|| সৈয়দ হিলাল সাইফ ||
একমাত্র বাঙালি জাতি ছাড়া পৃথিবীর কোনো জাতি ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি। এটিই বাঙালি জাতির সব’চে বড় অহঙ্কার। তখন পাকিস্তানে বাংলাভাষীরা উর্দুভাষীদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল।১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’।জিন্নার মৃত্যুর পর বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহ’র কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময়ও একইভাবে জোরালো প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষার দাবিতে সেদিন যাঁরা আন্দোলন করেছিলেন, পাকিস্তানি পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। আমরা বিশেষভাবে স্মরণ করি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের বীর সৈনিকদের। বস্তুত, তাঁদের অবদান ও আত্মত্যাগের ফলেই যেমন রক্ষা পেয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিসংগ্রামের প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি। ভাষা আন্দোলনের চেতনা প্রতিটি বাঙালি সত্তায় মিশে আছে।
বর্তমানে ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু বাঙালির একার নয়। ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি ৫২র একুশে ফেব্রোয়ারী ৪৪ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বেরহলে পুলিশের গুলিতে বাংলা ভাষার জন্য আমাদের সোনার ছেলেরা প্রাণ দিয়েছেন,সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর সহ আরো কত নাম না জানা শহিদেরা। আমরা তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছি যুগের পর যুগ ধরে।
সেই নাম না জানা শহীদদের কখনো কি খোঁজার চেষ্টা করেছি ? সেদিন কতজন শহীদ হয়েছিলো ? ৫২ পরে কোন সরকারের কাছে আসলেই কি সঠিক কোন তথ্য ছিলোনা ? কোন দিনই কি সঠিক শহীদ সংখ্যা জানা হবেনা ? এইসব প্রশ্ন মনে উকি দেয়। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পর আজো তা রয়েগেছে অজানা।
সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউর এর বাইরে আর কে কে, কোথায় মারা গেছেন তা জানতে হলে আমাদের তখনকার পত্রিকা বা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বইয়ের পাতা উল্টাতে হবে।
তৎকালীন সময়ের শীর্ষস্থানীয় পত্রপত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিলো এমন ;
১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পত্রিকা ‘সৈনিক’-এর প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘শহীদ ছাত্রদের তাজা রক্তে রাজধানী ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত’। ২১ তারিখে ৭জন নিহত এবং তিন শতাধিক আহত বলে খবরে প্রকাশ করে।
আনন্দবাজার পত্রিকার ২৩ ফেব্রুয়ারি সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘বৃহস্পতি ও শুক্রবার মোট ৯ জন নিহত’। আবার অন্য একটি সংবাদে ‘পুলিশের গুলিতে গতকল্য ও অদ্য এ যাবত ৬ জন নিহত হয়’ খবরে উল্লেখ করা হয়।
দৈনিক আজাদের ওই সময়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো” ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল। এবং বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।”
২০০৮ সালে লাহোরে প্রকাশিত পাকিস্তানের নির্বাসিত লেখক লাল খান তার পাকিস্তানস্ আদার স্টোরি: দ্য ১৯৬৮-৬৯ রেভল্যুশন বইয়ে লিখেছেন, “পুলিশের গুলিতে ২৬ জন নিহত এবং ৪০০ জনের মতো আহত হয়েছিলো।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন, “২১ ফেব্রুয়ারি, ‘গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হলো। আহত হলো ৩০ জন।’ জানা যায়, ৬২ জনকে জেলে ঢোকানো হয়েছে। আরও শোনা যায়, পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন।’ ২২ ফেব্রুয়ারি, তিনি লিখেছেন, ‘’আজ স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকল। হাইকোর্ট, মানসী সিনেমা হল ও ডিস্ট্রিক্ট কোর্টের আশপাশে গুলিবিদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেল। বেসরকারি সূত্র অনুয়ায়ী মৃতের সংখ্যা ১২, আহত বহু।”
ভাষাসৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখিত একুশের প্রথম কবিতায় বলা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি “ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি
যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে—রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়”
সত্তর বছর পেরিয়ে গেলেও আজো আমরা জানিনা ভাষা শহীদদের সঠিক তথ্য। তারা সংখ্যায় কতজন, কোথায় ছিলো তাদের বাড়ি, কি ছিলো নাম। কতটুকু চেষ্টা করা হয়েছিলো তাও জানিনা।সরকার আজো কোন উদ্যোগ নিয়েছেন কি না। বায়ান্নের ২১-২২ ফেব্রুয়ারী ভাষা শহীদরা কোন নেতৃস্থানীয় কেউ ছিলেন না বলে হতেও পারে এই উদাসীনতা! তবে এই কথা অনস্বীকার্য ওইসব সাধারণ মানুষের রক্তের পথধরে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে একদিন আমরা পেয়েছিলাম আমাদের কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
তথ্যসূত্র; গুগুল ও বিভিন্ন অনলাইন বাংলা পত্রপত্রিকা।