নিউজ

হাওর উন্নয়নের নামে লুটপাট, কৃষকের কপাল পুড়ছে

  • উন্নয়নের নামে মানুষ মারছে, বোরো ধান তলিয়ে গেছে।
  • পরিকল্পনামন্ত্রী বললেন, হাওরে সড়ক বানিয়ে পায়ে কুড়াল মেরেছি।
  • হাওরে উড়াল সড়ক নির্মাণে ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন প্রকল্প।
  • উড়াল সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে ১৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা।

সুরমা প্রতিবেদন: উন্নয়নের নামে দেশের হাওর অঞ্চলগুলোতে সরকারি অর্থ লুটপাটের মহোৎসব চলছে। হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ এখন লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। এক কিশোরগন্জের হাওরে সড়ক নির্মাণেই কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়েছে। এ উন্নয়নের বিষবৃক্ষ থেকে কী অমৃত ফল আমরা লাভ করেছি, এটা দেখতে হলেও আপনাকে দেশের হাওর অঞ্চলগুলোতে যেতে হবে। হাওরে অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, হাওর উন্নয়নের নামে অবাধ লুটপাট ও দুর্নীতির অমৃত মহোৎসবের ফলে কৃষকের বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হাওর অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে বোরো ধান। দেশের মোট ধানের এক-পঞ্চমাংশ হাওরে উৎপন্ন হয়। পাকা ধান কাটার আগেই বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকের জীবন-জীবিকা ব্যাপক হুমকির মুখে পড়েছে। এবারে বোরো ধান পরিপক্ব হওয়ার আগেই বাঁধ ভেঙে আধাপাকা ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। “অহন আর বুঝতেছি না আমরা কী খামু, আর গরুরে কী খাওয়ামু? মড়ক লেগেছে হাওরে বিচরন করা হাঁস আর মাছেও। দফায় দফায় ধান-চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম বাড়ছে। দুই চোখে এখন খালি অন্ধকার।“ বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান হারিয়ে এভাবেই আহাজারি করছেন হাওরের বাসিন্দারা। গত কয়েকদিন থেকে হাওর পাড়ে চলছে যেনো কারবালার মাতম। হাওর ভরা সোনার ধান তলিয়ে গেছে , সারা বছরের খোরাক, চিকিৎসা, বস্ত্র, বিয়ে শাদি সবই বানের জলে ভেসে গেছে।

হাওরে সড়ক বানিয়ে পায়ে কুড়াল মেরেছি: পরিকল্পনামন্ত্রী

হাওরের মাঝখানে সড়ক নির্মাণ করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। তিনি বলেছেন, ‘এখন টের পাচ্ছি, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। হাওরে সড়ক বানিয়ে উপকারের চেয়ে অপকারই হয়েছে।’ শনিবার রাজধানীর প্রেসক্লাবে এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এসব কথা বলেন। ‘পরিবেশ দূষণ ও প্রতিকার’ শিরোনামে সেমিনারটি আয়োজন করে বাংলাদেশ সেন্টার ফর হলিস্টিক স্টাডিজ। ২০২০ সালে কিশোরগঞ্জে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ ইটনা-মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম সড়ক চালু করে আওয়ামী সরকার। প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘হাওরে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁদের হক আছে শহরে যাওয়ার জন্য। সরকারের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল। তখন আমরা হাওরে চমৎকার সড়ক নির্মাণ করেছি। কিন্তু এখন টের পাচ্ছি, ওই সড়ক বানিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। এটা আরও ক্ষতি হবে।’ এম এ মান্নান বলেন, হাওরে সড়ক নির্মাণ করে মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গল হয়েছে। সড়কের কারণে পানির চলাচলের পথ রুদ্ধ হচ্ছে। বর্ষার সময়ে পানি উপচে বাড়িঘরে উঠছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। হাওরের নিজস্ব প্রজাতির মাছ, গাছ—হিজল, কড়চ, পানকৌড়িসহ বিভিন্ন প্রাণী-বৃক্ষ ধ্বংস হচ্ছে। হাওরকে হাওর হিসেবেই থাকতে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

হাওরে এবার উড়ালসড়ক, ব্যয় ৬ হাজার কোটি টাকা

কিশোরগঞ্জের হাওরে এবার একটি উড়ালসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। এটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে, যা জোগান দেওয়া হবে সরকারের কোষাগার থেকে। উড়ালসড়ক নির্মাণের এই উদ্যোগ নিয়ে দুটি প্রশ্ন তৈরি হয়েছে—১. অর্থনীতির ওপর চাপ ও কৃচ্ছ্রসাধনের এই সময়ে বিপুল ব্যয়ে হাওরে উড়ালসড়ক নির্মাণের উদ্যোগ কতটা যুক্তিযুক্ত। ২. উড়ালসড়কটি দিয়ে যে পরিমাণ যানবাহন চলাচল করবে বলে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত। হাওরে প্রতি কিলোমিটারে এই উড়াল সড়ক নির্মাণে ব্যয় হবে ১৮১ কোটি ১১ লাখ টাকা। যেখানে ভুলতায় চলমান চার লেনের ফ্লাইওভার নির্মাণে সংশোধিত ব্যয় প্রতি কিলোমিটারে ১৩২ কোটি টাকা এবং মুক্তারপুর সড়কে ১০০ কোটি টাকা। চট্টগ্রামে উড়াল সড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় করা হচ্ছে ১২০ কোটি টাকা। এমনকি পাশের ভারত ও মালয়েশিয়ার চেয়েও হাওরের নির্মাণে অনেক বেশি খরচ। আর এই প্রকল্পে সড়কের ওপর সেতু নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ৯৩৩ কোটি টাকা। অন্য দিকে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য প্রতি মাসে পরামর্শকের বেতনখাতে যাবে জনপ্রতি ৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। তবে অথনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ও কৃচ্ছ্রসাধনের এ সময়ে বিপুল ব্যয়ে হাওরে উড়াল সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ কতটা যুক্তিযুক্ত, তা বিবেচনা করতে হবে। এ উদ্যোগ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আজ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলা সদর থেকে করিমগঞ্জ উপজেলার মরিচখালী পর্যন্ত ১৫.৩১ কিলোমিটার উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হবে। এখানে প্রকল্পের আওতায় ১৩.৪০ কিলোমিটার সড়কও নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছে, ভৌগোলিকভাবে এ হাওর অঞ্চল বেশ পশ্চাৎপদ। বছরের প্রায় ছয় মাস এই এলাকা পানির নিচে থাকে। একটিমাত্র ফসল বোরো ধান বছরে উৎপাদন হয়। শরৎকালে যখন পানি কমে যায়, তখন সড়ক ও নৌ উভয়পথই ব্যবহারের অনুপযোগী থাকে। তাই পাঁচ হাজার ৬৫১ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সোয়া পাঁচ বছরে এই প্রকল্প সমাপ্তির প্রস্তাব করা হয়েছে; যা আগামী ২০২৮ সালের জুনে সমাপ্ত হবে। ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৫.৩১ কিলোমিটার উড়াল সড়কে মোট ব্যয় দুই হাজার ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। প্রতি কিলোমিটারে খরচ ১৮১ কোটি ১০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। এ দিকে সেতু বিভাগের অধীন বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটী থেকে মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত করা এবং দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প চলমান আছে। ওই প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। প্রায় ৮২ কোটি টাকা বেশি। তুলনামূলক পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশের পাশে ভারতের কলকাতায় গত বছরে উদ্বোধন হয়েছে মহানগরীর দীর্ঘতম পরমা ফ্লাইওভার। ৮ দশমিক ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারে ব্যয় হয়েছে ৩৯২ কোটি টাকা। যার কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ৪৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সম্প্রতি চীনের ১০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। মালয়েশিয়ায় ১০ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় হয়েছে ৫৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর দেশের ভেতরে এক হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকায় মৌচাক-মগবাজার, মালিবাগ সড়কের প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৩৫ কোটি টাকা। ১০৫ কোটি টাকার কুড়িল ফ্লাইওভারে কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ৯০ কোটি টাকা। এক কিলোমিটারেরও কম দৈর্ঘ্যরে বিজয় সরণি-তেজগাঁও ফ্লাইওভার নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খিলগাঁও ফ্লাইওভারের গড় ব্যয় ছিল ৭৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রকল্পে ১৩.৪০ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্তকরণে লাগবে ৪৩৩ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। প্রতি কিলোমিটারে খরচ হবে ৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। মোট ১.২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ দু’টি সেতু সড়কের ওপর নির্মাণ করা হবে; যাতে ব্যয় ধরা হযেছে এক হাজার ১৪৭ কোটি ৪৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা। প্রতি কিলোমিটারে খরচ ৯৩২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। ১৩টি টোল প্লাজায় ২১ কোটি ৩০ লাখ ৫১ হাজার টাকা। ১২.৯১ কিলোমিটার অস্থায়ী সাবমারসিবল সড়কে খরচ ৯৯ কোটি টাকা। চারটি ডিপ টিউবওয়েল বসাতে চার কোটি টাকা। চারটি ফুটওভার ব্রিজে আট কোটি টাকা। কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড নির্মাণে ৯৮ কোটি টাকা। ৪০ কোটি টাকায় বাসস্টপেজ নির্মাণ। ১৫১.০৯ একর জমি অধিগ্রহণে ২৬৬ কোটি ৯ লাখ ১৪ হাজার টাকা। প্রকল্পের কাজের জন্য পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হবে ৯৮৮ জনমাস; যাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫ কোটি ৬১ লাখ ১৩ হাজার টাকা। প্রতি জনমাসে খরচ চার লাখ ৬০ হাজার টাকা। উৎসব ও অনুষ্ঠানের জন্য ১০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রতি মাসে পাঁচটি গাড়ি ভাড়া বাবদ ৬০ মাসে ধরা হয়েছে পৌনে ৯ কোটি টাকা। মাসে খরচ হবে ১৪ লাখ ৬১ হাজার টাকা। প্রতি গাড়ির জন্য ব্যয় দুই লাখ ৯২ হাজার টাকা। যেখানে কোটি টাকা দামের পাঁচটি গাড়ি কিনেও চার কোটি টাকা থাকে। এ দিকে সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষায় বলা হয়, উড়াল সড়ক দিয়ে ২০৩০ সালে প্রতিদিন ২৫ হাজার ৮০০টি যানবাহন চলাচল করবে। সংখ্যাটি ২০৪৫ সালে প্রায় ৪৫ হাজারে দাঁড়াবে। দেশের অন্যতম ব্যস্ত মহাসড়ক ঢাকা-উত্তরবঙ্গ পথের বঙ্গবন্ধু সেতুতে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ২১ হাজার যানবাহন চলাচল করে। এই সেতুর মাধ্যমে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সাথে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং খুলনা বিভাগের একাংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে এখন দিনে গড়ে যানবাহন পারাপার হচ্ছে ১১ হাজারের মতো। এই সেতু সারা দেশের সাথে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলাকে যুক্ত করেছে। এই প্রকল্পের ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এসবের ব্যাপারে প্রকৌশলীদের জিজ্ঞাসা করা দরকার। তবে এগুলোর ব্যাপারে আমাদের দেশে যেগুলো হয়, ওইগুলোর ব্যয় প্রতি কিলোমিটারে ১০০ থেকে ১২০ কোটি টাকা বলছ, কিছু দিন পর প্রকল্প সংশোধন হবে। তার পর দেখা যাবে ওইগুলোর খরচও প্রতি কিলোমিটারে ১৭০-১৮০ কোটি টাকা বা এমনকি দ্বিগুণ বা তিনগুণ খরচ বাড়তে পারে। আমাদের যারা এই প্রকল্প প্রস্তাব করে তারা শুরুতেই ব্যয় কম দেখায় প্রকল্প পাস করানোর জন্য। পরে আবার ব্যয় বাড়ায়। কারণ ১০০ কোটি টাকা যদি খরচ করে, তার পর যদি ব্যয় বৃদ্ধি অনুমোদন না পায় তা হলে ওই শতকোটি টাকাও গচ্ছা গেল। ফলে ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। সঙ্কটের সময় এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা কী জানতে চাইলে এই সিনিয়র অর্থনীতিবিদ বলেন, আমি মনে করি এটির কোনো প্রয়োজন এখন নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলছেন ব্যয়সঙ্কোচন করতে। উচ্চ অগ্রাধিকার ছাড়া নতুন প্রকল্প নেয়া যাবে না। তার পরও কিভাবে এগুলো যায়, আমার কাছে তা বোধগম্য না।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close