ওপরের নির্দেশ : নুরেমবার্গ নীতিমালা
।। শফিক রেহমান ।।
(জার্মানির নুরেমবার্গ শহরে আন্তর্জাতিক আদালতে হিটলারের সহযোগী জেনারেলদের বিচারকক্ষ ও ফাঁসীর পর তাদের ফটো গ্যালারী নিজ চোখে দেখার সুযোগ হলো। নৈতিক ও বৈধ বিকল্প থাকা সত্ত্বেও কোনো সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা যদি অপরাধ সংগঠিত করেন, কেবলমাত্র উপরের নির্দেশের কথা বলে তিনি সেই অপরাধের দায়মুক্তি পাবেন না- এটাই নুরেমবার্গ নীতিমালা। জাতিসংঘের আওতায় প্রতিষ্ঠিত নুরেমবার্গ নীতিমালা এখন বিশ্বব্যাপী অনুসরণীয়। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট সাংবাদিক, যায়যায়দিন খ্যাত শফিক রেহমান ২০১৮ সালে একটি নিবন্ধ লিখেন। লেখাটির সর্বজনীনতার বিবেচনায় সাপ্তাহিক সুরমা তা’ পূণ:প্রকাশ করছে- সম্পাদক)
এবার ২০১৮-র আমেরিকা থেকে ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৪৫-এর জার্মানিতে। ১৯৪৫-এ নুরেমবার্গ ট্রায়ালে প্রতিষ্ঠিত হয় নুরেমবার্গ পৃন্সিপলস বা নুরেমবার্গ নীতিমালা। নির্দেশ পালন বিষয়ে কোনো সংকটে কেউ পড়লে তারা শরণাপন্ন হন এই সুবিখ্যাত ও সুপ্রতিষ্ঠিত নীতিমালাতে। তাই ভুক্তভোগীদের এবং নির্দেশদাতাদের জানা উচিত কার দায়িত্ব কতোখানি।
১৯৫২-তে আমার পিতা সাইদুর রহমান জানতেন না এবং ১৯৭১-এ আমিও জানতাম না নুরেমবার্গ নীতিমালার পূর্ণ বিবরণ। এখন এটা জানা থাকলে হয়তো সরকারি কর্মচারিদের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হতে পারে।
আমার প্রকাশিতব্য বই ‘টর্চার : দেশে বিদেশে যুগে যুগে’ থেকে একটি অংশ নিচে পড়ুন।
জার্মানির দক্ষিণ অংশে ব্যাভেরিয়া অঙ্গ রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর নুরেমবার্গ (প্রথম শহর মিউনিখ)। জার্মানির দুটি বিখ্যাত ফুড প্রডাক্ট, জিনজার ব্রেড (আদা মেশানো পাউরুটি) ও সসেজ (শূকর অথবা গরুর মাংসের লম্বা সাইজের কাবাব) যারা খেতে ভালোবাসেন তাদের অতি প্রিয় শহর নুরেমবার্গ। তাদের মতো এই শহরেই বানানো হয় বিশ্ব সেরা জিনজার ব্রেড ও সসেজ।
বিংশ শতাব্দিতে এই নুরেমবার্গ শহর বিখ্যাত হয় জার্মানির নাৎসি পার্টি সদস্যদের বিচার কাজের জন্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ল কমিশন (আন্তর্জাতিক আইন কমিশন) স্থির করে দেয় নুরেমবার্গ ট্রায়ালস অফ নাৎসি পার্টি (Nuremberg Trials of Nazi Party)-তে অন্তর্নিহিত আইনগত নীতিমালা যাকে বলা হয় নুরেমবার্গ পৃন্সিপলস (Nuremberg Principles বা নুরেমবার্গ নীতিমালা)। যুদ্ধ অপরাধ বা ওয়ার ক্রাইমস (War Crimes) বলতে কি বোঝায় তা এই নীতিমালা নির্দিষ্ট করে দেয়। এই নীতিমালা আরো নির্দিষ্ট করে দেয় সংঘটিত অপরাধের কমান্ড রেসপনসিবিলিটি (Command Responsibility) বা নুরেমবার্গ নীতিমালা জানতে হবে। নচেৎ, প্রতিটি অধস্তন কর্মচারি বলতে পারেন, ‘ওপরের নির্দেশে আমি টর্চার করতে বাধ্য হয়েছিলাম।’
এভাবে একজন অধস্তন কর্মচারি নিজের দায়ভার ও দোষ চাপিয়ে দিতে পারেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মচারির ওপর। এবং সেই ঊর্ধ্বতন কর্মচারি দায়ভার ও দোষ চাপিয়ে দিতে পারেন তারও ঊর্ধ্বতন কর্মচারির ওপর। দায়ভার ও দোষ ট্রান্সফারের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রক্রিয়া যদি চলতে থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত প্রশাসনিক পিরামিডের শীর্ষে অবস্থানকারী মাত্র একটি ব্যক্তি সকল অপরাধের জন্য দায়ী হবেন। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি পার্টি ও জার্মান সরকারের সকল অপরাধের জন্য দায়ী হবেন একমাত্র এডলফ হিটলার। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সমন্বয় সংঘটিত সকল অপরাধের জন্য দায়ী হবেন একমাত্র ইয়াহিয়া খান। বাংলাদেশে ২০০৭-২০০৮ এ অন্তর্বর্তীকালীন সেনাসমর্থিত সরকারের সময়ে সংঘটিত সকল অপরাধের জন্য দায়ী হবেন ড. ফখরুদ্দীন আহমেদ অথবা লেফটেনান্ট জেনারেল মইন উ আহমেদ। অর্থাৎ প্রশাসনিক কমান্ডে শীর্ষ ব্যক্তির ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে বাদবাকি সবাই নিজেকে নির্দোষ দাবি করতে পারেন এবং বিচার এড়িয়ে যেতে পারেন।
এই পরিস্থিতি ও যুক্তিকে মোকাবেলা করার জন্য নুরেমবার্গ নীতিমালা তৈরি হয়। নুরেমবার্গ পৃন্সিপলস বা নীতিমালা হলো :
নীতি ১
কোনো ব্যক্তি যদি এমন কোনো কাজ করেন যা আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ রূপে গণ্য তাহলে তিনি তার জন্য দায়ী থাকবেন ও তিনি শাস্তি পেতে পারেন।
নীতি ২
আন্তর্জাতিক আইনে অপরাধ রূপে বিবেচিত কোনো কাজের সময়ে কোনো ব্যক্তিবিশেষ যদি রাষ্ট্রপ্রধান অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারি রূপে কাজ করে থাকেন- তাহলেও সেই ব্যক্তি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তিনি অপরাধমুক্ত হবেন না।
নীতি ৩
যদি কোনো ব্যক্তি তার সরকারের নির্দেশে অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্মচারির নির্দেশে কাজ করে থাকেন এবং সেই কাজ করার সময়ে যদি তার সামনে একটা নৈতিক বিকল্প থাকে তাহলে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় তিনি অপরাধমুক্ত হবেন না। চলতি ভাষায় এই নীতিকে এভাবে বলা যায় : ‘আমি শুধু আমার ঊর্ধ্বতন কর্মচারি (সুপিরিয়র)-এর আদেশ পালন করছিলাম’ এটা কোনো গ্রহণযোগ্য অজুহাত হবে না।
নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আগে এই অজুহাতকে আরো সংক্ষিপ্তভাবে বলা হতো সুপিরিয়রের অর্ডার (Superior’s Orders)। কিন্তু নুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতো হাই প্রোফাইল বিচারের পর এই অজুহাতের নতুন নামকরণ হয় ‘নুরেমবার্গ ডিফেন্স’ (Nuremberg Defense)। সাম্প্রতিক কালে এই অজুহাতের তৃতীয় নাম হয়েছে ‘লফুল অর্ডারস’ (Lawful orders বা আইনসঙ্গত আদেশ)। তিনটি বাক্যই, সুপিরিয়রস অর্ডারস, নুরেমবার্গ ডিফেন্স ও লফুল অর্ডারস- এখন ব্যবহৃত হয়।
নীতি ৪
কোনো ব্যক্তি যদি কোনো অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক আইনে অভিযুক্ত হন তাহলে ফ্যাক্ট ও আইনের ওপর ভিত্তি করে একটি ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার তার আছে।
নীতি ৫
নিচে বর্ণিত অপরাধগুলো আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য :
ক. শান্তির বিরুদ্ধে অপরাধ।
১. আন্তর্জাতিক চুক্তি, সমঝোতা অথবা আশ্বাস লংঘন করে কোনো আগ্রাসী যুদ্ধ বা যুদ্ধের প্ল্যান, প্রস্তুতি ও শুরু করা।
২. উপরে বর্ণিত কোনো কাজের জন্য কয়েকজনের সঙ্গে মিলেমিশে প্ল্যান অথবা চক্রান্ত করা।
সাংবাদিকও বাদ যায়নি: