খেলার পাতা

টেস্টে আফগানদের বিপক্ষে রেকর্ড গড়া জয় বাংলাদেশের

।। মুহাম্মাদ শরীফুজ্জামান।।

লণ্ডন, ১৭ জুন: দুর্দান্ত খেলে আফগানদের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে রেকর্ড গড়া জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ। নিজেদের ইতিহাসে ৫৪৬ রানের এই জয় সবচেয়ে বড় জয় বাংলাদেশের। এতদিন পর্যন্ত রানের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় ছিল ২২৬ রানের, ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। আর এই সংস্করণের ক্রিকেটে রানের দিক থেকে এর চেয়ে বড় জয় আছে কেবল দুটি। সব থেকে বেশি রানের ব্যবধানে জয়ের নজির রয়েছে ইংল্যাণ্ডের। ১৯২৮ সালে তারা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল ৬৭৫ রানে। এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তারা ১৯৩৪ সালে ইংল্যাণ্ডকে হারিয়েছিল ৫৬২ রানে। তবে বাংলাদেশের এই জয় ৮৯ বছর পরে টেস্টে সবথেকে বড় ব্যবধানে জয়।

মিরপুরের স্কোরবোর্ডে চোখ রাখলে বাংলাদেশের একচেটিয়া দাপট স্পষ্টত প্রতীয়মান। পাঁচ দিনের ম্যাচ সোয়া তিন দিনে জিতেছে বাংলাদেশ। ব্যাটসম্যানরা রান তুলেছেন এক দিনের ক্রিকেটের মেজাজে। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ব্যাটাররা ওভার প্রতি ৪.৪৪ রান তুলেছেন। আর দ্বিতীয় ইনিংসে তুলেছেন ওভার প্রতি ৫.৩১ রান। সাদা বলের ক্রিকেটের মেজাজে টেস্টে ব্যাট করেছেন বাংলাদেশের ব্যাটাররা। বোলিংয়ে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে স্পিনবান্ধব বলা হলেও এই টেস্টে আফগানদের ২০ উইকেটের ১৪টি নিয়েছেন বাংলাদেশের পেসাররা। যাতে প্রমাণিত হয় এই টেস্টে ভালোই আধিপত্য ছিল বাংলাদেশের পেসারদের। এর আগে এক টেস্টে বাংলাদেশের পেসাররা সর্বোচ্চ ১৩টি উইকেট নিয়েছিলেন ২০২২ সালে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। দেশের মাটিতে এক টেস্টে পেসারদের সর্বোচ্চ উইকেট ছিল ১০টি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ২০০২ সালে।

এই টেস্টের আগে আফগানদের সাথে বাংলাদেশ মাত্র একটি টেস্ট খেলেছে। ২০১৯ সালে দুই দলের প্রথম দেখায় আফগানরা জয় পেয়েছিল। তাই এবারের মোকাবেলায় মধুর প্রতিশোধেরে একটা লক্ষ্য ও কাজ করছিল। ৫৪৬ রানের বিশাল জয়ের মাধ্যমে সেই মধুর প্রতিশোধ যে ভালোভাবেই লিটনরা নিতে পেরেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে রা। এমনকি টেস্টের নবীন দল আফগানিস্তানের সাথে এই সংস্করণের ক্রিকেটে শক্তির ও একটা পার্থক‍্য তুলে ধরতে পেরেছেন রেকর্ডময় বিশাল এই জয়ের মধ্য দিয়ে।

বুধবার (১৪ জুন) শুরু হওয়া এই টেস্টে দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশন ছাড়া পুরো টেস্টেই বাংলাদেশের দাপট ছিল। টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম দিনে ৫ উইকেটে ৩৬২ রান করে দিনটা নিজেদের করে নেয় বাংলাদেশ। নাজমুল হোসাইন শান্ত ১৪৬ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন। তবে মুশফিকুর রহিম ও মেহেদী হাসান মিরাজের আগের দিনের অবিচ্ছিন্ন ৭২ রানের জুটি দ্বিতীয় দিন সকালে আর মাত্র ১১ রান যোগ করতে পারে। এবং দিনের চতুর্থ ওভারে মিরাজের বিদায়ের পর আর ৯ রান করতে পারে বাংলাদেশ। বড় স্কোরের দিকে নজর থাকা বাংলাদেশ অনেকটা ধাক্কা খায়। শুরু হওয়া দিনে ১ ওভার পরই দ্বিতীয় নতুন বল পায় আফগান বোলাররা। আর সেই নতুন বলে দিনের শুরুতে বল হাতে বাংলাদেশ শিবিরে কাঁপন ধরান আফগান পেসার নিজাত মাসুদ। কাপন ধরিয়ে অভিষেকেই তিনি নিয়ে নেন ৫উইকেট। তাকে দারুণ সঙ্গ দেন আরেক পেসার ইয়ামিন আহমাদজাই। তাদের দুর্দান্ত বোলিংয়ে ৩৮২ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস।

এরপর আফগান ব্যাটিং শিবিরে কাঁপন ধরান বাংলাদেশের দুই পেসার এবং দুই স্পিনার। পেসার শরিফুল ইসলাম, এবাদত হোসেন, স্পিনার তাইজুল ইসলাম এবং মেহেদী হাসান মিরাজ। তাদের দাপটে মাত্র ১৪৬ রানেই অলআউট হয়ে যায় আফগানিস্তান। তবে আফগানদের এই ভরাডুবির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিলো পেসার এবাদত হোসেনের। একাই ৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি। দুর্ভাগ্য তার, কয়েকটি ক্যাচ মিস না হলে ৫ উইকেট নেয়ার গৌরব অর্জন করতে পারতেন। আফগানদের বাকি ৬ উইকেট সমান ভাগে ভাগ করে (২টি করে) নিয়েছেন শরিফুল, তাইজুল এবং মিরাজ।

আফগানদের ১৪৬ রানে অলআউট করে দেয়ায় প্রথম ইনিংসেই বাংলাদেশ এগিয়ে যায় ২৩৬ রানে। এই ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় চাইলে সফরকারীদের ফলোঅনও করাতে পারত বাংলাদেশ। কিন্তু তা না করে ব্যাটিংয়ে নামে বাংলাদেশ। দিন শেষে ৯ উইকেট হাতে রেখে দ্বিতীয় ইনিংসে বাংলাদেশের লিড দাঁড়ায় ৩৭০ রানের। এটিকে আরও বড় করার লক্ষ্য নিয়ে তৃতীয় দিন ব্যাট করতে নামে স্বাগতিকরা। আগের দিনের দ্বিতীয় উইকেটে অবিচ্ছিন্ন ১১৬ রানের অপরাজিত জুটি জাকির হাসান ও নাজমুল হোসেন শান্ত সাবলিল ব্যাটিংয়ে ৫ ওভারের মধ্যেই লিড চারশ পার করেন। তবে তৃতীয় দিন নিজের ইনিংস বড় করতে পারেননি জাকির। ব্যক্তিগত ৭১ রানে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন তিনি। জাকির ফেরার পর ক্রিজে শান্তর সঙ্গী হন সাবেক টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক। আফগানিস্তান বোলারদের বিপক্ষে ওয়ানডে স্টাইলে ব্যাট করতে থাকেন তারা। এতে প্রথম সেশনেই টেস্ট ক্যারিয়ারের চতুর্থ সেঞ্চুরির দেখা পান শান্ত। ১১৫ বলে ১৪টি চারে সেঞ্চুরি করেন তিনি। প্রথম ইনিংসের সেঞ্চুরিয়ান শান্ত বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটার হিসেবে এক টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করার কীর্তি গড়েন। এর আগে ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্টের দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছিলেন মুমিনুল। এই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও মুমিনুল চমৎকার এক সেঞ্চুরি হাঁকান। যেটি তার টেস্ট ক্যারিয়ারের ১২তম সেঞ্চুরি। তবে এই সেঞ্চুরির জন্য অনেকদিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০২১ সালের এপ্রিলে সর্বশেষ টেস্ট সেঞ্চুরি করেছিলেন মোমিনুল। দ্বিতীয় ইনিংসে টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৬তম হাফসেঞ্চুরি ও করেন লিটন। শেষ পর্যন্ত ৮০ ওভারে ৪ উইকেটে ৪২৫ রানে ইনিংস ঘোষনা করে বাংলাদেশ। এটি টেস্টে ১৭তম বার ইনিংস ঘোষণা বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ইনিংসে ১১তম বার। এর আগে ১০ বারের মধ্যে ছয়বার জয়ের বিরতিতে একবার হেরেছে। আর তিনবার হয়েছে ড্র।

বড় লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে চতুর্থ ইনিংসের প্রথম বলেই উইকেট হারায় আফগানরা। ইব্রাহিম জাদরানকে লেগ বিফোর আউট করেন বামহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম। পরের ওভারে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় উইকেট এনে দেন পেসার তাসকিন আহমেদ। আফগানদের ২ উইকেট হারানোর পর তৃতীয় দিনের খেলা ও শেষ হয়। চতুর্থ দিনের শুরুতে আফগান শিবিরে আঘাত হানেন এবাদত হেসেন। ৬ রান করা নাসির জামালের উইকেট তুলে নেন। এরপর পরপর দুই ওভারে আফসার জাজাই ও বাহির শাহকে ফিরিয়ে আফগানদের লড়াইয়ের আশা প্রায় শেষ করে দেন শরিফুল। একটু দেরিতে আক্রমণে আসা তাসকিন ও মেহেদী হাসান মিরাজ সারেন বাকিটা। তাসকিন শিকার শুরু করেন এক প্রান্ত আগলে রাখা রহমত শাহর প্রতিরোধ ভেঙে। অফ স্টাম্পের একটু বাইরের বলে খোঁচা মেরে লিটনের গ্লাভসে ধরা পড়েন আফগান টপ অর্ডার ব‍্যাটসম‍্যান। দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে করিম জানাতের স্টাম্প উপড়ে ফেলেন তাসকিন। আমির হামজাকে ফিরিয়ে দলকে জয়ের আরও কাছে নিয়ে যান মিরাজ। ইয়ামিন আহমাদজাইকে বিদায় করে প্রথমবারের মতো পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়ার আশা জাগান তাসকিন। সেটি হতে দেননি জহির। পরপর দুই বলে বেঁচে যান তিনি। এর একটিতে ফুলটস ডেলিভারিতে হন বোল্ড কিন্তু কোমড়ের বেশি উচ্চতার জন‍্য আম্পায়ার ডাকেন ‘নো।’ এর দুই বল পরেই সমাপ্তি ঘটে আফগানিস্তানের ইনিংসের। লেগ স্টাম্পে থাকা তাসকিনের শর্ট বল আঘাত হানে জহিরের কনুইয়ে। এরপর আর ব‍্যাটিং চালিয়ে যেতে পারেননি তিনি। আগের দিন হেলমেটে তাসকিনের বাউন্সারে আঘাত হানলে মাঠ ছেড়েছিলেন আফগান অধিনায়ক।

অবশ্য শেষ দুই দিনে সফরকারীদের জয়ের বাস্তবিক কোনো সুযোগ ছিল না। দেখার ছিল দুই দলের প্রথম দেখায় ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম টেস্টে ২২৪ রানে জেতা দলটি কতটা লড়াই করতে পারে। স্বাগতিকদের দারুণ বোলিং ও ফিল্ডিংয়ে সেটা খুব একটা করতে পারেনি তারা। গুটিয়ে গেছে চতুর্থ দিনে এক সেশনেই।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ ১ম ইনিংস: ৮৬ ওভারে ৩৮২ (জয় ৭৬, জাকির ১, শান্ত ১৪৬, মুমিনুল ১৫, মুশফিক ৪৭, মিরাজ ৪৮, তাসকিন ২, তাইজুল ০, শরিফুল ৬, ইবাদত ০*; ইয়ামিন ১০-১-৩৯-২, মাসুদ ১৬-২-৭৯-৫, করিম ১১-৩-৩৩-০, জাহির ১৬-০-৯৮-১, হামজা ২৪-১-৮৫-১, শাহিদি ৩-০-৯-০, রহমত ৬-১-৩০-১)।

আফগানিস্তান ১ম ইনিংস: ৩৯ ওভারে ১৪৬ (ইব্রাহিম ৬, মালিক ১৭, রহমত ৯, শাহিদি ৯, জামাল ৩৫, জাজাই ৩৬, জানাত ২৩, হামজা ৬, আহমাদজাই ০, মাসুদ ০, জাহির ০*; তাসকিন ৭-০-৪৮-০, শরিফুল ৮-২-২৮-২, ইবাদত ১০-১-৪৭-৪, তাইজুল ৫-০-৭-২, মিরাজ ৯-১-১৫-২)।

বাংলাদেশ ২য় ইনিংস: ৮০ ওভারে ৪২৫/৪ (ডিক্লে.) (জয় ১৭, জাকির ৭১, শান্ত ১২৪, মুমিনুল ১২১, মুশফিক ৮, লিটন ৬৬; আহমাদজাই ১৩-১-৬১-০, মাসুদ ১২.৫-০-৮৩-০, হামজা ১৬.১-০-৯০-১, জানাত ৮-০-৪৮-০, জাহির ২৩-০-১১২-২, শাহিদি ৩-০-১৯-০, জামাল ২-০-৪-০, রহমত ২-০-৪-০)।

আফগানিস্তান ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ৬৬২) ১১ ওভারে ৪৫/২ (জাদরান ০, মালিক ৫, রহমত ১০, শাহিদি ১৩ আহত অবসর, জামাল ৫; শরিফুল ৪-১-৬-১, তাসকিন ৪-০-২৮-১, তাইজুল ২-০-৬-০, মিরাজ ১-০-১-০)।

আফগানিস্তান ২য় ইনিংস: (লক্ষ্য ৬৬২) ১১৫ (রহমত ৩০, শাহিদি ১৩ আহত অবসর, জামাল ৬, জাজাই ৬, বাহির ৭, জানাত ১৮, হামজা ৫, আহমাদজাই ১, মাসুদ ৪*, জাহির ৪ আহত আউট; শরিফুল ১০-১-২৮-৩, তাসকিন ৯-২-৩৭-৪, তাইজুল ৫-১-১৯-০, মিরাজ ২-০-৫-০, ইবাদত ৭-২-২২-১)।

ফল: বাংলাদেশ ৫৪৬ রানে জয়ী।

ম‍্যান অব দা ম‍্যাচ: নাজমুল হোসেন শান্ত।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close