বাক-স্বাধীনতার উগ্রবাদ
সম্পাদকীয় ।। ইসু্য ২১৭৪
ফ্রান্সের গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রবাহ বিশ্ববাসীকে নতুন উদ্বেগের মুখে ঠেলে দিয়েছে। যেই ফরাসি সভ্যতা মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে আধুনিক বিশ্বে নতুন একটি মাত্রায় উপনীত করতে ভূমিকা রেখেছে, সেই ফরাসি দেশ থেকেই বাকস্বাধীনতার নামে নতুন এক উগ্রবাদের সূচনা হয়েছে।
শার্লি হেবদো নামে ইহুদিবাদী পৃষ্ঠপোষকতায় একটি সংবাদপত্র গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্যারিস থেকে এই উগ্রবাদ প্রচার শুরু করে। সময়ের বিবর্তনে এখন আর সেটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। শেষ পর্যন্ত মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এর কল্পিত ছবি ব্যবহার করে কার্টুন শিক্ষার্থীদের প্রদর্শনের জের ধরে একজন শিক্ষক খুন হওয়ার ঘটনা সকলকে নাড়া দিয়েছে । এই ঘটনায় ঘাতককে একজন উগ্র ধর্মান্ধ মানুষ হিসেবে বিবেচনা করার আগেই ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান শার্লী হেব্দো স্টাইলে মহানবী (স.)কে বিকৃত রূপে উপস্থাপনের বিকৃত কর্মকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে বাক স্বাধীনতার কথা বলে। ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধানের অজানা থাকার কথা নয় -ইসলাম রাসূল (স.)র প্রতিকৃতি অংকন ও প্রদর্শনকে অনুমোদন করে না । এই ধরনের কর্মকে ইসলামে হারাম ও পাপ কর্ম বলে বিশ্বাস করে। সুতরাং মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসকে পদাঘাত করা কোন বাকস্বাধীনতা হতে পারে না।
“তোমার মতের সঙ্গে আমি একমত হতে না পারি কিন্তু তোমার মত
প্রকাশের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতে পারি’ এই মহান ফরাসি দর্শন বর্তমানে এক
কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি !! কারণ ওই মতপ্রকাশ মানে অন্যদের নাসিকা কে
অতিক্রম করতে বলা হয়নি কিন্তু সেই ফরাসি শিক্ষক, শার্লি হেবদো আর সর্বশেষ
ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান সকলেই এখন বাকস্বাধীনতার নামে অন্যের ধর্মীয় অধিকার
এবং বিশ্বাসকে চরমভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত এবং নিগৃহীত করার অপরাধমূলক
কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন। এই কারণে এটি অপরাধ যেহেতু ধর্মীয় মূল্যবোধ ও
বিশ্বাসকে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় স্পষ্টভাবে নির্দেশিত এবং
সকল দেশ কর্তৃক গৃহীত আন্তর্জাতিক ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-
প্রত্যেকেরই মতামত, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতার অধিকার রয়েছে; এই অধিকারের
মধ্যে তার ধর্ম বা বিশ্বাস পরিবর্তন করার স্বাধীনতা এবং একা বা অন্যের সাথে
সম্প্রদায় বা প্রকাশ্যে বা ব্যক্তিগতভাবে তার ধর্ম বা বিশ্বাসকে
শিক্ষাদান, অনুশীলন, উপাসনা ও পালন করার বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত করে।”
প্যারিসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবীতে দেড় বিলিয়ন মুসলমানসহ শান্তিপ্রিয় ও বিশ্বাস ভিত্তিক কোটি কোটি মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। ফলে বিশ্বের দেশে দেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশ ইতিমধ্যে ফরাসি পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছেন। এদিকে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে ফ্রান্সের পাশে দাঁড়িয়েছে।
বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশ্ব দুভাগ হয়ে পড়া মোটেই কল্যাণকর নয়। তবে এই ঘটনা প্রবাহে একটি বিষয় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে; সেটি হল উগ্রবাদ শুধু ধর্ম অথবা রাজনীতিকে ভর করেই বেড়ে ওঠে না; বরং বাকস্বাধীনতার নামে আরেকটি উগ্রবাদ খুঁটি গেড়েছে বিশ্বব্যাপী। জাতিসংঘের সনদ উপেক্ষা করেই রাষ্ট্রগুলো এই নতুন ধরনের উগ্রবাদকে স্বাগত জানাচ্ছে। এতদিন ধর্ম রাজনীতি ও দর্শনের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অথবা আরবিতে যাকে বলে ওয়াসাতিয়া এখন বলতে গেলে প্রায় নির্বাসিত হবার পথে । এটাই হচ্ছে মানবতার জন্য সবচেয়ে বড় অশনি সংকেত।
উগ্রবাদ কোন সংকটের সমাধান করে দেয় না বরং আলাপ-আলোচনা এবং পরিস্থিতির উত্তরণে বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়াই হচ্ছে সভ্যতার মূলকথা । তাই ধর্মীয় উগ্রবাদ, রাষ্ট্রীয় উগ্রবাদ আর দর্শনগত উগ্রবাদকে পিছনে ফেলে সকল ক্ষোভ-বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদকে মধ্যপন্থায় সমবেত করে আমাদের চলমান এই সংকট গুলোকে মোকাবেলা করতে হবে এর কোন বিকল্প নেই থাকতে পারে না।
আমরা সবসময়ই আশা করব- সর্বত্র মধ্যপন্থা বা ওয়াসাতিয়া জয়যুক্ত হোক।