সাবাস আব্দুল কাদের মীর্জা
।। মন্তব্য প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ১৩ জানুয়ারী – মাত্র কয়েক ঘন্টায় মফস্বলের একজন রাজনৈতিক নেতার নাম কোটি কোটি মানুষ জেনে গেলো। শুধুই উল্টো স্রোতের কথা? নাকি সেই বক্তব্যে এমন কিছু আছে, যা কোটি মানুষ মনের কথাটা প্রতিধ্বনি মনে করে মানুষ লুফে নিয়েছেন?
নোয়াখালীর প্রত্যন্ত এলাকা বসুরহাট। গ্রামভিত্তিক এই এলাকায় নানা কারণে আলোচনায় আসে. তবে সেটি আঞ্চলিক পর্যায়ে। জাতীয় পর্যায়ে খুব একটা আলোচনায় আসে না । এবার শুধু আলোচনায় নয়, রীতিমতো রাজনীতির সদর অন্দর কাঁপিয়ে দিলেন সেখানকার একজন স্থানীয় নেতা। হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ অনেকেই করেন, কিন্তু সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণ দিয়ে এভাবে অভিযোগ উত্থাপন নজিরবিহীন। তিনি দুই মেয়াদে পৌরসভা মেয়র ছিলেন। তৃতীয়বারের জন্য লড়ছেন। বরাবরই শাসক দল আওয়ামীলীগ করছেন। সুতরাং তাঁর অভিযোগ শুধু অভিযোগ নয় । জরুরি তদন্ত ও অভিযোগ প্রমানের প্রেক্ষিতে অপরাধী রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ আইনের শাসনের অবশিষ্ট অস্তিত্ব প্রমাণের জন্যই অতীব জরুরি।
‘শেখ হাসিনার যে অর্জন, তা এই কয়েক জন শেষ করে দিয়েছে।’ দলের মনোনয়নে তৃতীয় বারের মতো মেয়র প্রার্থী হয়েছেন তিনি। দলের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরের প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্য প্রকাশ করেই তাঁর এই বক্তব্য। দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের ধর্মীয় কার্যক্রমে উৎসাহী ও অপরাধমূলক কর্মকান্ড এমনকি বিরোধীদের প্রতি সামান্যতম অসদাচরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁর আর এই ধরণের কার্যক্রম প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে যারা এইধরণের কাজ করতে চায়, তাদের সরে পড়ার অনুরোধ জানান। তাঁর এই অনুরোধের মধ্যে সারাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশের একটা সাধারণ ধারণা স্পষ্ট। এইজন্য তাকে অনেক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করলেন।
এতো স্পষ্ট স্বীকারোক্তি আর দুর্বৃত্তায়নের প্রামাণ্য তথ্য গত এক দশকে আর কোনো রাজনৈতিক নেতার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। নিজের দলকে ভালোবেসে এবং দলকে যেকোনো বিপর্যয়ের কবল থেকে রক্ষা করতে আগাম সতর্কতা দিয়ে বললেন- ‘ফেয়ার ইলেকশন হলে কয়েকজন বাদে বাকিরা পালানোর পথও পাবেনা।’ দলীয় নেতাকর্মীদের একইভাবে সতর্ক করেছিলেন তাঁর বড়ভাই ওয়ায়দুল কাদের। চট্টগ্রামে এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন- ‘এতো সম্পদ বানিয়ে কি করবেন, দল ক্ষমতায় না থাকলে, এগুলো নিয়ে পালানোর পথ পাবেন না.’ রাজনীতিতে বিশেষকরে সর্বত্র সীমাহীন দুর্নীতির এই সময়ে তাঁদের দুই ভাইয়ের বক্তব্য বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে।
দলীয় অবস্থানের বিপক্ষে গিয়ে আব্দুল কাদের মির্জা হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি, দুর্নীতি আর অনাচারের জন্য এমপি একরামকে দায়ী করেছেন। অস্ত্রব্যবসা আর চোরাচালানির জন্য ফেনীর এমপি নিজাম হাজারী, পৌর মেয়র প্রার্থী স্বপন মিয়াজী, ইয়াবা মাদক ব্যবসার জন্য তাঁর আপন ভাগ্নে রাহাত (কক্সবাজারের সাবেক এমপি বদি’র নেটওয়ার্কে) এবং এই পুরো অপরাজনীতির চক্রের ইন্ধিনদাতা হিসেবে ইঙ্গিত কৱেছেন মন্ত্রী পত্নীর (ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী) প্রতি। আজকাল মন্ত্রী পত্নীদের মাধ্যমেই আমলা, রাজনীতিক ও অন্যান্য দুর্নীতিবাজগণ তাঁদের সকল অপকর্মের আয়োজন করে থাকেন বলে সাধারণ্যে একটা ধারণা প্রচলিত আছে । কাদের মির্জা’র বক্তব্য জনগণের এই ধারণাকে উদাহরণসহ প্রতিষ্ঠিত করেছে।
রাজনীতিতে এখন সরকারি দল আর তার নেতা কর্মী, সন্ত্রাসী ছাড়া আর কারো প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সুযোগ রাখা হয়নি। সেখানে আব্দুল কাদের মির্জা তাঁর এলাকায় তিন প্রধান দলের তিন সিনিয়র নেতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে বলেছেন- ওবায়দুল কাদের, মওদুদ আহমেদ (বিএনপি ) ও আবু নাছের (জামায়াত) -এই তিনজন গুরুত্বপূর্ণ, তাদের সমমর্যাদার কেউ নাই । এখনতো ওবায়দুল কাদের আর মওদুদ আহমেদের নাম বিক্রি করি । তাঁরা তিনজনতো অসুস্থ, তাঁরা মারা গেলে করা নাম বিক্রি করবেন, কেউ নাই ।
আব্দুল কাদের মীর্জা রাজনৈতিক শিষ্টাচার, সত্য বচন আর সব কিছু ভেঙ্গে পড়ার এই দুঃসময়ে দলকে সতর্ক করে সাধু সাবধান বলে সর্বত্র সুশাসন ফিরিয়ে আনার যে ডাক দিয়েছেন, তার জন্য তিনি দীর্ঘদিন কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। তাঁর আহ্বানে কেউ সাড়া দিবে- এই আশা হয়তো দুরাশা মাত্র। আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এব্যাপারে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন – “শেখ হাসিনা ছাড়া কেউ দলে অপরিহার্য নন” । হয়তো তিনিও এই অসুস্থ অবস্থায় অস্বস্তিতেই আছেন। তবে এটাও ঠিক- ওবায়দুল কাদের তাঁর ভাইয়ের উত্থাপিত বক্তব্য ও কঠিন অভিযোগ গুলো আমাদের রাজনীতির প্রচলিত ধারা মোতাবেক গড়ে অস্বীকারও করেননি। এতে বুঝা যায়- পরোক্ষে হলেও এগুলো হয়তো তাঁরও মনের কথা । কিন্তু দায়িত্বে থেকে তো অনেক কথা বলা যায়না, করাও যায়না।
শেষকথা, মি. আব্দুল কাদের মীর্জা’র অসম সাহসিকতার জন্য তৃতীয় বাংলা থেকে (যুক্তরাজ্য) থেকে তাঁকে অনেক অভিনন্দন । পঁচে যাওয়া রাজনীতির এই দুঃসময়ে দেরিতে হলেও তিনি এই সময় উপযোগী বিষয়গুলো জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। এতে কেউ সংশোধনের উদ্যোগ নেবে কিনা জানিনা, তবে আব্দুল কাদের মীর্জাকে এর জন্য হয়তো চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। কিন্তু মি. মির্জা, আপনি নিশ্চিত থাকুন, একদিন সকলেই স্বীকার করবেন— আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সতর্কবাণী দিয়েছিলেন । আপনি আপনার সাহস ও সত্য উচ্চারণের পথে এগিয়ে যান । মানুষ ও সময় নিশ্চয় আপনাকে মনে রাখবে, চিরদিন।