আন্তর্জাতিকনিউজ

দেশে দেশে ভারতীয় মশলা কেনাবেচায় নিষেধাজ্ঞা, যুক্তরাজ্যে নতুন কড়াকড়ি!

  • ভারতীয় মশলায় ক্যানসারের উপাদান!
  • পচা রুটি, ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে ভারতীয় মশলা!

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।

লণ্ডন, ১৮ মে- ভারতীয় মশলার সুনামে ভাটা পড়েছে। মানব শরীরের জন্য ক্ষতিকর পচা রুটি, ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে ভারতীয় মশলা! মাদ্রাজ কারি পাউডার, সম্বর মাশালা পাউডার, কারি পাউডারসহ একাধিক মশলা নিয়ে এমন অভিযোগ উঠেছে। একাধিক মশলায় ‘কারসিনোজেনিক পেস্টিসাইড ইথিলিন অক্সাইড’ পাওয়া গেছে; যা ক্ষতিকারক। এছাড়া ভারতীয় কোম্পানি এমডিএইচ ও এভারেস্টের মশলায় উচ্চ মাত্রায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান মিলেছে, যার জেরে কোম্পানি দুটির মশলা কেনা-বেচায় হংকং, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া ও নেপালের মত দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। বাজার থেকে ভারতীয় গুঁড়া মশলা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছে। একই সঙ্গে রান্নার কাজে এসব মশলা ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

এদিকে যুক্তরাজ্যে ভারতীয় মশলা নিয়ে নতুন কড়াকড়ি চালু করেছে। ব্রিটিশ ফুড ওয়াচডগ ভারত থেকে সমস্ত মশলা আমদানির উপর অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরোপ করেছে। এমডিএইচ ও এভারেস্ট দুটি ব্র্যান্ডের মশলায় বিপজ্জনক মাত্রায় কীটনাশক রয়েছে এই অভিযোগের পরে সমস্ত ভারতীয় মশলা বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাজ্যের ফুড স্ট্যান্ডার্ডসের তরফে জানানো হয়েছে, ‘বাজারে যেসমস্ত ভারতীয় মশলা বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর দিকে কড়া নজর রাখা হচ্ছে। কারণ ভারতীয় মশলাতে  মাত্রাতিরিক্ত ইথিলিন অক্সাইড ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাজ্যে ইথিলিন অক্সাইডের ব্যবহার নিষিদ্ধ। যদি কোনও খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা যায়, তাহলে ওই খাদ্য প্রস্তুতকারী সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দেশের মানুষকে রক্ষা করতেই এই সিদ্ধান্ত।’

গত ১৫ মে বুধবার ‘MDH and Everest: Indian spices face heat over global safety concerns’ শিরোনামে বিবিসি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত একটি বিশ্বব্যাপী মশলা পাওয়ার হাউস হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতের মশলা বোর্ডের মতে, এটি প্রায় ১৮০টি দেশে ২০০ টিরও বেশি মশলা এবং মূল্য সংযোজন পণ্য রপ্তানি করে, যার মূল্য ৪ বিলিয়ন ডলার। এর অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্য ১০ বিলিয়ন ডলার, যা এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মশলা ভোক্তা করে তুলেছে। কিন্তু এখন, এই বিখ্যাত মশলাগুলির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। গত মাসে, সিঙ্গাপুর এবং হংকং ভারতীয় কোম্পানি এমডিএইচ এবং এভারেস্ট দ্বারা উত্পাদিত কিছু মশলায় উচ্চ মাত্রার ইথিলিন অক্সাইডের সন্দেহে বিক্রি বন্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ফুডস অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) পরীক্ষাতেও এমডিএইচ ও এভারেস্টের পণ্যে এথিলিন অক্সাইডের অতিমাত্রায় উপস্থিতি দেখা গেছে। এফডিএ’র এক মুখপাত্র বলেছেন, ভারতীয় মশলায় ভেজালের অভিযোগ নতুন নয়। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল মশলা রপ্তানি করেছিল ভারত। এর মধ্যে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্যাকেটের মশলায় ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছিল। একই অভিযোগ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তারা জানিয়েছে, ভারত থেকে আমদানি করা মরিচের গুঁড়া ও গোলমরিচে ক্যানসার সৃষ্টিকারী রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, আরব আমিরাত, চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও  ইন্দোনেশিয়ার খাদ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাও ভারতীয় মশলা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিবিসি’র প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ভারত থেকে মরিচ ও গোলমরিচের নমুনায় একই ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ আবিষ্কার করে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ভারতীয় মশলা দূষিত হওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে ইপসিতা মজুমদার নামে একজন বায়োকেমিস্ট্রি বিশেষজ্ঞ  মরিচ, জিরা, কারি পাউডার এবং গরম মশলাসহ কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় মশলা ব্র্যান্ডগুলি পরীক্ষা করে তাতে কমলা ও লাল রংসহ সীসা খুঁজে পান। গত এপ্রিল মাসে, গুজরাটের খাদ্য ও ওষুধ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ ৬০,০০০ কেজিরও বেশি মরিচের গুঁড়া, হলুদ এবং ধনিয়া পাউডার, আচার মশলা ও ভেজাল মশলা জব্দ করেছে।

তাহলে ভারতীয় মশলা কি নিরাপদ? ফেডারেল সরকার সমস্ত রাজ্য সরকারকে মান পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছে। মশলা বোর্ড – যার পাঁচটি গুণমান মূল্যায়ন ল্যাব রয়েছে – ইথিলিন অক্সাইড ব্যবহার পরীক্ষা করার জন্য রপ্তানিকারকদের নির্দেশিকা জারি করেছে৷ ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (এফএসএসএআই)ও নমুনা পরীক্ষা করছে। ভারত কয়েক শতাব্দী ধরে একটি মশলা রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু সরকারের অপর্যাপ্ত মনোযোগের কারণে এই চিত্রটি গত কয়েক বছরে হ্রাস পাচ্ছে। নরসিমা রেড্ডি ডন্থি নামে একজন স্বাধীন গবেষক ও পরিবেশকর্মী বলেছেন, আমরা এখনও জানি না কোন পর্যায়ে দূষণ ঘটছে। কৃষকরা ইথিলিন অক্সাইড ব্যবহার করেন না। এটি সম্ভবত ফসল-পরবর্তী, প্রক্রিয়াকরণ-পরবর্তী অবশিষ্টাংশ।  বারবার অতিরিক্ত অবশিষ্টাংশের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। অতীতে, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আম রপ্তানি কয়েক বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।

দিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) বিশ্বাস করে যে সাম্প্রতিক মানের উদ্বেগগুলি “অনেক দেশে ক্যাসকেডিং নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপের” কারণে ভারতের অর্ধেক মসলা রপ্তানিকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে। চীন যদি ভারতীয় মশলার গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাহলে ভারতের অর্ধেকেরও বেশি বিশ্ব রপ্তানি প্রভাবিত হতে পারে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে যদি ইইউ নিয়মিতভাবে মানহীনতার জন্য ভারতীয় মশলার চালান প্রত্যাখ্যান করে এবং অন্য পাঁচটি দেশ যদি সেগুলি অনুসরণ করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতকে তার রপ্তানির অখণ্ডতা রক্ষার জন্য স্বচ্ছতা, কঠোর প্রয়োগ এবং স্পষ্ট যোগাযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে সংশোধন করতে হবে।

জানা গেছে, এই নকল মশলাগুলো পচা পাতা এবং চাল, নষ্ট বাজরা, কাঠের গুড়া, মরিচের বোঁটা, অ্যাসিড এবং নিম্নমানের তেল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। অভিযুক্তরা এই ভেজাল মশলা একই দামে দিল্লি/ এনসিআরের স্থানীয় বাজার এবং বিক্রেতাদের কাছে ‘খাঁটি মশলা’ বলে সরবরাহ করেছে।

উল্লেখ্য, ‘মশলা উৎপাদনের বৈশ্বিক কেন্দ্র’ তকমা পাওয়া ভারত বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক, ভোক্তা এবং মশলা উৎপাদনকারী দেশ। বিশ্বজুড়ে মোট উৎপাদিত মশলার ১২ শতাংশই উৎপাদন করে দেশটি। সেই সঙ্গে ১৮০টি দেশে তা রপ্তানি করে তারা। বৈশ্বিক বাজারে ভারতের মরিচ-ধনে-হলুদের গুঁড়া, এলাচ, মিক্সড মশলা, হিং, জাফরান, জায়ফল, মৌরি, লবঙ্গ ও দারুচিনিরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বে এগুলো রপ্তানিতে শীর্ষে রয়েছে দেশটির এমডিএইচ ও এভারেস্ট কোম্পানি। ভারতে মশলার বাজারের আকার ১ হাজার কোটি ডলার। বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে প্রতি বছর ৪০০ কোটি ডলার আয় করে ভারত। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে ১২৮ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মশলা আমদানি করেছিল, যার মধ্যে ভারতের ছিল প্রায় ২৩ মিলিয়ন ডলার। এমডিএইচ এবং এভারেস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়া সহ অনেক অঞ্চলে তাদের পণ্য রপ্তানি করে। ভারতীয় নিয়ন্ত্রকরা সমস্ত মশলা পণ্যের পরীক্ষাও পরিচালনা করেছে। এমডিএইচ এবং এভারেস্ট পণ্যগুলির নমুনা পরীক্ষা করেছে, যদিও এখনও পর্যন্ত কোনও ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close