কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো
সুরমা সম্পাদকীয় ।। ইসু্য ২১৭১
দেশকে জননীরূপে দেখা হয়। এটি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবেগ সম্পর্কিত উপমা। এর সঙ্গে কিছু অর্থগত মেলবন্ধনও রয়েছে। একটি শিশু যেভাবে মাতৃক্রোড়ে লালিত-পালিত হয় মাতৃভূমিতেও সেভাবে একটি জাতি খেয়েদেয়ে-হেসেখেলে বেড়ে ওঠে। এর জন্য এর মাতৃমূল্য এভাবেই জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চর্চার মধ্যে নির্ধারিত হয়েছে। আমরা প্রবাসে সে আবেগের মূল্য আরো অধিকহারে অনুভব করি যখন দেশে কোনো ক্রান্তিকাল আসে। বিগত বছরগুলোর কোনো একটি দিন নেই যেখানে বাংলাদেশ আমাদের জন্য উল্লেখ করার মতো কোনো একটি ভালো দিক বয়ে এনেছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্ষণের মহামারি আর ধর্ষকদের অভিন্ন পরিচয় জাতিকে মুষড়ে দিয়েছে। ভয়ার্ত মানুষ কান্নার সাহসও হারাতে বসেছে।
বাংলাদেশ যখন ধর্ষিত হয়—এই প্রবাস বিভুইয়েও আমরা মানসিকভাবে আক্রান্ত হই। আমাদের পাঁজর কেটে রক্তাক্ত হয়। কিন্তু আমরা কিছু করতে পারি না। বর্তমান যুগ সোশালমিডিয়ায় দাবড়িয়ে বেড়ানোর যুগ। তাই চোখ-কান বন্ধ করে বসে থাকলেও হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্ট ফোনটি সেসব করাল ঘটনাপ্রবাহ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরে। আমরা ভেবে পাই না এতো এতো দেশপ্রেম আর আবেগঘন সঙ্গীত, সাহিত্য, নাটক, উপন্যাস, গল্প, প্রচ্ছদচিত্র—যেসবের প্রতিটি পরতে পরতে কেবল দেশ প্রেম আর—‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি’ ধরনের মিথ্যাচার আর কোনো ভাষার সাহিত্যে আছে কি না। আমরা জানি না। তাহলে কি আমাদের সকল দেশপ্রেম কেবল কাব্য-সাহিত্যেই লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে যার কোনো স্পর্শ আমাদের মনোলোককে প্রভাবিত করবে না? না, কথাটি সত্যি নয়। আমাদের মনোলোককে প্রভাবিত করেছিল ৫০ দশকের শক্তিমান লেখকদের লেখা। এর জন্য দীর্ঘযাত্রার পর আমরা একটি স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিলাম। কিন্তু বর্তমান নষ্ট-সময় আমাদের শিল্পবোদ্ধাদের ভঙ্গুর করে তুলেছে। তাদের লেখায়, নাটকে সমকালের কোনো আঁছড় পড়ছে না। যে বামধারার সংস্কৃতিসেবক এতোকাল শিল্পের ভেতর দিয়ে জাতিকে সময়ে সময়ে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন তারা এখন ক্ষমতাসীনদের আস্তিনের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা কালের যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করছেন তথাকথিত ‘চেতনার মেলবন্ধনের’ খাতিরে। এই যে উপচে পড়া বন্ধন, এটিই আমাদের জাতিকে আতুড় করে তুলেছে।
আজ দেশে চলছে ধর্ষণ উৎসব। আর এই উৎসবের ক্রীড়নক রাষ্ট্রের ভেতরে জিইয়ে থাকা অনৈতিক একটি সরকার। তাদের সেবাদাসরা রক্তশূন্যের সংস্কৃতি চর্চা করে ইতিহাসবিকৃতির নাটক রচনা করে কিন্তু ধর্ষিতার আর্তনাদ শুনতে পায় না। যেভাবে বিগত দিনেও তারা বিশ্বজিতের রক্তমাখা শরীর দেখতে পায়নি। ‘আসাদের শার্ট’ ছিলো আমাদের জাতীয় প্রতীক। সেই অনুপ্রেরণায় বাঙালি জাতি আইয়ূবাশাহীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল কিন্তু বর্তমানে একটি অনির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়াতে পারছে না কেন? এই কেন’র উত্তর সকলেই জানে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা থেকে মুক্তির জন্য হোক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আর তাও যদি অসম্ভব করে তুলে দুঃশাসন, তাহলে সর্বত্র কান্নাই হোক প্রতিবাদের ভাষা। মা-বোন-বাবা-ভাই আর সকলের এই সম্বিলিত প্রতিরোধের ক্যানভাসের নাম হোক—কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো।