আবার করোনার আঘাৎ

* নিয়ম না মানলে লকডাউনের হুশিয়ারী প্রধানমন্ত্রীর
* পাব-রেস্টুরেণ্টে রাত ১০ থেকে কারফিউ
* সেল আইসোলিউশন না করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার পাউণ্ড জরিমানা
* আইন কার্যকর করতে মাঠে নামবে সেনাবাহিনী
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ২৫ সেপ্টেম্বর – বৃটেনে মহামারী করোনার সেকে- ওয়েভ বা দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ রূপে আঘাত হানতে শুরু করেছে। অনেক আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিলো যে, শীতে আবার শুরু হতে পারে করোনার প্রকোপ। কিন্তু শীত আসতে না আসতে সেই আশঙ্কার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিন হু হু করছে বাড়ছে সংক্রমণ। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। সংক্রমণের হার দিনে প্রায় ৫ হাজারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ৪ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে আক্রান্তের সংখ্যা। বৃটেনের প্রধান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ও প্রধান মেডিক্যাল অফিসার যৌথভাবে আশঙ্কা করেছেন যে, অক্টোবর থেকে সংক্রমণের পরিমাণ দিনে ৫০ হাজারে গিয়ে উন্নীত হতে পারে। আর সংক্রমণের এই ধারা অব্যাহত থাকলে প্রতিদিন অন্তত মৃত্যু হবে ২শ‘ মানুষের। তাদের ঘোষণার পর আবার নড়েচড়ে বসেছে ব্রিটিশ সরকার। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ছয় মাসের জন্য নতুন কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছেন। এসব বিধিনিষেধ করোনা রোধে কার্যকর না হলে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে।
২২ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার প্রথমে পার্লামেন্টে এবং রাতে টেলিভিশনে সম্প্রচারিত বক্তৃতায় নতুন কঠোর বিধিনিষেধের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, এতেও কাজ না হলে তিনি দ্বিতীয় দফায় দেশব্যপী পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করতে বাধ্য হবেন। বরিস জনসন সবাইকে এসব কঠোন নিয়ম মেনে চলার আহবান জানিয়ে বলেন, কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। বিশ্বজুড়ে কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই আমার জীবদ্দশায় দেখা প্রথম কোনো বৃহত্তম সংকট। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে এই রোগটি প্রায় দশ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছে এবং সর্বত্র অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। তিনি করোনার সূচনা সময়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, মার্চ মাসে যখন আমাদের এখানে এই রোগটি ধরা পড়েছিলো তখন আমরা দেশ ও কমিউনিটির স্বার্থে সবধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলাম। তখন আমরা নিয়ম অনুসরণ করেছি। ঘরে অবস্থান করেছিলাম, এনএইচএসকে রক্ষা করেছিলাম এবং অনেক জীবন রক্ষা করেছিলাম। আর কয়েক মাস সামাজিক দূরত্বের নিয়ম মেনে চলে সেই রোগটির অনেকটা লাগম ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মারাত্মক সেই ভাইরাসটি আবার ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সংক্রমণ বাড়ছে। হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও বাড়ছে। তাই আমি ইংল্যা-ে আরও কঠোর নিয়মের তালিকা প্রস্তুত করেছি। এই নিয়মের আওতায় পাব, বারসমূহ তাড়াতাড়ি বন্ধ করতে হবে। ওইসব স্থানে কেবল টেবিল সার্ভিস দেয়া যাবে। একইভাবে কোভিড সুরক্ষা নয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠাসমূহকেও বন্ধ করতে হবে। ফেইসমাস্ক ব্যবহারের মাত্রা বাড়াতে হবে। আর যারা এসব নিয়ম মানতে ব্যর্থ হবে তাদরেকে জরিমানা গুণতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী কার্ফিউ জারি করা হয়েছে পাব, বার এবং রেষ্টুরেন্টের উপর মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে স্টাফ ও কাস্টমারদের জন্য। মাস্ক না পরলে সর্বোচ্চ ২শ পাউ- জরিমানা। রুল অব সিক্স মানতে হবে সর্বত্র। সেল্ফ আইসোলিশন না করলে বা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত বিধিনিষেধ না মানলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার পাউ- পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা হবে। সংক্রমণ ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত আইন কার্যকর করতে পুলিশকে সহযোগিতার জন্যে প্রয়োজনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে। স্কটল্যাণ্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যা-ে পারিবারিক সাক্ষাৎও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
নতুন আইন অনুযাযী ইংল্যাণ্ড ২৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার থেকে পাব, বার এবং রেষ্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে রাত ১০টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত এবং টেবিল সার্ভিস আরো সীমিত করতে হবে। ৬ জনের বেশী কোনো টেবিলে বসার সুযোগ দেওয়া যাবে না এবং এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের সঙ্গে মিলতে পারবে না। প্রয়োজনে ট্রেইস করার জন্যে কাস্টমারদের কন্টাক্ট ডিটেইলস রাখার ব্যাপারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে আইনী অধিকার দেওয়া হয়েছে। ৬ জনের বেশী রিজারভের্শন নিলে এবং সামাজিক দূরত্ব ও কন্টাক্ট ডিটেইলস দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে সর্বোচ্চ ১০ হাজার পাউণ্ড পর্যন্ত জরিমানা আরোপ করা হবে। টেইকওয়ে লেইজার সেন্টার, সিনেমা, বিঙ্গ হল এবং পর্যটন ব্যবসাও একই নিয়মে চলবে। তবে টেইকওয়ে ডেলিভারী স্বাভাবিক থাকবে।
সোমবার থেকে শুধু কাস্টমার নয়, বার, পাব এবং রেষ্টুরেন্টসহ সব দোকানপাটে স্টাফকে অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। মাস্ক না পরলে সর্বোচ্চ ২শ পাউ- জরিমানা গুণতে হবে। আর বৃহস্পতিবার থেকে ট্যাক্সি এবং প্রাইভেট হায়ার কার বা মিনিক্যাবের যাত্রীদের জন্যেও মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
প্রথমসারির বা প্রধান কর্মকর্তা-কর্মচারী যাদেরকে কর্মস্থলে না গেলে চলে না, তারা ছাড়া বাকী সবাইকে সম্ভব হলে বাড়ী থেকে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। যদিও অগাস্ট থেকে কর্মস্থলে ফেরার জন্যে তাগিদ দিয়েছিল সরকার। সরকারের এধরনের কিছু ইউ-টার্ণের সমালোচনাও আছে।
২৮ সেপ্টেম্বর, সোমবার থেকে বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথির সংখ্যা ৩০জন থেকে নামিয়ে ১৫ জন করতে হবে। তাদেরকে অবশ্যই ৬ জনের গ্রুপে বিভক্ত থাকতে হবে। ফিউনারেলে সর্বোচ্চ ৩০ জন উপস্থিত থাকতে পারবেন। তবে আলাদা আলাদা ৬ জনের গ্রুপ থাকতে হবে।
অক্টোবরে ক্রীড়া অনুষ্ঠানে দর্শক উপস্থিতির ঘোষণা করেছিলো সরকার। এব্যাপারেও ইউ-টার্ণ মেরেছে সরকার। এই সিদ্ধান্ত আপাতত স্থগিত থাকবে। তবে ২৪ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার বার থেকে অভ্যন্তরীণ ক্রীড়ার ক্ষেত্রে রুল অফ সিক্স অর্থাৎ ৬ জনের বেশি জমায়েত হওয়া যাবে না। ফাইভ এ সাইড ফুটবল নিষিদ্ধ।
সেলফ আইসোলিউশন আইন না মানলেও সর্বোচ্চ ১০ হাজার পাউ- জরিমানা আরোপ করা হবে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও যদি সেলফ আইসোলিউশনের নিয়ম ভঙ্গ করা হয় তা হলে তাদেরকেও জরিমানা করা হবে।
স্কটল্যাণ্ডেও পাব এবং রেষ্টুরেন্টে রাত ১০টা থেকে কার্ফিউ জারি থাকবে। অভ্যন্তরে দু পরিবারের কেউ মিলিত হতে পারবে না। তবে বাইরে বা প্রাইভেট গার্ডেনে দুটি পরিবারের সর্বোচ্চ ৬ জন মিলিত হতে পারবে। ২০ বছর থেকে ১৮ বছর বয়সী দু’পরিবারের সর্বোচ্চ ৬ জন মিলিত হবার সুযোগ পাবে। তবে ১২ বছরের নীচের শিশুদের বেলযা বাইওে খেলাধুলার ক্ষেত্রে কোনো বিধি নিষেধ নেই।
উল্লেখ্য, বৃটেনে প্রতিদিন কোভিড আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘন্টায় (বুধবার) নতুন করে সর্বাধিক ৬১৭৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে ৩৭ জনের। গত ১ মে’র পর সর্বাধিক সংখ্যক মানুষ করোনায় আক্রান্ত হলেন। যা করোনা মহামারির শুরুর পর থেকে তৃতীয় সর্বোচ্চ। গত ২৪ ঘন্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ৬১৭৮ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ৯ হাজার ৭২৯ জন।