- এই সঙ-সদকে সুন্দর বলা যায় না: জিএম কাদের
- নির্বাচনে দেশের জনগণের, গণতন্ত্রের জয় হয়েছে: চুপ্পু
- নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল, ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে: ওবায়দুল
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ০৪ ফেব্রুয়ারি: রেকর্ড সংখ্যক ডামি স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত নয়া কিসিমের দ্বাদশ জাতীয় সঙ-সদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। নয়া কিসিমের এই সঙ-সদে এবার কথিত বিরোধী দলের আসনে আছেন মাত্র ১১ জন এমপি। এর বাইরে আওয়ামী লীগের ২২৩ ও ডামি খ্যাত স্বতন্ত্র ৬২ জন এমপি আছেন। স্বতন্ত্র এমপিদের ৫৮ জনই আওয়ামী লীগের নেতা।
দেশের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এই সঙ-সদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিন গত মঙ্গলবার বিকেলে অধিবেশনের শুরুতে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ভাষণ দিয়েছেন। স্পিকার নির্বাচন, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়নসহ রুটিন কাজের মধ্যদিয়ে শেষ হয়েছে দিনের কার্যক্রম। এদিন নতুন সংসদের এমপিরা নিজেদের মধ্যে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি অনেকে সংসদ নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে কুশল বিনিময়, সালাম ও কদমবুছি করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বদান্যতায় এমপি হওয়া সরকারদলীয় এমপিরা ছাড়াও স্বতন্ত্র এমপিরা শেখ হাসিনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। ভিড়ের কারণে যারা কাছে এসে সালাম করতে পারেননি, তারাও দূরে দাঁড়িয়ে সালাম দেন সঙ-সদ নেতা শেখ হাসিনাকে।
এরপর নয়া কিসিমের এই ব্যাতিক্রমী সঙ-সদের প্রথম অধিবেশনে যোগ দিয়ে এমপিরা সেলফিতে মেতে উঠেন। পাশাপাশি এক এমপি আরেক এমপির ছবি তুলে দেন। কেউ কেউ সঙ-সদের একপাশে দাঁড়িয়ে পুরো অধিবেশন কক্ষের ছবি তোলেন। বেলা তিনটায় অধিবেশন থাকলেও দুপুর ২টা ৩০ মিনিট থেকে অধিবেশন কক্ষে আসতে শুরু করেন এমপিরা। প্রথমে তারা নিজেদের আসন খুঁজে নেন। এরপরই মেতে উঠেন ছবি তুলতে। পরে একাধিক এমপির ফেসবুকে সঙ-সদ অধিবেশন কক্ষে তোলা সেলফি ও ছবি আপলোড করতে দেখা যায়।
অধিবেশনের শুরুতে প্রথমে স্পিকার ও পরে ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। স্পিকার পদে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার পদে এডভোকেট মো. শামসুল হক টুকু পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচন শেষে টানা চতুর্থবার স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় সরকার ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা সঙ-সদ অধিবেশনে আলোচনার মাধ্যমে শিরীন শারমিনকে আনুষ্ঠানিক ধন্যবাদ জানান। একাদশ জাতীয় সঙ-সদের স্পিকার আবারো একই পদে প্রার্থী হওয়ায় ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। এ সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকার ও বিরোধী দলের অধিকাংশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
এরপরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ভাষণ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে সঙ-সদ অধিবেশনে আহ্বান করেন। বিউগল বাজানোর মধ্য দিয়ে বিকেল সাড়ে চারটায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পু অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করলে সবাই দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান জানান। এরপর শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। স্পিকারের পাশের আসনে বসেন রাষ্ট্রপতি। এরপর নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে ভাষণ দেন তিনি। নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই ছিল রাষ্ট্রপতির জাতীয় সঙ-সদে প্রথম ভাষণ। রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্বাচনে জনগণ ও গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করায় নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সঙ-সদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের। নির্বাচন কমিশনের সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি আরও সুদৃঢ় হয়েছে। জনগণের রায় মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দেশের গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সঙ-সদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস দ্বাদশ জাতীয় সঙ-সদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের। নির্বাচন ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের শান্ত-স্নিগ্ধ যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের গণতন্ত্র বিরোধী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখলেও ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সব পদক্ষেপ সার্থক হয়েছে।
প্রেসিডেন্টের ভাষণের পর সঙ-সদের অধিবেশন আগামী রোববার পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। অধিবেশনে স্পিকার নির্বাচনের পর শিরীন শারমিন চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে বিরোধী দলীয় নেতা জি এম কাদের বলেন, “সঙ-সদ সদস্যের সংখ্যার বিচারে বর্তমান সঙ-সদে ভারসাম্য রক্ষা হয়নি। আসন সংখ্যার বিচারে এবার সঙ-সদের শতকরা ৭৫ ভাগই সরকার দলের। স্বতন্ত্র ২১ ভাগ। তারাও প্রায় সরকার দলীয়। “৩-৪ ভাগ শুধু বিরোধী দলীয় সদস্য। এ সঙ-সদে সম্পূর্ণ জাতিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এ সঙ-সদ কখনো নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে না।” সঙ-সদ সদস্য হিসেবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রত্যাশা করেন, স্পিকার হিসেবে শিরীন শারমিন চৌধুরী নিরপেক্ষ ভূমিকাই রাখবেন। আগের স্পিকারদের ভূমিকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, “তারা দলীয় আনুগত্যে স্পিকার হলেও বাহ্যিকভাবে চেষ্টা করতেন নিরপেক্ষভাবে উপস্থাপন করার। আমি আপনার কাছে প্রত্যাশা করছি, আপনি নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন।” স্পিকারের ডান দিকে সরকার দলের আসন এবং বাঁ পাশে বিরোধী দলের যে আসন রাখা হয়, সে প্রসঙ্গ টেনে বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দুপক্ষই সমান হবেন। একটা হল সরকারি দল, আরেকটা হল বিপক্ষ। তারা সংখ্যায়ও কাছাকাছি থাকবে। “তাহলে তাদের মধ্যে সমানে সমানে লড়াই হবে, নিজেদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে তর্ক-বিতর্ক, ঝগড়াঝাঁটি হবে। সঙ-সদে জনগণের পক্ষে সিদ্ধান্ত হবে। এটাই ছিল সঙ-সদ তৈরি করার উদ্দেশ্য। এই সঙ-সদ আসন বণ্টনে সিমিট্রিক্যালের (ভারসাম্যের) অভাব হয়েছে। তাই এটাকে সম্পূর্ণভাবে সুন্দর বলা যাবে না। এ সঙ-সদে সম্পূর্ণ জাতিকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। এ আশঙ্কা অবাস্তব নয়, যদি বলি- এ সংসদ কখনও নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে না। তবে সরকার বিরোধিরা যত বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবেন বা করবেন, ততটুকু খুঁত হ্রাস পাবে। “
এদিকে দ্বাদশ সঙ-সদের অধিবেশন শুরুর দিন বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের স্পিকারকে ধন্যবাদ দিতে দাঁড়িয়ে যেভাবে সংসদের ‘ভারসাম্য’ নিয়ে মন্তব্য করেছেন, তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বুধবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “সঙ-সদ ভারসাম্যপূর্ণ না হলে তিনি কেন এলেন, আবার তিনি সঙ-সদে যা বলার একাই বললেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান যেভাবে ওই বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা ‘নিয়মের লঙ্ঘন’। গতকাল কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সঙ-সদে কথা বলেননি, আমি আনুষ্ঠানিকতা একটু বলেছি। যা বলার তো জিএম কাদেরই বলেছেন। উনি স্পিকারকে ধন্যবাদ দেওয়ার নামে সঙ-সদে ফ্লোর নিয়ে যে কথা বলেছেন, সেটা গতকাল বলা তার উচিত হয়নি। স্পিকারকে ধন্যবাদ দেওয়ার নামে শুরুতেই উনি ফ্লোর নিয়ে যে কথা বললেন, মনে হল যে তুলকালাম হয়েছে, লম্বা একটা বক্তব্য দিলেন। বিষয়টা ছিল ধন্যবাদ জানানো, উনাকে লম্বা বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গতাকল তিনি নিয়ম লঙ্ঘন করে কথা বলেছেন। সামনে তার কথা বলার যথেষ্ট সুযোগ আছে। সঙ-সদে আপনি আসলেন এবং নেতা নির্বাচিত হয়েই আসলেন। কেউ নেতা, কেউ উপনেতা– আনুষ্ঠানিকতা মেনেই তো সঙ-সদে আসলেন।”
দ্বাদশ সঙ-সদ নির্বাচন ঘিরে সার্বিক পরিস্থিতিতে ভারত ‘প্রতিবেশীসুলভ আচরণ’ করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল, ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি যখন কোনো কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে নির্বাচন ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল, তখন ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি মনে করি, সংশয় ও অবিশ্বাসের দেয়াল অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভেঙে দিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের চিড় ধরার কোনো কারণ নেই।”