ডেটলাইন ১০ ডিসেম্বর: শূন্য চেয়ারের সামনে বাংলাদেশ
❚ ‘খালেদা জামিনে নেই, জিম্মি আছেন’ প্রমাণিত
❚ চট্টগ্রমা-মায়মনসিংহ-খুলনায় জনসমুদ্র
❚ একদফার দাবীতে সরব রাজপথ
❚ নভেম্বরে মাঠ দখলের চেষ্টা করবে সরকার
❚ পুলিশ আর্মি ও প্রশাসন নিয়ে আতঙ্কে সরকার
❚ দাবী আদায় ছাড়া ঘরে না ফেরার শপথ
।। বিশেষ প্রতিবেদন।।
লণ্ডন, ২৭ অক্টোবর : চৌদ্দ বছরের আওয়ামী শাসনের অবসানে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ ঘিরে সরব হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। সরকারের বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সমাবেশ গুলো পরিণত হচ্ছে এক একটা জনসমুদ্র। চট্টগ্রাম-ময়মনসিংহ-খুলনায় জনসমুদ্রে রূপ নেয়। সবগুলো জনসভায় খালেদা জিয়ার জন্য নির্ধারিত চেয়ারটি খালি থাকায় পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে একটি খালি চেয়ারের সামনে জনসমুদ্র। এটাই প্রতিনিধিত্ব করছে সমগ্র বাংলাদেশ। এদিকে বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের আন্দোলন ঠেকাতে নভেম্বরে মাঠে নামছে সরকার। নভেম্বরে ঢাকায় পাল্টা সমাবেশ দিয়ে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিতে পারে আওয়ামী লীগ। পরবর্তী কোনো সমাবেশ হবে ২৯অক্টোবর শনিবার রঙপুর। তারপর ৫ নভেম্বর বরিশাল, ১২ নভেম্বর ফরিদপুর, ১৯ নভেম্বর সিলেট, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লা, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহী। সর্বশেষ ১০ ডিসেম্বর শনিবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে বিএনপির বৃহত্তম গণ সমাবেশ। ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। পুলিশের উপর নজর রাখছে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। অনেকের ধারণা, ১০ ডিসেম্বরের যে কর্মসূচি সেটা পশ্চিমাদেরই ঠিক করে দেওয়া। বাংলাদেশের সবগুলো অংশে শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশের মাধ্যমে গুছিয়ে এনে ঢাকায় মহাসমাবেশের পরিকল্পনা গত তিন দশকে আর হয়নি। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনে এটি একটি উদাহরণ হতে পারে বলে পশ্চিমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন। আর এই সমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে সরকার ও পুলিশের আচরণ জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে ঘিরে কোন বড় ধরনের উস্কানিমূলক ঘটনা ঘটলে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেয়া হতে পারে চরম কোন ব্যবস্থা।
গওহর রিজভী কোথায়?
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের পর প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভী কোথায়? তিনিও কি নিরাপদ এক্সিটের পথ খুঁজছেন? অনেকেই ধারণা করছেন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতো সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং উপদেষ্টা পশ্চিমাদের রোষানলে পড়ে আছেন। অনেকে ধারণা করছেন, রিজভী গত বছরের নভেম্বরের দিকেই শেখ হাসিনার কাছে তার পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন। কিন্তু তা গ্রহণ না করে প্রধানমন্ত্রী তাকে কোন মধ্যবর্তী ব্যবস্থাপনায় রেখেছেন। শেখ হাসিনার অনেক অমানবিক কাজের দায় তিনি কিভাবে এড়িয়ে যাবেন সেই প্রশ্ন এখন উঠছে?
এদিকে আওয়ামী লীগের সামনে শান্তিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলার কি পথ খোলা আছে? নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের ফলাফল আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ভাবে জানে। সে বিপর্যয় মোকাবেলার জন্যই সমঝোতার অন্য পথ গুলো বিশেষ করে গোল টেবিল অথবা রাজনৈতিক সমঝোতার কোন উদ্যোগ অতি নিকট ভবিষ্যতে সরকার গ্রহণ করবে বলে কোন আলামত এখন পর্যন্ত লক্ষণীয় নয়।
সমাবেশগুলো পরিকল্পিত
বিএনপি জন সমাবেশের আইটিনারী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে চট্টগ্রাম থেকেই অনেক ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা এমনকি এরশাদ পতনের আন্দোলন চট্টগ্রামে সূচনা হয়েছিল। পরবর্তীতে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে ও শেখ হাসিনার আন্দোলন চট্টগ্রাম থেকেই গতি পেয়েছিল। সেদিক থেকে চট্টগ্রামের বৃহত্তর জনসমাবেশ একটা প্রতীকী অর্থ তৈরি করেছে। যা ময়মনসিংহ ও খুলনায় আরো ব্যাপক আকার ধারণ করলো। এদিকে ২৯অক্টোবর পরবর্তী জনসভা হতে যাচ্ছে রংপুরে। সেখানে পার্শ্ববর্তী জেলা বগুড়া ও দিনাজপুর সহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলো থেকে আবারও জনতার ঢল নামতে পারে। তবে প্রতিটি জনসভা কে ঘিরেই সরকার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে বাধা দেওয়ার তা জনসভা গুলোকে ৩—৪ দিন পর্যন্ত সকল মিডিয়ায় প্রধান খবর হিসেবে তুলে ধরছে।
ফরিদপুরের জনসভা স্পর্শকাতর
সুচি অনুসারে ১২ নভেম্বর ফরিদপুর ও ২৬নবেম্বর কুমিল্লা নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ । যদিও বরিশাল এবং সিলেটে এই গণসমাবেশ মানুষের প্লাবনে রূপ নিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ফরিদপুর থেকে অথবা কুমিল্লা সমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ফরিদপুর কুমিল্লায় সরকারি দলের কিছু কৌশলগত অবস্থান এবং মর্যাদার প্রশ্ন জড়িত। সেক্ষেত্রে এইসব সহিংসতার জের ধরে দেশব্যাপী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন অনেকে। এমনকি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার জরুরী আইনে ঘোষণা করতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।
সরকারের ভেতরে অস্থিরতা
এক সচিব এক রাষ্ট্রদূত ২০-১ পুলিশ কর্মকর্তার বরখাস্তের পর প্রশাসন আর্মি ও পুলিশের ভেতর আতঙ্ক তৈরি হয়েছে সরকার কাউকে আসতে নিতে পারছে না আতঙ্ক তৈরি করে সমর্থন অব্যাহত রাখতে পারবে কিনা অথবা জনতার মঞ্চের মত অতিথির ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় কিনা সেই বিষয়গুলো এখন আলোচনার টেবিলে।
ঢাকায় মায়ার হুংকার
ঢাকায় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলছেন, ডিসেম্বরের প্রথম দিন থেকেই ঢাকায় বিএনপিকে রাস্তায় নামতে দেওয়া হবে না। এদিকে ওবায়দুল কাদের বলছেন, বিএনপি’র দশ লাখের বিপরীতে আওয়ামীলীগ ৩০ লাখ লোক নামাবে। এই হুমকির মধ্য দিয়ে সরকারের ভেতরে ব্যাপক অস্থিরতার আলামত পাওয়া যায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অসত্য প্রমাণিত
খুলনার জন সমাবেশকে কেন্দ্র করে রাস্তায় রাস্তায় ধরপাকড় ও হামলা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, কোথাও বিএনপি নেতা কর্মীদের বাধা দেয়া হয়নি। এমনকি গ্রেফতারও করা হয়নি। কিন্তু সাপ্তাহিক সুরমার স্থানীয় সংবাদদাতাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে, মাগুরার শালিখা থানাসহ বেশ কয়েকটি থানায় আগের দিন থেকে কয়েকশো নেতাকর্মীকে আটক করা হয়। এমনকি ২২ অক্টোবর সমাবেশের দিন বিভিন্ন মামলায় (যেসব মামলায় তাদের নাম ছিল না) গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেওয়া হয়। আবার অনেক থানায় ১২ থেকে ২০ ঘন্টা পর্যন্ত নেতাকর্মীদের আটকে রেখে জনসভা শেষ হলে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এর মধ্যে কোন কোন থানায় ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ভোটের আবার দরকার কি? ভোটের আবার দরকার কি ভোট তো দিয়ে গেলাম
খুলনার জনসভায় পার্শ্ববর্তী সদর পার্শ্ববর্তী রূপসা থানা থেকে আসা ৬৫ বছরের বৃদ্ধ আলতাফ আলী আমাদের স্থানীয় সংবাদদাতাকে বলেন, গত ১০ বছর ভোট দিতে পারিনি। এই জনসভায় এসে আমি মনে করি যে আমার ভোট দিতেই আমি এখানে এসেছি। খুলনার আঞ্চলিক ভাষায় তিনি আরো বলেন, রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ কি হাসিনা দেখে না?
কূটনীতিপাড়ার খবর
গত কয়েক সপ্তাহ কূটনীতিকদের কঠিন ভাষায় সমালোচনার পর সরকার আপাতত নীরব আছে। কূটনীতি পাড়া এখন সরগরম। নানা হিসাব নিকাশ চলছে ১০ ডিসেম্বরকে ঘিরে। প্রতিদিনের কার্যক্রম টাইমলাইন আকারে ঢাকায় অবস্থানরত কূটনীতিকরা পর্যবেক্ষণ করছেন বলে ঢাকায় আমাদের সংবাদদাতারা নিশ্চিত করেছেন।
শুক্রবারে পুলিশ গুলি করে না
ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে আন্দোলনে অনেকের মধ্যেই এই ধারণা সক্রিয় শুক্রবার জনসমাবেশ করা হলে পুলিশ ও রেপিড একশন ব্যাটালিয়ন ন্যূনতম ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে সাধারণত গুলি করেনা। কিন্তু ১০ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হওয়ার কারণে হয়তো বিএনপি তার বৃহত্তম সমাবেশ শনিবার দিয়েছে। এখন শুক্রবার না হওয়ায় শনিবার পুলিশ কোন ধরনের সহিংসতায় জড়াবে কিনা সেটি নিয়ে অনেকের সংশয় থাকলেও অভিজ্ঞ সূত্রগুলো বলছে ঢাকায় পুলিশ গুলি চালাবে না। প্রশাসন বাধা দেবে না বরং ঢাকার সমাবেশকে ঘিরে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের পৃথক মঞ্চের সম্ভাবনাও গত কয়েকদিন সচিবালয় পরিস্থিতি থেকে অনেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন।
পুলিশ ও প্রশাসন বিএনপির জনসভাগুলোতে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার নেপথ্য কারণ গতবছরের যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া স্যাংশন। তারা নতুন কোন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে চায় না কারণ বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তাদের ছেলেমেয়েরা আজকাল পশ্চিমা দেশগুলোতে পড়াশোনা করে।
নিষেধাজ্ঞার আগেই অবস্থার অবনতি
রেমিটেন্স প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স প্রবাহ কমছে উদ্যোগ জনক গতিতে। ডলারের মূল্য ব্যাংক ও খোলাবাজারে ১০ টাকারও বেশি পার্থক্য। সুতরাং একটা বড় অংশ রেমিটেন্স এখন আর ব্যাংকিং চ্যানেলে যাচ্ছে না। রিজার্ভের অবস্থা খুবই খারাপ সেটা প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা নিজেই বলেছেন। অন্যদিকে গার্মেন্টসের রপ্তানী আয় কমে আসছে। সুতরাং গার্মেন্টসের উপরে যুক্তরাষ্ট্রের ও ইউরোপের নিষেধাজ্ঞার যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল গত দু’বছর ধরে, সেই নিষেধাজ্ঞা আসার আগেই সেটা অঘোষিতভাবে কার্যকর হয়ে বসে আছে।
১০ ডিসেম্বর ২০২২ আসলে কি হতে যাচ্ছে?
জনসভা-জন সমাবেশ-জনসমুদ্র আর ঢাকায় অবস্থানের মধ্যদিয়ে কি হবে? ১০ ডিসেম্বর আসলে কি হতে যাচ্ছে? দেশে ও দেশের বাইরে? পুলিশ বিডিআর ও সেনাবাহিনী কি করবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর ওই দিনই পাওয়া যাবে। তবে জাতিসংঘ ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বসে নেই। গুম অপহরণ ও রাজনৈতিক অসংখ্য নৃসংসতা ও বর্বরতার দায়ে অভিযুক্ত সরকারের ও তার আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কোনো না কোনো বড় ধরনের ব্যবস্থা ২০২২ এর ১০ ডিসেম্বর কাকতালীয়ভাবে ঢাকায় সমাবেশের একই দিনে ঘোষিত হতে যাচ্ছে বলে আমাদের অনেকগুলো সূত্র মোটামুটি নিশ্চিত করেছে। ঢাকায় সরকারি মহল থেকে কোন বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য আমরা পাইনা। তবে সবদিক বিবেচনায় ডেট লাইন ১০ ডিসেম্বর হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট।