বাউল সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তি শাহ আব্দুল করিম
পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যাদের মেধা ও প্রজ্ঞা একান্ত বিধাতা প্রদত্ত । কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়ে ও যিনি নিজ প্রতিভায় এদেশের কোঠি মানুষের হৃদয়ে ঠাই নিয়েছেন একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্টান হিসাবে তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশের খ্যাতনামা বাউল সাধক শাহ আব্দুল করিম । ১২ সেপ্টেম্বর হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই কালজয়ী শিল্পির ১১তম মৃত্যু বার্ষিকি । যার গানের প্রতিটি কথা হাজারো বাউল ভক্তকে আজও মুগ্ধ করে ।কি অসম্ভব মেধা নিয়ে তিনি জন্ম নিয়েছিলেন এই ধরনীতে তাঁর গানের গভীরে পৌছলেই কেবল অনুধাবন করা যায় । আমাদের জন্য রেখে গেছেন তিনি বিশাল গানের ভান্ডার ।যে গান গুলো তাঁকে আমাদের মাঝে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল ।
বাংলা বাউল গানের জীবন্ত এই কিংবদন্তির জন্ম ১৯১৬ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলাস্থ উজানধল গ্রামে। বাবা মরহুম ইব্রবহিম আলী ও মা নাইওরজান বিবি। বাবা ইব্রাহিম আলী ছিলেন পেশায় দিনমদুর। অভাবের সংসারে জন্ম তাঁর। নুন আনতে যেন পান্তা পুরায় অবস্থায় কাঠিয়েছেন তিনি শৈশব কাল। পরিবারের ছয় সন্তানের মধ্যে শাহ আব্দুল করিম ছিলেন একমাত্র ছেলে আর বাকীরা সবাই মেয়ে। দিনমজুর বাবার একমাত্র ছেলে সন্তান হওয়াতে শাহ আব্দুল করিমের ছেলে বেলা কেঠেছে চরম দারিদ্রতা এবং দুঃখ কষ্টের মধ্যে। ফলে কোন স্কুল কলেজে ভর্তি হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি তিনি ।যে বয়সে তাঁর স্কুলে থাকার কথা সে বয়সে তাকে কাঠাতে হয়েছে গরু রাখার কাজে। উল্লেখ্য একটা সময় তাঁকে বাধ্য হয়ে গরু রাখার চাকুরী নিতে হয় । কিন্তু ছোট বেলা থেকে সঙ্গীতের প্রতি একটি জোক তাঁকে সব সময় আছন্ন করে রাখতো। তিনি যখন মাটে গরু রাখতেন তখন তাঁর হাতে থাকতো একটি একতারা ।এই একতারায় তিনি সুর তুলে আপন মনে গেয়ে যেতেন গান। কিন্তু কেউ কি জানতো গ্রামের সেই রাখাল ছেলে একদিন দেশের বাউল সম্রাট উপাধী পেয়ে দেশে বিদেশে এতোটা খ্যাতী অর্জন করবেন।
শাহ আব্দুল করিম যে সময়টাতে জন্ম গ্রহণ করেন তখন পাড়া গাঁয়ে লেখা পড়ার কোন পরিবেশ ছিলো না । গ্রামে ছিলোনা স্কুল কলেজ ।আর দরিদ্র হলেতো কথাই নেই । লেখাপড়া ছিলো একেবারেই অসম্ভব । তিনি ১৫ বছর বয়সে লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে যে নৈশ্য বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সেটি বন্ধ হয়ে যায় তাঁর ভর্তি হওয়ার ৮ দিনের মাথায় । অন্য কোন স্কুলে ভর্তি হবেন সে সুযোগ ও পাননি ।ফলে এই অক্ষর জ্ঞানই ছিলো একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । তবে তিনি ছোট বেলাতে গানের তামিল নিতে ভুল করেননি । তাঁর গাণের ওস্তাদ ছিলেন কমর উদ্দিন ,সাধক বশির উদ্দিন ও শাহ ইব্রাহিম মোস্তান ।মাত্র ৮ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উটা এই বাউল শিল্পি তাঁর তিরানব্বই বছরের জীবদ্দশায় দেড় হাজারেরও বেশী গান রচনা ও সুরারোপ করে গেছেন । তার গান গুলো প্রথম দিকে শুধু ভাটি বাংলায় জনপ্রিয়তা পেলেও কালক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে ।এখন দুই বাংলায় (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ) তাঁর গান সমান জনপ্রিয় ।সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের অনেক খ্যাতনামা শিল্পি নতুন করে আব্দুল করিমের গান গেয়ে শুধু জনপ্রিয়তাই পাননি এই গান শুলোকে দেশে বিদেশে করে তুলেছেন ব্যাপক পরিচিত।শাহ আব্দুল করিমের জনপ্রিয় উল্লেখযোগ্য গান হচ্ছে গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান, কোন মেস্তুরি নাও বানাইলো, গাড়ী চলে না চলে না , আমি কুল হারা কলঙ্কিনি, বসন্ত বাতাসে সইগো, আমি এই মিনতি করিরে,রংয়ের দুনিয়া আর চাই না,সখী কুঞ্জ সাজাওগো, আমি বাংলা মায়ের ছেলে –ইত্যাদি ।শাহ আব্দুল করিমের লেখা গান নিয়ে এ পর্যন্ত ছয়টি বই প্রকাশিত হয়েছে ।বই গুলো হচ্ছে আপ্তাব সঙ্গীত, গণ সঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, জাতির চিঠি, কালনীর তীরে এবং দোলমালা । বাংলা একাডেমি তার দশটি গান ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ করেছে । তাঁর লিখিত প্রতিটি গানের কথায় যেমনি ফুঁটে উটেছে ভাটি বাংলার মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনার কথা তেমনি তিনি কলম ধরেছেন তৎকালীন কুসংস্কারাঞ্চন্ন সমাজ ব্যবস্থা এবং সামাজিক বৈসম্যের বিরুদ্ধে ।ধর্মীয় গোড়ামী ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে গান লিখতে গিয়ে অনেক সময় তিনি মৌলবাদীদের আক্রোশের শিকার ও হয়েছেন । তিনি অনেক সময় অত্যাচারিত হয়ে গ্রাম ছেড়েছেন কিন্তু গান ছাড়েননি ।৫৪ সালের যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন থেকে শুরু ,৬৯এর গণঅভ্যুথ্থান , ৭১ এর স্বাধীণতা যুদ্ধ এবং সর্বশেষ ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সহ বাঙ্গালীদের দাবী আদায়ের প্রতিটি সংগ্রামে তার স্বরচিত গান গুলো দেশের মানুষকে আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছে ।
আব্দুল করিমের জীবন কেঠেছে উজানধল গ্রাম আর কালনী নদীর তীরে । এই মরমী শিল্পি আমাদের জন্য যে সকল কালজয়ী সঙ্গীত সৃষ্টি করে গেছেন তা আজও এদেশের মানুষকে আন্দোলিত করে । বলতে দ্বিধা নেই তার সৃষ্ট গান গুলোএদেশের সঙ্গীতকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে । তাঁর গানে যেমন রয়েছে নতুনত্ব ,তেমনি রয়েছে শরিয়তি, মারিফতি ও দেহতত্ব । প্রতিটি গানে আছে প্রেম, বিরহ এবং পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ।বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাপনকে তিনি সহজ সরল ভাষায় ফুটিয়ে তোলেছেন গানে গানে । যেমন –
”গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/ মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম/ হিন্দু বাড়িনতো যাত্রা গান হইত /নিমন্ত্রন দিতো আমরা জাইতাম/ আগে কি সুন্দর দিন কাঠাইতাম/ বর্ষা যখন আইত /গাজীর গান হইত /রং ঢংয়ে গাইত আনন্দ পাইতাম/ কে হবে মেম্বার কে গ্রাম সরকার আমরা কি তার খবর রাখিতাম /আগে কি সুন্দর দিন কাঠাইতাম/ দিন হতে দিন আসিতেছে কঠিন/ করিম দিনোহীন কার কাছে যাইতাম ।”
গ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবন যাত্রা আর চাওয়া পাওয়ার কথা এভাবে তুলে এনেছিলেন তাঁর গানে।প্রিয়তমা স্ত্রী আফতাবুননেছা ছিলেন তাঁর গানের প্রেরণা । যাঁকে তিনি ভালোবেসে সরলা নামে ডাকতেন ।অভাবের সংসারে প্রিয়তমা পত্নি বিনা চিকিৎসায় মারা গেলে তিনি গান লিখেছিলেন
“আর জ্বালা সয়নাগো সরলা /
আমি তুমি দুজন ছিলাম
এখন আমি একেলা ।”
শাহ আব্দুল করিম জীবদ্দশায় একুশে পদক, চ্যানেল আই মিউজিক এওয়ার্ড সহ দেশে বিদেশে অসংখ্য সম্মান ও সম্মাননা পেয়েছেন। যদি ও কোন সম্মান ও এওয়ার্ডের তোয়াক্কা কখনো করেননি গ্রামের রাখাল থেকে বাউল সম্রাট উপাধি পাওয়া এই কিংবদন্তি শিল্পি । চলচিত্র নির্মাতা শাকুর মজিদ ভাটির পূরুষ একটি ডকুমেন্টারি মুভি করেছেন তাঁর উপর । কৃতিমান এই মানুষটির নামে সরকারী উদ্যোগে ঢাকা অথবা সিলেটে একটি একাডেমি প্রতিষ্টা করে তাঁকে যতাযত সম্মান প্রদান এবং তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরী ।অন্যতায অনাদর আর অবহেলায় একদিনতিনিও হয়তো হারিয়ে যাবেন আমাদের মধ্য থেকে ।
২০০৯ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম সিলেটের নুরজাহান পলি ক্লিনিকে চিকিৎসারত অবস্থায শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন ।তিনি চলে গেলে ও তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি বাংলার বাউল গানের মধ্য দিয়ে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন চীরকাল ।
লেখক: সংগঠক ও কলাম লেখক, নিউইয়র্ক ।