বিদায় দেশমান্য ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী
সুরমা প্রতিবেদন: চিরতরেই চলে গেলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি, মানবতার ফেরিওয়ালা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেশমান্য ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দল মতের ঊর্ধ্বে ঊঠে যিনি যখন যা সত্য মনে করতেন তাই অকপটে বলতেন- কে বিরাগ ভাজন হলেন আর কে স্মিত হলেন তা তিনি কখনো দেখতেন না। চিন্তায় সৎ থেকে দেশের জন্য যখন যেটা ভালো মনে করতেন সেটাই তিনি সবসময় করতেন। দেশ ও জাতির জন্য তার অবদান বলে শেষ করা যাবে না। এ ভূমির অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সন্তানের অভাব কোনদিনও পুরণ হবে না।
মঙ্গলবার রাত সোয়া এগারোটায় ঢাকার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ফেইলিওর, লিভারের সমস্যা, হার্টের সমস্যাসহ সেপটিসেমিয়া সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মামুন মুস্তাফি মঙ্গলবার রাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যু সংবাদ ঘোষণা করেন। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন তার বাবার শিক্ষক ছিলেন। তিনি পরিবারের দশ ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশে ১৯৮২ সালে চালু হওয়া ‘জাতীয় ঔষধ নীতি’ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯৮২ সালের “ঔষধনীতির” জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনিই প্রথম দেশে গ্রামীণ স্বাস্থ্যবীমা চালু করেছিলেন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার বিকল্প মডেল তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন। স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তিনি চিন্তার জগতে পরিবর্তন এনেছিলেন। আগে চিকিৎসা, ঔষধ বা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে প্রশ্ন করার চিন্তা কেউ করতেন না। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী সেটি শিখিয়েছিলেন। তিনি এক ব্যতিক্রমী ধারার সূচনা করেছিলেন। স্বাস্থ্যখাতের জন্য ভালো কিছু করার জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সব সময় নিজ আদর্শে অটল ছিলেন। তিনি দেশের পাবলিক হেলথ সার্ভিসের একজন আইকন ছিলেন। ১৯৮২ সালের পুর্বে বাংলাদেশে ৪০০০ কমার্শিয়াল ড্রাগ পাওয়া যেত। যা বিদেশি কোম্পানি দ্বারা তৈরি হতো এবং আমদানি করতো হতো। এইসব ঔষধের অনেকগুলো ছিল অদরকারী এবং জনগণের ক্রয়সীমার বাইরে। অথচ অতীব দরকারি ১৫০টি ওষুধের সরবরাহ ছিল খুবই স্বল্প। তাঁর প্রচেষ্টায় উন্নয়নশীল দেশের জন্য আমদানি ওষুধের সংখ্যা দাঁড়ায় ২২৫ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ একটি ঔষধ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়। একাত্তরে পাকিস্তান হানাদারদের আক্রমণের মুখে সবাই যখন নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করছিলেন, তখন ডা: জাফরউল্লাহ চৌধুরী বিদেশে নিরাপদ জীবন ছেড়ে প্রকাশ্যে পাকিস্তানী পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস এ এফআরসিএস পড়াকালীন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে লন্ডন থেকে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার নিমিত্তে আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন এবং এরপরে ডা: এম এ মবিনের সাথে মিলে সেখানেই ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট “বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল” প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছিলেন এবং সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেছিলেন যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তার এই অভুতপুর্ব সেবা পদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার “ল্যানসেট”-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টার হামলার শিকার হয়েছিলো তাতে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীও একজন আরোহী ছিলেন। ঢাকার মধ্যে রুরাল এলাকায় মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দেবার নিমিত্তে তিনি ১৯৭২ সালে “গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র” প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গণস্বাস্থ্য ধীরে ধীরে সারা বিশ্বের স্বীকৃতি পায়। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে সেবা দিতে প্যারামেডিকেল শিক্ষা দিয়ে এতে মাঠ পর্যায়ের জনগণকে সম্পৃক্ত করেছিলেন। এ বিষয়ে ১৯৭২ সালে ধারণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। যা ১৯৭৮ সালে কাজাকিস্তানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যালমাটা ঘোষণায় স্বীকৃতি পায়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে রেমন ম্যাগসাইসাই (১৯৮৫) এবং সুইডেন থেকে রাইট লাভলিহুড (১৯৯২), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছিলেন। কানাডার ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব ন্যাচারাল মেডিসিন ২০০৯ সালে তাকে ডক্টর অব হিউম্যানিটেরিয়ান উপাধি দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলে থেকে ২০১০ সালে ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ অ্যাওয়ার্ড পেয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ ২০২২ সালে তাকে ‘এনআরবি লিবারেশন ওয়ার হিরো ১৯৭১’ পুরস্কার দিয়েছিলেন। তৃতীয় বাংলাখ্যাত বিলেতের অন্যতম প্রধান কাগজ ‘সাপ্তাহিক সুরমা’ তাকে দেশমান্য উপাধি দিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ৫০টির বেশি দেশে বিভিন্ন সম্মেলন বা সেমিনারে মূল বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। একাধিক দেশকে জাতীয় ওষুধনীতি তৈরিতে তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি শুধু বাংলাদেশ না পুরো বিশ্বেরই একজন আইকন ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে একটির নাম রিসার্চ: আ মেথড অব কলোনাইজেশন। এটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। এরপর এটি বাংলা ছাড়াও ফরাসি, জার্মান, ইতালি, ডাচ, স্প্যানিশ ও একাধিক ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী ঢিলেঢালা শার্ট প্যান্ট পরতেন। পুরোনা বাসায় আসবাবপত্র পুরনো। গাড়িটাও পুরনো। সব মিলিয়ে নির্মোহ একজন মানুষ ছিলেন। নিজের পাওয়ার কথা কখনও চিন্তা করেননি। নিজের জন্য কিছু চাননি। সারাজীবন মানুষকে শুধু দিয়েই গেছেন। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সবসময় দেশের ভালোর জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। চেষ্টা করেছেন নিজেকে উজার করে দেওয়ার। মরণোত্তর দেহদানের মাধ্যমে নিজের শরীরকেও তিনি মানুষের কল্যাণেই বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি পুরোটা সময় দেশ ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে গেছেন। নিজের ক্যারিয়ারের চেয়ে দেশপ্রেমকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে একুশ শতকের করোনা ভাইরাস মহামারি এই পুরো পাঁচ দশকেই কোনো না কোনো ভাবে আলোচনায় ছিলেন। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি, ঔষধ নীতি ও নারী শিক্ষা, এমনকি সে সময়ে সহজে দেশের মানুষের জন্য পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে সরকারকে রাজী করানো এবং প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণে সরকারকে প্রভাবিত করতে তার ভূমিকা আলোচনায় এসেছে সবসময়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী থাকার সময়ে কলেজের দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হয়ে আলোচনায় এসে পরে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে বাম ধারার রাজনীতি করলেও পরবর্তী জীবনে সক্রিয় রাজনীতি তিনি করেননি। ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রথম মিটিংয়ে তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। ১৯৭৮-৮০ সালে তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে সবসময়ই স্বাধীন রাজনৈতিক মতামতের মাধ্যমে জনমনে প্রভাব ফেলেছিলেন। তিনি অবলীলাক্রমে পুরোনো নিয়ম ভাঙার এবং নতুন নিয়ম গড়ার, অজানা নিয়ম চালু করার এক অপূর্ব শিল্পী ছিলেন। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী এভাবেই দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবেসেছিলেন।
বিদায় দেশমান্য, বিদায় বীর, বিদায় ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশ নামক ভুখন্ড যতদিন পৃথিবীতে থাকবে ততদিন এই ভুখন্ডের মানুষ আপনাকে মনে রাখবেন। দেশের মানুষ আপনাকে চিরকাল শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞার সাথে স্বরণ করবেন।