে কোনো কিছু নেই বা কোনো কালে ছিলো না – এ ব্যাপারে আপনি কি বলবেন?
মঞ্জু: এই সম্পর্কে মন্তব্য করা খুব কঠিন। আমাদের দেশে ‘ইসলাম’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে ‘রাজাকার’ বা ‘নাস্তিক’ হয়ে যাবার ভয় থাকে। ফলে কথা বলতে খুব ভয় হয়। আমি যতটুকু বুঝি বর্তমান রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বলতে ইসলামী শরীয়াহ’র ভিত্তিতে পরিচালিত যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা তাকে বোঝানো হয়েছে। রাসূল (স:) এর নেতৃত্বে মদীনা সনদের ভিত্তিতে মদীনায় প্রথম যে রাষ্ট্র ব্যবস্থার গোড়া পত্তন করা হয় সে রাষ্ট্র কিন্তু ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী ছিলনা। কারণ তখনো শরীয়াহ’ই পরিপূর্ণ ভাবে অবতীর্ণ হয়নি। তাহলে তৎকালীন মদীনা রাষ্ট্র কি ইসলামী রাষ্ট্র ছিলনা? সেটা কী ধরনের রাষ্ট্র ছিল? সর্বশ্রেষ্ঠ নবী (স.) কী ইসলামী রাষ্ট্র ছাড়া অন্য কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেন? রাসূল (স.) এর ওফাতের পর যারা খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা তো অনেক নতুন নতুন সংস্কার এনেছেন বিধি বিধান যুক্ত করেছেন। শোনা যায় ওমর (রা.) এর সময় শরীয়াহ’র কিছু বিধি বিধান সাময়িক সময়ের জন্য স্থগিতও রাখা হয়েছিল। তাহলে ওই সময় কি সেটাকে আমরা ইসলামী রাষ্ট্র বলতে পারি? এসব প্রশ্ন ব্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষণের দাবী রাখে। খোলামন ও যুক্তি দিয়ে এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে সঠিক উত্তরটি পাওয়া যাবে।
সুরমা: লৌকিক এবং ইহলৌকিক রাষ্ট্রভাবনাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
মঞ্জু: আপনার প্রশ্নগুলো খুব তাত্বিক ও জটিল। মনেহচ্ছে যেন পরীক্ষার হলে পরীক্ষা দিচ্ছি। আমি এমনিতে তত্ব টত্ব বুঝি কম। এরকম প্রশ্নের উত্তর এভাবে দিতে গেল ভুল বোঝাবুঝির যথেষ্ট অবকাশ তৈরী হবে। তবুও যেহেতু জিজ্ঞেস করেছেন তাই বলছি- লৌকিক শব্দের অর্থ আমি যা বুঝি তা হলো ‘লোক দেখানো’ অর্থাৎ চাক্ষুষ দৃষ্টিতে মানুষ যা দেখে বুঝতে পারে। আরও সহজ ভাবে বললে বলতে হয় নগদ যেটা পাওয়া যায় সেটাই লৌকিক। ইহলৌকিক হলো যার ফলাফল বা উপকার দুনিয়াতেই দৃশ্যমান হয়। ইহলৌকিক শব্দের ইংরেজী করা হয়েছে ‘সেক্যুলার’। যার বিপরীত শব্দ হলো পারলৌকিক। পারলৌকিকতার চুড়ান্ত ফল দুনিয়াতে পুরো দৃশ্যমান হবেনা তার চুড়ান্ত ফল পাওয়া যাবে পরকালে। পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র চিন্তাবিদদের মতে রাজনীতি হলো ইহলৌকিকতার ব্যপার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষের ইহলৌকিক বিষয়াদি সমাধান করা। আর ধর্মের কাজ হলো পারলৌকিক। তাই তারা ধর্ম আর রাজনীতির ক্ষেত্র কে আলাদা মনেকরেন। কিন্তু ইসলাম ধর্মের বিধানে পারলৌকিক সাফল্য কে ইহলৌকিক বিষয়ের উপর নির্ভরশীল করা হয়েছে। ব্যক্তির ইহলৌকিক কাজের উপরই তার পারলৌকিক সাফল্য বিচার করা হবে। সেজন্য একটা বড় অংশের ইসলামী তাত্ত্বিকগণ রাজনীতিকে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ কাজ মনেকরেন। তারা ইসলাম ও রাজনীতিকে আলাদা মনেকরেন না। এই বিবেচনায় ইসলাম ও সেক্যুলারিজমের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আমি মনেকরি ইসলাম সেকুলারিজম বা ইহলৌকিকতাকে ধারণ করে। সমস্যা হচ্ছে ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের অর্থ করা হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা। এটা ভুল বলে আমি মনেকরি। একজন মানুষ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেনা যদি না সে ধর্মহীন মানুষ হয়। একজন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ কে প্রতিদিনই ইহলৌকিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। যেমন সে খাদ্য গ্রহণ করে, কাপড় পরিধান করে, গাড়ীতে চড়ে, কলম দিয়ে লিখে, কাগজ, ঘড়ি, চশমা, মোবাইল ফোন ইত্যাদি ব্যবহার করে এগুলো সব ইহলৌকিক কাজ। এই ইহলৌকিক কাজটা সে যখন ধর্মের নিয়ম মেনে করে তখন সেটাও তার পারলৌকিক পুরস্কারের মাধ্যম হয়ে যায়। বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ধারনা কে ধর্মহীনতার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরও দূ:খজনক ব্যপার হচ্ছে সেক্যুলারিজম এবং ইসলাম কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। এটা ভয়ানক অজ্ঞতা ও বিপদজনক ইন্টারপ্রিটেশনের ফল। সার্বিক বিচারে একজন মুসলিম হিসেবে আমি ইহলৌকিক রাষ্ট্রভাবনার সাথে ইসলামের কোন বিরোধ দেখিনা।
সুরমা: সেক্যুলার বা লৌকিক রাষ্ট্রভাবনার সঙ্গে জন আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্রচিন্তা সম্পুরক হবে না সাংঘর্ষিক হবে?
মঞ্জু: না সাংঘর্ষিক হবেনা। প্রথম দিকে হয়তো অনেকে না বুঝে আমাদের নীতি ও অবস্থানের বিরোধিতা করবেন কিন্তু যুক্তি, জ্ঞান ও বিবেক দিয়ে বিবেচনা করলে তারা একসময় বুঝতে পারবেন বলে আমরা আশাবাদী।
সুরমা: আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘জন আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ’ ঘা খাওয়া জামাত ব্লকের বাইরে যেতে পারছে না। যদি বলি আপনারা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রের দিকেই ধাবিত, এ ব্যাপারে কী বলবেন?
মঞ্জু: আমার যেহেতু একটা অতীত আছে এবং আমি যেহেতু এই উদ্যোগের সমন্বয়ক সেহেতু শুরুর পূর্বে এরকম দৃশ্যমান হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমরা যখন আমাদের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তবনা, ইশতেহার ও দল দাঁড় করিয়ে ফেলতে পারব তখন ধীরে ধীরে সব ব্লকের লোকেরা আশা করি এখানে যুক্ত হবেন। আমরা ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ হতে চাই সেজন্যই তো সবার কাছে যাচ্ছি। ক্ষুদ্র, মাঝারি, বৃহৎ সবার পরামর্শ ও মতামত নিচ্ছি। যদি আমাদের নীতি, আদর্শ ও কর্মপন্থা হয় সকলের উত্তম চিন্তার সমষ্টি তাহলে সময়ের সাথে সাথে আমরা অবশ্যই বড় হতে পারব ইনশাআল্লাহ। ইতিমধ্যে অনেক বেশী সম্ভাবনাময় সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। আমরা আপনাদেরও সবার সহযোগিতা চাই।