নিউজ

গুম: ঢাকাকে রেড এলার্ট জাতিসঙ্ঘের

।। সুরমা ডেস্ক।।
লণ্ডন, ১৮ আগস্ট : বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার মিশেল বেচেলেট শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানো নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত কি না তা নিশ্চিত করতে সরকারকে সতর্ক করেছে। গুম ও বিচার বহির্ভূত হত্যা তদন্তে জাতিসঙ্ঘ তার বিশেষজ্ঞ দলকে ঢাকা পাঠাবে। এই সফরকে ঘিরে নানা প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলে উত্থাপিত হয়েছে। বিএনপি, নাগরিক অধিকার পরিষদ এবং সিভিল সমাজের প্রতিনিধিরা গুম ও খুনসহ মানবাধিকার পরিস্থিতি স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানালেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ জাতিসংঘের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বাংলাদেশে গুম ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় স্বাধীন তদন্ত দাবী করেছে জাতিসংঘ।

বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার মিশেল বেচেলেটের চারদিনের সফর শেষে বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রেসব্রিফিংয়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সংশোধন, ক্রমাগত মানবাধিকারের সংকোচন, বর্ধিত নজরদারি, ভয়ভীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রচলিত আইন ও নীতি এনজিওগুলোকে অতি-নিয়ন্ত্রিত করে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে সীমাবদ্ধ করে তাদের পক্ষে কার্যকরভাবে কাজ করা কঠিন এবং কখনও কখনও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কিছু বিধান বাতিল ও সংশোধনের জন্য আমাদের সুপারিশ পেশ করেছি। গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বল্প-মেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী উভয় প্রকার গুমের জন্য ক্রমাগত উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এবংবিচারিক সুরক্ষার অভাব গভীর উদ্বেগজনক। বিশেষ করে তদন্তে অগ্রগতির অভাব এবং ন্যায়বিচারে অন্যান্য বাধার কারণে দীর্ঘস্থায়ী হতাশার কথা উল্লেখ করে তিনি সরকারকে একটি স্বাধীন ও বিশেষ তদন্ত প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা করতে পরামর্শ (কূটনৈতিক ভাষায় পরার্শ হলেও এটি সরকারকে রেড এলার্ট বলে ধারণা করা হয়) দেন। এই বিশেষ ব্যবস্থা গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্ত করতে ভিকটিম ও তাদের পরিবার এবং সুশীল সমাজের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে। আন্তর্জাতিক মানের সাথে সঙ্গতি রেখে কীভাবে এই জাতীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সে সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ প্রস্তুত। গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধানে সরকারের প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করবে।
বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলোপের আহ্বান জানিয়ে মিশেল বলেন, জাতিসংঘ দৃঢ়ভাবে যে কোনো এবং সব পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড আরোপের বিরুদ্ধে এবং মৃত্যুদণ্ডের বিধান বন্ধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপগুলিকে উ“সাহিত করে।

গুমের বিচারের এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই: কাদের

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাংলাদেশে গুম ও হত্যার বিচার করার এখতিয়ার জাতিসংঘের নেই। বুধবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন। ‘২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার’ প্রতিবাদে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনি (বিএনপির মহাসচিব) মিশেল ব্যাচেলেটকে বলেছেন, আপনাদের নেতা—কর্মী গুম হয়েছেন, হত্যার শিকার হয়েছেন। এঘটনার নিন্দা করতে। এ জন্য জাতিসংঘকে তদন্ত কমিটি করতে বলেছেন। ফখরুল সাহেব, আপনি বোধ হয় জানেন না, আপনি যে নালিশ করেছেন, এই নালিশের বিচার করার এখতিয়ার মিশেল ব্যাশেলেতের নেই। জাতিসংঘের নিয়মকানুন কি জানেন? কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মন্তব্য করার কোনো অধিকার নেই জাতিসংঘের।’

মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছে বিএনপি

এদিকে, জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরেছে বিএনপি প্রতিনিধি দল। ঢাকা সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনের এশিয়া-প্যাসিফিক শাখার প্রধান ররি মুনগোবেনের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। বুধবার দুপুরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলটি ররি মুনগোবেনের সঙ্গে প্রায় ৫০ মিনিট বৈঠক করে। পরে প্রতিনিধিদলের প্রধান আসাদুজ্জামান আসাদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি কেমন, সেটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা আমাদের বক্তব্য তাঁকে বলেছি। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আমরা ব্যাখ্যা করেছি, যেটা বিভিন্ন সময়ে আপনারা রিপোর্ট করেছেন, পত্রপত্রিকায় এসেছে।’ প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ, তাবিথ আউয়াল ও মানবাধিকারবিষয়ক কমিটির সদস্য গুমের শিকার বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আবরার ইলিয়াস।

নিরপেক্ষ তদন্তে জাতিসংঘের ভূমিকা চায় ‘গণঅধিকার পরিষদ’

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশে সফররত জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি দলের সাথে বুধবার সকালে গনঅধিকার পরিষদ এর প্রতিনিধি দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলকে বলা হয়, সরকারের জবাবদিহিতা না থাকায় তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দিয়ে বেআইনি; এমনকি মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করাচ্ছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক নাগরিকদের নির্যাতন, গুম, খুন, বিচারবর্হিভূত হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ অশনি সংকেত। গত ১২ আগস্ট নেত্রনিউজ কর্তৃক প্রকাশিত অনুসন্ধানী রিপোর্ট ‘আয়নাঘরের বন্দী’তে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক গুম করে আটকে রাখা এবং নির্যাতনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুধু আয়নাঘরের বন্দী নয়, এ সরকারের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গত ১৩ বছরে সংগঠিত সকল গুম ও বিচারবর্হিভূত হত্যাকন্ডের বিষয়ে জাতিসংঘের অধীনে নিরপেক্ষ তদন্ত চায় গণঅধিকার পরিষদ। এসময় অন্যান্যের মধ্যে গণঅধিকার পরিষদ এর সদস্য সচিব নুরুলহক নুর, যুগ্মআহ্বায়ক মোঃ রাশেদ খান ও ফারুক হাসান উপস্থিত ছিলেন।
তারা আরও বলেন, ২০২১ সালে কারাগারে লেখক ও উদ্যেক্তা মুশতাক আহমেদ, হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবালকে নির্যাতন করে হত্যা, মোদি বিরোধী আন্দোলনে গ্রেফতারকৃতদের নির্যাতন, শাহবাগ থানায় ছাত্রনেতা রবিউল হাসান, আলামিন আটিয়া, সজল ও নাজমুল করিম সোহাগকে মুখে গামছা বেঁধে অমানবিকভাবে পেটানো, চোখে মরিচ দিয়ে নির্যাতন; এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে ভোলায় পুলিশ কর্তৃক গুলি করে দু’জনকে হত্যা, নাটোরে যুবনেতা নুরশাদকে হত্যায় কারো বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসী হামলা,পুলিশি হামলা-মামলায় সভা-সমাবেশের মতো নাগরিকদের মৌলিক অধিকারও আজ এক চরম হুমকির সম্মুখীন। যা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আদালতকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ঐক্যমতের ভিত্তিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে ২০১৪ এবং ১৮ এর মতো বিনা ভোটের ও ভোট ডাকাতির নির্বাচন করে সরকার দেশের বর্তমান সংকট তৈরি করেছে। তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ব্যতীত আগামী নির্বাচন হলে তা দেশে সংঘাত-সহিংসতা বাড়াবে,মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটাবে। এক্ষেত্রে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচনে জাতিসংঘও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

ঢাকায় প্রতীকী লাশের মিছিল ও বিক্ষোভ

নাটোরে যুব অধিকার পরিষদের নেতা নুরশাদকে কুপিয়ে হত্যা,ভোলায় পুলিশের গুলিতে নূরে আলম ও আব্দুর রহিম হত্যার বিচার এবং দেশের বিভিন্নস্থানে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা,গুম ও খুনের প্রতিবাদে ঢাকায় মঙ্গলবার যুব অধিকার পরিষদ কর্তৃক আয়োজিত “প্রতীকী লাশের মিছিল ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ ও বিক্ষোভে নাগরিক অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব ও সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নূর, ফারুক হাসান ও যুব অধিকার পরিষদ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close