আন্তর্জাতিকনিউজমুক্তচিন্তাহোম

নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ: মোদীর লাগাম টেনে ধরেছে ভারতের জনগণ 

।। রূপম রাজ্জাক।।

লন্ডন, ৫জুন।। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচন যেন গণতন্ত্রের এক ঝলমলে আয়োজন। নির্বাচনকে ঘিরে নরেন্দ্র মোদি, তার সরকার ও দলের নানা অনিয়ম-অনাচার সত্বেও ভোটের মাঠে বিরোধীরা খুব স্পিরিটেড ক্যাম্পেইন পরিচালনা করেছে। অনেকে ধরে নিয়েছিল এবারও বিজেপিরই অসম দাপট চলবে। শেষ ধাপের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ামাত্র যে এক্সিট পোল বের হয়েছিল তাতেও সেফোলজিস্টরা সেই পূর্বাভাসই দিয়েছিল। সবকিছু পুরোপুরি মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়ে ভোটগননার দিনটি হয়ে উঠলো সবচেয়ে আকর্ষণের দিন।

নির্বাচনে বিরোধী জোট ক্ষমতায় ফিরতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দল বিজেপিও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে পারেনি। তবু উভয়পক্ষই যেন জয়ী হওয়ার অনুভূতি পাচ্ছে। বিরোধী পক্ষ খুশি বিজেপির শত বাধা, অত্যাচার ও প্রোপাগাণ্ডা সত্বেও প্রধান রাজ্যগুলোতে বিজেপির প্রায় অভেদ্য দূর্গ ভেংগে তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রুখে দিয়েছে এবং ভাবছে এই রায় সংবিধান রক্ষার পক্ষে চাওয়া জনতার রায়। অন্যদিকে বিজেপি ভাবছে জোট করে হলেও তারা টানা তৃতীয় বারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে পারছে।

অন্যদিকে সুশীল সমাজ মনে করছে, এই রায়ে প্রকৃতপক্ষে জনগণের জয় হয়েছে। জনগণ বিজেপির স্বৈরাচারী আচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহার রুখতে ভোটের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে। বুঝিয়ে দিয়েছে ক্ষমতা চিরস্থায়ী কিছু নয়। এজন্য বিজেপির হিন্দুত্ববাদের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তোলা ৫০০ বছরের আরাধ্য রামমন্দিরের স্থান অযোধ্যায়ও জয় পায়নি। অথচ তারা ভেবেছিল ৮০% হিন্দু জনগোষ্ঠীর সে আসনে তারা অবধারিতভাবে জিতবে। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জয়ের মার্জিন এবার মাত্র দেড় লাখে নেমে এসেছে।

লক্ষনীয়ভাবে, এই নির্বাচনে বিজেপির দুর্দান্ত সংগঠনটি সেই সব রাজ্যে সিট হারিয়েছে যেসব রাজ্যে তারা ঘৃণা ছড়ানোর কাজটি বেশি করেছে, রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে বিরোধীদের দমন করেছে বা বিরোধী শক্তিকে বিভক্ত করেছে। উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ তার প্রথম সারির উদাহরণ। যে চারটি রাজ্য লোকসভায় সবচেয়ে বেশি আসন সরবরাহ করে তার মধ্যে এই তিনটি পড়ে৷ অন্যটি হলো বিহার, সেখানে বিজেপি জোট খুব একটা সিট না হারালেও গতবারের চেয়ে ৮টি আসন খুইয়েছে।

এই নির্বাচনের ফলাফলের পর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে নরেন্দ মোদি-অমিত শাহ জুটির পরাজয় ও তারা আসন্ন কোয়ালিশন সরকারে কতটা মানিয়ে নিতে পারবে। কারণ এর আগে তারা জাতীয় পর্যায়ে কখনো এমন পরাজয়ের স্বাদ পায়নি এবং কোয়ালিশন সরকার চালায়নি।

এই মুহুর্তে কিং মেকারের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা চন্দ্রবাবু নাইডু ও নিতিশ কুমারকে তারা কতটা ছাড় দেবে তা সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। চন্দ্রবাবু এর আগে বিজেপির দ্বারা অনেক হেনস্তার শিকার হয়েছেন। ফলে ধারণা করা যায় তিনি বিজেপির সাথে নিশ্চয়ই বড় দাবি আদায়ের মাধ্যমে থাকবেন। নিজ রাজ্যের বহুল কাংখিত স্পেশাল স্টাটাস চাইবেন, কেন্দ্রে বড় পাওয়ার শেয়ার চাইবেন ও এমনকি স্পিকারের পদও চাইতে পারেন। নিতিশ কুমারও অনেককিছু চাইবেন। এমনকি উপ-প্রধানমন্ত্রী পদও চাইতে পারেন।

এই নির্বাচন ছিল জনগণ কর্তৃক বিজেপির লাগাম টেনে ধরার নির্বাচন। একইসাথে বিরোধী পক্ষের প্রতি আস্থা রাখা তথা দায়িত্ব অর্পণের নির্বাচনও বটে। জনগণ চেয়েছে বিরোধীরা যেন শক্তিশালী বিরোধীদল হিসেবে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করে।

এই নির্বাচনকে অনেকে বিজেপির ক্ষয়ের শুরু হিসেবেও দেখছে। যেমনটি হয়েছিল কংগ্রেসের ক্ষেত্রে ১৯৮৯ সালে। আগের নির্বাচনেই ৪০০ এর বেশি আসন পাওয়া সত্ত্বেও সেবার তারা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। অন্যদিকে, কেউ কেউ এই নির্বাচনকে কংগ্রেস তথা রাহুল গান্ধী-প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভাই-বোন যুগলের দাপটের শুরুও বলছে। কারণ যে পরিমাণ ঘৃণা ও অব্যাহত পরাজয়ের মাধ্যমে তারা এ পর্যায়ে এসেছে তা অভাবনীয়।

সবমিলিয়ে, গণতান্ত্রিক চর্চার এই উদযাপন দারুণভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ভারতসহ উপমহাদেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের মাঝে।

রূপম রাজ্জাক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close