মুক্তচিন্তা

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘বিলম্বিত’ প্রজ্ঞাপন এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধান

।। ডক্টর এম মুজিবুর রহমান ।।

লেখক: সংবাদ বিশ্লেষক। সাবেক সহকারী অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

এক:
সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েকমাস পূর্বে ২৫শে জুন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন। সেনাপ্রধানের নিয়োগের এক মাস পূর্বে তাঁর এক ভাই তোফায়েল আহমদ জোসেফ রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতাবলে দন্ড মওকুফ হলে জেল থেকে ছাড়া পান। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দন্ডপ্রাপ্ত তাঁর আরো দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদ পলাতক থাকা অবস্থায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে তাদের দুজনের দন্ড মওকুফ করা হয়েছে বলে প্রথম আলো জানিয়েছে । হারিছ আহমদ এবং আনিস আহমদ পুলিশের খাতায় দীর্ঘদিন ধরে পলাতক ছিলেন । আল জাজিরায় প্রচারিত প্রতিবেদনে রাষ্ট্রপতির সাথে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিতির একদিন পূর্বে ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে এই সাজা মাফের প্রজ্ঞাপন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে । তবে বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় হারিছ আহমেদের নাম এখনো রয়েছে ।

ভিত্তিহীন প্রজ্ঞাপন

আল-জাজিরাতে ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শীর্ষক অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র নিয়ে আইএসপিআরের দ্বিতীয় বিবৃতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেনাপ্রধান নিজেও ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রথম আলোতে প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাফের প্রজ্ঞাপনের খবরটি জানান । আইএসপিআর প্রদত্ত প্রথম বিবৃতি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বক্তব্যে আল জাজিরার প্রতিবেদনের বিপরীতে এই তথ্যটি জানানো হয় নাই। আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার ঠিক দুই সপ্তাহ পর তাও আবার একই দিনে তিনটি জায়গা থেকে প্রজ্ঞাপনের সংবাদ প্রচার হওয়াটা কাকতালীয় নাকি মেক আপ তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে?

এছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘বিলম্বিত’ প্রজ্ঞাপনটির আইনগত ভিত্তি নিয়ে দেশের বিশিষ্ট আইনবিদরা তাদের মতামতে পলাতক অবস্থায় এ ধরণের দন্ড মওকুফকে আইনের শাসনের পরিপন্থী বলে আখ্যা দিয়েছেন। ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি রায়ে রাষ্ট্রকর্তৃক কারো সাজা স্থগিত বা মওকুফের ক্ষেত্রে আদালতে আত্মসমর্পণ করা বাধ্যতামূলক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে ষড়যন্ত্রমূলক, পরিকল্পিত, সাজানো ও বানোয়াট মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত হারিছ আহমেদ ও আনিস আহমেদের যাবজ্জীবন সাজা ও অর্থদণ্ড ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে মাফ করা হয়েছে। সরকার যদি আদালতে প্রমাণিত কোনো মামলার ব্যাপারে এ ধরণের উপসংহার টানতে পারেন তাহলে বিচার বিভাগের মতো রাষ্ট্রের অস্তিত্বের কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ এই স্তম্ভটিকে অকার্যকর করার শামিল বলে মনে করেন অনেকে । আদালত দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ে শাস্তি মওকুফ বা স্থগিত করতে মানবিক অথবা বিচারকার্যের দুর্বলতা প্রমাণ ব্যাতিত এরকম দন্ড মওকুফের নজির নেই। এছাড়া আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রকাশের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও দেয়া হয়েছিল। তাই যেকোনোভাবেই দন্ড স্থগিত বা মাফের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হয়ে থাকলে বিষয়টি আগেই আল জাজিরাকে জানানো হলো না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

দুই:
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুয়ায়ী যেদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সাজা মওকুফের কথিত প্রজ্ঞাপন জারি হয়, সেদিনই অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, আইনসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের সচিবকে পাঠানো হয় বলে জানানো হয়েছে । ঢাকার পৃথক দুটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালেও অনুলিপি পাঠানো হয়। কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে প্রথম আলোকে জনিয়েছেন যে, দন্ড মওকুফের প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। শুধু তাই নয় তিনি বলেছেন ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামির সাজা মওকুফের কোনো সুযোগ নাই। আইনমন্ত্রীও জানিয়েছেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। যদিও ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার প্রয়োগের ক্ষেত্রে পলাতক আসামি আদালতে হাজির হওয়ার শর্ত উল্লেখ নাই বলে জানান। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট অন্যরাও কিছু জানেন না বলে জনিয়েছেন। তাহলে এ বিষয়ে কেউই কিছু জানেন না বলে যে বক্তব্য দিচ্ছেন তার জন্য দুটি মতামত পাওয়া যায়।

প্রথম পক্ষ বলছেন যে, তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই বিষয়টি অতি গোপনীয়ভাবে হ্যান্ডল করা হয়েছে তাই কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে এটাতো ইচ্ছা করলেই অতি গোপনীয় করা সম্ভব নয় । কারণ এই প্রজ্ঞাপনের লেজিটিমেসির জন্য হলেও বিভিন্ন বিভাগে নথি প্রেরণ করতে হয়। আর এতগুলো বিভাগে নথি প্রেরণ করা হলো আর কাক পক্ষীও জানলো না, তা কেমন করে হয়? দ্বিতীয় পক্ষের যুক্তি হলো এই প্রজ্ঞাপন কার্যত আগে জারি হয় নাই। আল জাজিরার প্রতিবেদনের পর এটি ব্যাক ডেইট (পেছনের তারিখ) দিয়ে তৈরী করে এখন প্রচার করা হচ্ছে বলে অনেকেই এ বিষয়ে ওয়াকিফহাল নন। এছাড়া দায়িত্বশীল মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সরকারের সিদ্ধান্তের অংশ নয়, এটাও বিশ্বাস করা কষ্টকর। কারণ প্রজ্ঞাপন জারির ‘সময়’ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে প্রজ্ঞাপনের আইনি বিষয়ে চর্বিত চর্বনে মিডিয়াকে সরব রাখা যাবে ।

তাদের বাড়তি যুক্তি হলো, অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট বানানোর যে খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে পেছনের তারিখ দিয়ে প্রজ্ঞাপন সাজানো কোনো বড় বিষয় নয় । তারা বলছেন ব্যক্তি পর্যায়েও আজ-কাল যা হয় তাতে রাষ্ট্রশক্তির মদদ থাকলে কি আর অসম্ভব? দন্ড মওকুফের প্রজ্ঞাপন যদি আগে ইস্যু হয়ে থাকতো তাহলে আইএসপিআরের প্রথম প্রেস বিজ্ঞপ্তি অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বিষয়টি কেন বলা হয় নাই, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রজ্ঞাপন ইস্যুর খবর প্রথমে প্রচার করার সুযোগ থাকলে এর আইনগত ভিত্তি এবং আইনের শাসনের পরিপন্থী হলেও এই তথ্য সরকারের প্রপাগান্ডা মেশিনারিতে অন্তত ফায়দা দিতো।

তিন:
এদিকে প্রথম আলোতে সেনাপ্রধানের দুই ভাই হারিছ আহমদ ও তোফায়েল আহমদ জোসেফ অসত্য তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানানোর চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে । মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট করা আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, হারিছ আহমেদ জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও পাসপোর্ট নিয়েছেন মোহাম্মদ হাসান নামে। আর জোসেফ নিয়েছেন তানভীর আহমেদ তানজীল নামে। দেশের একাধিক থানা ও আদালতের নথিপত্র, সাজা মওকুফ চেয়ে (জোসেফের জন্য) মায়ের করা আবেদনসহ সাজা মওকুফের সরকারি প্রজ্ঞাপনে হারিছ ও জোসেফের বাবার নাম আব্দুল ওয়াদুদ ও মায়ের নাম রেনুজা বেগম লেখা আছে। কিন্তু হারিছ যে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তাতে বাবার নাম সুলেমান সরকার এবং মায়ের নাম রাহেলা বেগম উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু জোসেফের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টে বাবার নাম সোলায়মান সরকার এবং মায়ের নাম ফাতেমা বেগম লেখা আছে।

দুই ভাই পৃথক পৃথক স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো কোন নামের ব্যক্তি এবং কাদের সাজা বাতিল হলো বলে গণ্য হবে। এটাও এক বিরাট জিজ্ঞাসা। এছাড়া দন্ড মওকুফকৃত ব্যক্তিরা তাদের পিতামাতার নামসহ নিজেদের নাম পরিবর্তন করার কারণে দন্ড থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্তদের প্রজ্ঞাপনের আদেশ নিয়েও ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। পূর্বের নামের ব্যক্তিদের সাজা মওকুফ কার্যকর হলে অসত্য তথ্য দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বানানোর কারণে নতুনভাবে শাস্তি হতে পারে। আর নতুন নাম কার্যকর হলে পুরাতন নামের ব্যক্তিদের সাজা মওকুফ কার্যকর হতে পারে না।

এসব কিছু বিবেচনা করে বিশ্লেষকেরা মনে করেন যে, সব সম্ভবের দেশে আল জাজিরার প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার দুই সপ্তাহ পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে যে প্রজ্ঞাপনের কথা বলা হচ্ছে তা ব্যাক ডেইট দিয়ে দেখানোর সম্ভাবনা রয়েছে। আর প্রথম আলো সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দেয়া তথ্য তাদের অনুসন্ধান হিসেবে হয়তো প্রকাশ করতে হয়েছে । যদিও প্রথম আলো গত কয়েকদিন ধরে আরো কিছু তথ্য প্রকাশ করছে। আগামীতে হয়তো এ ব্যাপারে আরো বিশদ জানা যাবে, এ প্রত্যাশা সবার।

পরিশেষে বলা যায় যে, সরকারের মন্ত্রণালয়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের ঘুষ, দুর্নীতি, দলীয়করণ চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়েছে । নির্বাচন কমিশন, দুদকসহ দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ আজ অকার্যকর। স্ট্রিট গ্যাং আর স্টেট গ্যাং এর যাঁতাকলে রাজনীতিতে দূর্বৃত্তায়নের চাষ চলছে আর বাড়ছে মেধাহীন ও বাকসর্বস্বদের দৌরাত্ম । মহান মুক্তিযুদ্ব এবং দেশের ক্রান্তিকালে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অনন্য ভূমিকা জাতি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণে রাখে। কিছু কর্মকর্তার বিতর্কিত কর্মকান্ডের পরেও শৃঙ্খলিত বাহিনী ও দৃষ্টান্ত দিয়ে নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের গর্ব এবং শেষ ভরসার জায়গা সেনাবাহিনীর প্রতি গণ মানুষের সর্বোচ্চ আস্থা এখনো অটুট রয়েছে বলে মনে করি। এই আস্থার জায়গাতে যাতে কেউ চিড় ধরাতে না পারে সেদিকে সংশ্লিষ্ট সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখা জরুরি।
লণ্ডন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১।।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close