নিউজ

৭৪’র দুর্ভিক্ষ, বাসন্তী’র ছবি ও ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ হত্যাকাণ্ড …

মার মন্তব‍্যকথা
।। শামসুল আলম লিটন ।।


তরুণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি রাজধানী ঢাকায় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২০১২ সালে। পরের বছর ২০১৩’তে ঢাকায় একই রকম আরেকটি নৃশংস ঘটনায় খুন হন বিশিষ্ট আলোকচিত্র সাংবাদিক চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষে বাসন্তী-দুর্গতির ছবি তুলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি পাওয়া আফতাব আহমেদ। ঢাকার বাংলা মিডিয়ায় কর্মরত আছেন প্রায় পাঁচ হাজার সাংবাদিক আর বিশ্বব্যাপী আরো কয়েক হাজার। কিন্তু গত সাত বছরে প্রবাদপ্রতিম ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী লেখনী এবং প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করার দাবি জানানোর সময়ও কারো হলো না।  পেশায় একজন চিকিৎসক, ব্লগার এবং গবেষক মিষ্টার পিনাকি ভট্টাচার্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তথ্যবহুল লেখার মাধ্যমে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমরা মেরুদন্ডহীন একটি পেশাজীবী শ্রেণী হিসেবে আসলে কী করি, আর আমাদের কী করা প্রয়োজন?

১৯৭১ সাল, ১৬ ডিসেম্বর, নিয়াজির আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের এই ঐতিহাসিক ছবি

এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তদন্ত ও প্রকৃত খুনীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততা সঙ্গত কারণেই অসংখ্য প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ঢাকায় ঘনবসতিপূর্ণ রামপুরায় এই খুনের ঘটনাকে ডাকাতি বলে চালিয়ে দেওয়া একটি ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রীয় অপরাধ। সাগর-রুনির খুনের তদন্তেও একই নেরেটিভ ব্যবহার করা হয়েছে। ভাবখানা এমন, ঢাকা এখন ডাকাতদের শহর এবং এ কারণে ডাকাতদের দায়মুক্তিও (ইনডেমনিটি) দেয়া আছে। তারা ইচ্ছেমতো ডাকাতি করতে পারবে, বাধা দিলে খুনও।

৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। বাসন্তি লজ্জা নিবরণের জন‍্য জাল পরিধান করে আছেন। এই ছবি কি আফতাব আহমদকে আজও পাকশালিদের শত্রু বানিয়ে রেখেছে?

রশিদ তালুকদার’র পরেই বাংলাদেশের প্রবীণ ফটোসাংবাদিক ইত্তেফাকের আফতাব ভাই। পশ্চিম রামপুরায় তাঁর একই রাস্তায় আমিও থাকতাম। এলাকায় সবাই তাঁকে সমীহের চোখে দেখতেন। আর ঘনবসতিপূর্ণ রামপুরার  ওই এলাকায় ডাকাতি এত সহজ নয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, গত ২০ বছরে পশ্চিম রামপুরায় ওয়াপদা রোড, ওমর আলী লেন এবং মহানগর প্রজেক্টে এই একটি তথাকথিত “ডাকাতি”র ঘটনাই হয়তো ঘটেছে। তার মানে কিন্তু খুবই পরিষ্কার!

চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ দিনগুলোতে চরম খাদ্য সংকটের শিকার হয়েছিলেন উত্তরাঞ্চলের বাসন্তী দুর্গতির মত লাখ লাখ মানুষ। দুর্ভিক্ষে দেশব্যাপী মানুষের হাহাকার কে চিত্রায়িত করতে ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমেদ ছুটে যান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে । দুর্গতি ও বাসন্তীর এই একটি ছবি বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষকে চিত্রায়িত করতে সক্ষম হয়েছিল। এই ছবিটিকে তৎকালীন সরকার এবং পরবর্তী সময়ে একটি মহল রাজনৈতিক অপপ্রচার বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অথচ ২২ নভেম্বর ১৯৭৪ জাতীয় সংসদে তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছিলেন অনাহারে ও বিভিন্ন রোগে সাড়ে ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যুর তথ্য। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক বর্ষপঞ্জি ১৯৭৪)।

এই একটি ছবি তোলার অপরাধে ফটোসাংবাদিক আফতাব আহমেদের জীবনে নেমে আসে নানারকম অপমান ও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হামলার ঘটনা।  প্রেসক্লাবে ও ঢাকার গণমাধ্যম পাড়ায় নিজ গোষ্ঠীর (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সাংবাদিক ইউনিয়নে তিনি আওয়ামী গ্রুপের সমর্থক ছিলেন) সহকর্মীদের কাছ থেকে অসম্মান। জীবিত অবস্থায় তাঁকে বিভিন্ন সময়ে জনসমাজে অনেক অপদস্তও হতে হয়েছে। অত্যন্ত প্রবীণ এবং বিখ্যাত এই সাংবাদিকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর সুষ্ঠু তদন্ত ও প্রকৃত হত্যাকারীদের গ্রেফতার এবং বিচারের দাবিতে সাংবাদিক ইউনিয়ন অথবা আফতাব ভাইয়ের সহকর্মীদের পক্ষ থেকে কোন আন্দোলন-সংগ্রাম এমনকি তদন্তের দাবি জানাতে ও দেখা যায়নি। তার মানে হচ্ছে, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মতই আফতাব হত্যাকাণ্ডও একইভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে । পার্থক্য এতোটুকু, সাগর-রুনির বন্ধু/ সহকর্মীরা খুনের তদন্ত ও বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। আর আফতাব ভাইয়ের সহকর্মীরা ডাকাতি ঘটনার আবরণে তাঁর জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়েছে প্রতিশোধ গ্রহণকারীদের পদতলে।

সূত্র: ইত্তেফাক বর্ষপঞ্জি, ১৯৭৪

পিনাকী ভট্টাচার্যের মূল লেখা: 
আমার লেখা প্রকাশিতব্য “স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ” বইটা লেখার সময় রিসার্চ করতে গিয়ে সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কার হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিলগুলোকে যে গায়েব করে দেয়া হয়েছে সেটা জানতে পারা।
পুরনো আর্কাইভ ঘাটতে গিয়ে দেখেছি মাঝ থেকে একটা দুইটা পাতা হাওয়া, ঠিক যেখানে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য থাকার কথা ছিলো। মুজিব আমলে সরকার ও শাসকদলের বিভিন্ন কুকীর্তির ইতিহাস এভাবেই হাপিস করে দেয়া হয়েছে। 
হাপিস করে দেয়া হয়েছে “জাল পরা বাসন্তী” নামের এই তুমুল আলোচিত ছবিটাও।
১৯৭৪ সালে সরকারী অব্যবস্থায় দেখা দেয় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। সারা দেশ জুড়ে শুরু হয় ঘরে ঘরে অভাব। আকালের মারণ ছোবলে শত শত মানুষ তখন ভুখা-নাঙ্গা। প্রতিদিন পত্রিকার পাতা জুড়ে দুর্ভিক্ষের শিকার মৃত মানুষের সচিত্র দলিল। সারা দেশের আকাশ বাতাস তখন ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে উঠেছে। সরকারী হিসাবেই তখন দুর্ভিক্ষের কারণে তিরিশ হাজার মানুষ মারা যায় বলে জানানো হয়।  
সেই সময়ে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ এই “জাল পরা বাসন্তী” ছবিটা তোলেন। ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় ছাপা হয় ছবিটা। বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের রূপ সারা দুনিয়াতে এই ছবির মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়।
ছবিতে দেখা যায় বাসন্তী নামের এক যুবতী তার সমস্ত শরীরে মাছ ধরার জাল পরে লজ্জা নিবারণের মিথ্যে সান্তনা বুকে নিয়ে কলা গাছের ভেলায় চড়ে কলাগাছের মাঞ্জা বা পাতা সংগ্রহ করছেন। সেই ভেলায় আরেকজন নারী শ্রীমতি দুর্গতি রাণী বাঁশ হাতে ভেলার অন্য প্রান্তে বসে নিয়ন্ত্রণ করছেন বন্যার পানিতে ভেসে চলা ভেলাটিকে। চরম দারিদ্র আর তার সাথে মিলিত ক্ষুধার দুঃসহ প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে ছবিটা। দেশে-বিদেশে তোলপাড় শুরু হয়। বাসন্তীর জাল পরা ছবিটিকে ঘিরে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে ক্ষমতাসীন শেখ মুজিব সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে ছবিটিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়। 
অথচ কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে,  ইত্তেফাকের সেই আলোকচিত্রী আফতাব আহমেদকে বাসন্তীর কাছে যে নিয়ে গিয়েছিল সে ছিলো আওয়ামী লীগের গ্রাম-পর্যায়ের এক কর্মী। তার নাম ছিলো আনসার আলী। আফতাব আহমেদ পরবর্তীতে একুশে পদক পান।

আফতাব আহমেদ ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা চিত্র সাংবাদিক। আমরা ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে জেনারেল নিয়াজী যে আত্মসমর্পণের দলিল পড়ছেন সেই বিখ্যাত ছবিটা দেখি, সেটাও তুলেছিলেন আফতাব আহমেদ।

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এখনো জোর প্রচার চালানো হয় “জাল পরা বাসন্তী” ছবিটা সাজানো ছবি ছিলো। কিন্তু ছবিটা সাজানো ছিলো না।
বাসন্তীর এই ছবিটাও গায়েব করে দেয়া হয়েছে। মূল ছবিটা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সেটাকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করা গেছে। হাই রিজল্যুশন ছবিটার একটা কপি আমি সংগ্রহ করেছি। কার কাছে থেকে সংগ্রহ করেছি সেটা আর আজ না বলি।

আফতাব আহমেদের উপরে আওয়ামী লীগের প্রচণ্ড রাগ ছিলো। তারা মনে করে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের জন্য আফতাব আহমেদের তোলা ওই বাসন্তীর ছবিটার বড় ভূমিকা আছে। 
২০১৩ সালে ৬৩ নম্বর পশ্চিম রামপুরার ওয়াপদা রোডের চারতলা বাসার তৃতীয় তলায় খুন হন ইত্তেফাকের সাবেক প্রধান ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ। প্রচার করা হয় ডাকাতেরা ডাকাতি করতে এসে আফতাব আহমেদকে খুন করে যায়।

তিনি যখন খুন হন তখন তিনি বৃদ্ধ মানুষ। বাড়িতে একা থাকতেন। কোনো শত্রু ছিল না তার। কারো সঙ্গে কোনো বিষয়ে বিরোধও ছিল না। তাকে যারা হত্যা করে তারা কি সত্যি ডাকাত ছিলো? এক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ মানুষের বাসস্থান কেউ ডাকাতির জন্য লক্ষ্য করেছিলো তা কি সহজে বিশ্বাস করা যায়?
আফতাব আহমেদ ২০০৬ সালে বিএনপির আমলে, তাঁর ফটোসাংবাদিকতায় অবদানের জন্য একুশে পদক পান। ২০১০ সালে আফতাব আহমেদ চিকিতসার জন্য ভারত যান। ভারত থেকে ফিরে এসে দেখেন যে, ঘরের সবকিছু তছনছ করা। আফতাব আহমেদের মেয়ে তখন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলো,  “গেট ভেঙে বাবার সোনার পদক (একুশে পদক) চুরি হয়েছে। কত পুলিশ কত সাংবাদিক আসলেন। কাউকেই আটক করা হয়নি।” 
তারিখগুলো খেয়াল করুন ২০১০ সালে বাসা তছনছ করে একুশে পদক চুরি। ২০১৩ সালে খুন। ডাকাতি বলে সেই খুনের মামলা ধামাচাপা দেয়া। 
এখন কি আফতাব আহমেদের খুনটা স্বাভাবিক বলে মনে হয় আপনার? 
আমার মনে হয়না। 
আফতাব আহমেদকে খুন করা, তার আগে একুশে পদক চুরি করা এসবের সাথে কি বাসন্তীর জাল পরা ছবির কোন যোগসূত্র আছে?

নিশ্চয়ই ইতিহাস একদিন আফতাব আহমেদের হত্যাকান্ডের পুনঃতদন্ত করবে। আমি আফতাব আহমেদের কেইসটা রিপোর্টারস উইদাউট বর্ডারের গোচরে আনবো। যেন তারা এটা ডকুমেন্ট করেন। আমার পাঠকের জন্য বাসন্তীর জাল পরা ছবিটা দিলাম। নতুন প্রজন্মের জানা দরকার যাকে আওয়ামী লীগ স্বর্ণযুগ বলে পরিচয় করিয়ে দেয় তা আসলে কেমন বীভৎস দুঃশাসন ছিলো।


Source:https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=3748468045179048&id=100000476686357&sfnsn=mo

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close