সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ডের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক উৎসব
আড্ডা-আনন্দের অগণন ফল্গুধারা
|| কাইয়ূম আবদুল্লাহ ||
বিলেতে সামার এমনিতেই অনন্য উপভোগ্য সময়। সেই সাথে থাকে যদি ছন্দের ঝংকার ও সুরময়তার আয়োজন তখন কি তা সোনায় সোহাগা না হয়ে পারে? হ্যাঁ, বিলেতের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক বোদ্ধাদের নিয়ে সেরকমই অপার আনন্দ-আড্ডার অগণন ফল্গুধারায় হৃদয় সিক্ত হওয়া এক আয়োজনের সফল মঞ্চায়ন করতে সক্ষম হয়েছে সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ড। লণ্ডনের বাইরে বাংলাদেশী অধ্যুষিত বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, ওল্ডহাম বা ব্রাডফোর্ড সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন আসর-অনুষ্ঠানে সরব থাকলেও প্রায় ৮/১০ হাজার বংলাদেশী অধ্যুষিত শেফিল্ডে বৃহৎ পরিসরের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিবেশনা খুব একটা মনে পড়ে না। পথচলার প্রথম অথচ স্মরণযোগ্য একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উপস্থিত সবার সাধুবাদ অর্জনে সক্ষম হয়েছে সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ড। গত ৭ আগস্ট, রোববার স্থানীয় জে ডি লাউঞ্জে দিনব্যাপী এমনই এক আয়োজনে লণ্ডন, ম্যানচেস্টার, লীডস, ব্রাডফোর্ড, হাইড ও সাউথশিল্ডসহ বিভিন্ন শহর থেকে গ্রীন, সেইফার ও ইঞ্জিনিয়ারিং শহরখ্যাত ইংল্যাণ্ডের ৪র্থ বৃহৎ সিটি শেফিল্ডে উপস্থিত হয়েছিলেন বিলেতের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সঙ্গীতশিল্পী, আবৃত্তিকার ও সাহিত্য-সংস্কৃতিবোদ্ধাজন। বক্তাগণ তাদের বক্তব্যে সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ডের প্রথম এই আয়োজন সর্বোৎভাবে সফল হয়েছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। একই সাথে তারা বিলেতে বাংলা সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা এধরণের অনুষ্ঠান অব্যাহত রাখার আহবান জানিয়ে বলেন, এধারা অব্যাহত থাকলে একদিন তা মহীরুহ হবে। সবার মুখের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারাও আগামীতে এধরনের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিবেশনার নান্দনিক আয়োজন অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ড প্রাথমিকভাবে ১৭ সদস্য নিয়ে গত বছর থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যে নিজেদের মতো করে বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন করলেও সবাইকে নিয়ে বড় পরিসরে এটাই ছিলো তাদের প্রথম কোনো অনুষ্ঠান।
আড্ডা-আনুষ্ঠানিকতায় মিশেল এক অনন্য আনন্দময়তা
আনুষ্ঠানিকতার সাথে উন্মুক্ত আড্ডার মিশেল ছিলো সেদিনের পরিবেশনায়। ব্যানার টানিয়ে সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ডের সভাপতি কবি-সাংবাদিক আহমদ হোসেন হেলালের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক মিসবাউর রহমান চৌধুরী লিটনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হলেও নির্দিষ্ট কোনো আসন বা মঞ্চ ছিলো না। ছিলো না প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথির শ্রেণী বিন্যাস বা আদিখ্যেতা। তাই একে একরকম আড্ডাই বলা যায়। যখন যাকে ইচ্ছা ডেকে নিয়ে মাইক্রফোন হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে এবং ইচ্ছেমতো তারা তাদের কবিতা পাঠ, আবৃত্তি বা গান পরিবেশন করেছেন। গান, কবিতা ও বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে চলেছে সম্প্রতি প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনও। অনুষ্ঠানটির পুরো তত্ত্বাবধানে ছিলেন সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ডের অন্যতম সদস্য নুরুল হক।
জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে সূচিত অনুষ্ঠানের শুরুতে আয়োজকদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ডের সভাপতি আহমদ হোসেন হেলাল ও অন্যতম কর্ণধার কবি আবু মকসুদ। অতঃপর একে একে অনুভূতি প্রকাশসহ স্বরচিত কবিতা ও লেখা পাঠে অংশ নেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব নুরুজ্জামান মনি, সম্মিলিত সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিষদ ইউকের সভাপতি ময়নুর রহমান বাবুল, কবি আহমদ ময়েজ, কবি মাশূক ইবনে আনিস, কবি তাবেদার রসুল বকুল, কবি এম আব্দুল্লাহ, কবি মুহাম্মদ ইকবাল, কবি ও আবৃত্তিকার সৈয়দ রুম্মান, কবি সৈয়দ হিলাল সাইফ, কবি উদয় শঙ্কর দুর্জয়, কবি মুহাম্মদ মুঈদ, কবি মতিউর রহমান চৌধুরী, কবি সৈয়দ শাহনূর আহমদ, কবি মোস্তাক আহমদ প্রমুখ। নাট্যকার সেতু চৌধুরী সিলেটী ছড়া আবৃত্তি করার পাশাপাশি নির্বাচিত নাটকের কিছু সংলাপ শোনান।
বেশকটি কবিতা আবৃত্তি করে প্রশংসিত হন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার ও উপস্থাপিকা মুনিরা পারভীন। আর গানের সম্মোহনীতে আসর মাত করেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী ও উপস্থাপিকা সোমা দাস। শেফিল্ডের স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যে সঙ্গীত পরিবেশন করে সবার নজর কাড়েন এবং অনুষ্ঠানকে উপভোগ্য করে তোলেন টিনা পাল, লীনা পাল, শাহজাহান ঘুরি, মুকিত মিয়া, লিমন, খালেদ, সুজন মিয়া, আমিনুর রহমান ও তৌফিক আহমদ।
বক্তৃতা করেন বিলেতের বিশিষ্ট গবেষক ফারুক আহমদ, সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজান, ব্রাডফোর্ড সিটি কাউন্সিলের কাউন্সিলার সাংবাদিক হাসান খান। একমাত্র কৌতুকটি পরিবেশন করে সবাইকে আনন্দ দেন সাংবাদিক কলন্দর তালুকদার। এছাড়া মোড়ক উন্মোচিত হওয়া গ্রন্থগুলো হচ্ছে— বিশিষ্ট লেখক তাবেদার রসুল বকুলের “সৈয়দ শামসুল হুদা: জীবন ও সময়কাল”। এই গ্রন্থটি সমাপ্ত করতে তাঁর ১৮ বছর সময় লেগেছিলো বলে জানান। অপর গ্রন্থটি হলো গল্পকার ময়নুর রহমান বাবুলের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ “দীপ্ত পদাতিক” যেটি যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন জাতীয় সাহিত্য প্রকাশন‘র কর্ণধার মফিদুল হক ও গবেষক ফারুক আহমদ। এছাড়া কবি নূরজাহান শিল্পী সম্পাদিত বেশক‘জন গল্পকারের গল্পের সমাহারগ্রন্থ “যে জীবন মানুষের” এবং কবি দুর্জয় সম্পাদিত ইংরেজী লিটল-ম্যাগ “পল” এর মোড়ক উন্মেচিত হয় অনুষ্ঠানে।
গান, কবিতা আবৃত্তি, স্বরচিত কবিতা পাঠসহ পুরো অনুষ্ঠানে চমৎকার সাউণ্ডসিস্টেম উপহার দেয় সুর সঙ্গীতালয়। আর বিভিন্ন যন্ত্রসঙ্গতে ছিলেন এই সঙ্গীতালয়ের সদস্য যথাক্রমে নুরুজ্জামান আহমদ, লুৎফুর রহমান, রাহাত খন্দকার, আমিনুর রহমান, চুনু মিয়া ও মনা মিয়া। তম্মধ্যে নুরুজ্জামান ও আমিনুর রহমান চমৎকার গানও পরিবেশন করেন।
বিরতিহীন অনুষ্ঠানের মধ্যখানে দুপুরের খাবার এবং রাত হওয়ার আগে নৈশভোজ পরিবেশনে উপস্থিত সবাই আপ্যায়িত করা হয়। সবশেষে হলের বাইরে গ্রুপ ছবি ও অনেকগুলো সেলফির মাধ্যমে দিনব্যাপী এই আসরের সমাপ্তি ঘটে।
হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মরণ
অনুষ্ঠানের শুরুতে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। তারা ছিলেন বিলেতের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের স্বজন ব্যক্তিত্ব। বিলেতের যে কোনো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তারা স্মরিত হবেন— এমনটাই দাবী রাখে। এই বিশিষ্টজনের একজন হচ্ছেন সদ্য প্রয়াত অমর একুশের গানের রচয়িতা, প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব আবদুল গাফফার চৌধুরী। বিলেতের যে কোনো সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক আয়োজনে যে প্রাজ্ঞ পুরুষের উপস্থিতি অনুষ্ঠানের গুরুত্ব ও মাধুর্য বাড়িয়ে তুলতো। মধ্য বয়স থেকে শেষ জীবদ্দশা পর্যন্ত তিনি বিলেতে অবস্থান করলেও তাঁর প্রভাব-পরিচিতি উভয় বাংলা ছাড়িয়ে গিয়ে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষিদের মাঝে তিনি ছিলেন অনন্য উচ্চতায় আসীন।
অপরজন প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক ইসহাক কাজল। জীবদ্দশায় বাংলা একাডেমি প্রবাসী পদকে ভূষিত সাংবাদিক ইসহাক কাজলও বিলেতের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অপরিহার্য এক পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে ছিলেন সদা সক্রিয়। বিলেতের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক সমাজে বহুদিন তাঁর অভাব অনুভূত হবে এবং তিনি স্মরণ হবেন প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠান-আয়োজনে।
কবি ও গীতিকার কুতুব আফতাব। করোনাকালে সুস্থ হয়েও হঠাৎ এক রাতে চিরনিদ্রায় চলে গেলেন। তাঁর এমন চলে যাওয়া বিলেতের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে খুব করে শোকাচ্ছন্ন করে তুলে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। অনেকটা নিভৃতচারী এই গীতিকবিও বিলেতের ভাবের ভারবাহীদের মাঝে অনেকেদিন বেঁচে থাকবেন।
হঠাৎ করেই চলে গেলেন বিলেতের আরেক সক্রিয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব রুবী হক। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের বাইরে তিনি সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও সক্রিয় ছিলেন। স্বামী বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কবি এডভোকেট মুজিবুল হক মনির সাথে তিনি ছুটে বেড়াতেন প্রায় সবগুলো আড্ডা-আসরে। আগামীর অনেক অনুষ্ঠানে মুজিবুল হক মনির পাশে রুবী হকের অনুপস্থিতির অভাব অনুভূত হবে সবার মাঝে সমানভাবে।
স্বভাব কবি নজরুল ইসলাম। তিনিও চলে গেলেন করোনাকালের কোনো একদিন, অনেকটা অজান্তেই। বিলেতের যে কোনো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর উপস্থিতি এবং স্বভাবসূলভ স্বরচিত কবিতা এবং না দেখেই অনর্গল পাঠের জন্য তিনি ছিলেন সবার পরিচিত। তিনিও অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর ঘনিষ্ঠ কবিবন্ধুদের মাঝে।
নুরুজ্জামান মনির “হাইড” থেকে বেরুনোর গল্প
অনুষ্ঠানে প্রথাগত কোনো প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথির আসন ছিলো না। এমনকি ব্যানার থাকলেও বসার জন্য চিরাচরিত কোনো মঞ্চও ছিলো না। তবু উপস্থিত প্রায় সবার হৃদয়ে মধ্যমনি বা প্রধান অতিথির আসন গেড়ে যিনি বসেছিলেন তিনি বিশিষ্ট সাহিত্যিক নুরুজ্জামান মনি। তাঁর মূল্যবান কথা ও লেখা পাঠ মনোযোগ দিয়ে শোনার পাশাপাশি অনুষ্ঠানের আগে ও পরে তাঁর সাথে সেলফিও তুলেছেন অনেকে। বহুদিন থেকে দেশ ছাড়া হলেও সিলেটের বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের সাথে এখনও তাঁর নাম সমোজ্জ্বল ও সমানভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। সমসাময়িক বিষয়ে লেখালেখি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন তিনি খুব বেশী সক্রিয়। প্রায় প্রতিদিনই নিরলসভাবে ছড়া কিংবা স্মৃতিচারণমূলক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে চলেছেন। সেই নুরুজ্জামান মনি বক্তব্যের শুরুতে তাঁর বর্তমান ঠিকানা হাইড এলাকার উল্লেখ করে বলেন, বিলেতে আসার পর আমিতো হাইডে একধরনের হাইড হয়ে আছি, একধরনের আত্মগোপনে আছি বলা যায়। সেখান থেকে আমার অনুজপ্রতিম কবি আহমদ ময়েজই আমাকে খুঁজে খুঁজে বের করে। সে যখন সুরমার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলো তখন সেখানে সে-ই আমার লেখা প্রকাশ করতে শুরু করে। সুরমায় অন্যান্য লেখার পাশাপাথি সে একসাথে আমার কতগুলো সনেট প্রকাশ করেছিলো। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সে আমার কাছ থেকে লেখা আদায় করে নিতো। সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি সে করেছিলো তা হচ্ছে— আমার মধ্যে একটা ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বা ছিলো, যেটাকে আমি অত্যন্ত অনাদরে রেখে দিয়েছিলাম, লালন করা বাদই দিয়েছিলাম, সেই ঘুমিয়ে থাকা সত্ত্বাটিকে সে জাগিয়ে তুলেছে। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, একদা সে আমার অনেক পুরনো দুটো ছড়ার লাইন আবৃত্তি করার মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলো— মনি ভাই আপনি কেন এখন ছড়া লিখছেন না? আপনার সেই আশির দশকের ছড়া আমারতো এখনো মনে আছে। একই সাথে তিনি আহমদ ময়েজের বড় ভাই, বিশিষ্ট কবি ও কলামিস্ট, সুরমার প্রধান সম্পাদক ফরীদ আহমদ রেজার কথাও স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ময়েজের বড় ভাই ফরীদ আহমদ রেজাও একদা আমাকে বলেছিলেন, মনি ভাই! আপনি ইংল্যাণ্ডের হাইডে এসে হাইড হয়ে গেছেন। তিনিও তা স্বীকার করে বলেন, আসলেই আমি হাইডে এসে হাইড হয়ে গিয়েছি। দেহ এখানে থাকলেও মন-মনন সবকিছু বাংলাদেশেই পড়ে আছে। তবে বাংলাদেশের সবকিছু প্রত্যক্ষ করছি এবং এসব নিয়ে আমি এখন লিখে যাচ্ছি এবং আপনাদের দোয়ায় আমি লিখেই যাবো।
মুনিরা পারভীনের প্রশংসিত পরিবেশনা
বিলেতের বিশিষ্ট ও সুপরিচিত আবৃত্তিশিল্পী মুনিরা পারভীনের আবৃত্তি বরাবরই প্রশংসা কুড়ায়। শেফিল্ডের সেদিনের অনুষ্ঠানেও ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় তাঁর কবিতা আবৃত্তি। অনুষ্ঠানটির জন্য বাছাই করা বিশেষ কিছু কবিতার আবৃত্তি উপস্থাপন করেছিলেন তিনি। তম্মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সিলেট অবস্থানকালীন সিলেটকে নিয়ে তাঁর কবিতা “শ্রীভূমি” আবৃত্তি করেন। নজরুলের “বিদ্রোহী” না “সাম্যবাদী” কোনটি শোনতে চান— জানতে চাইলে সবাই দাবী করেন উভয়টি। সবার অনুরোধে তিনি সংক্ষিপ্তাকারে দুটো কবিতাই আবৃত্তি করেন। অতঃপর আবৃত্তি করেন কবি দিলওয়ারের লণ্ডন ভ্রমণকালে লণ্ডন নিয়ে লিখা কবিতা “এই প্রবাসে তোমরা যারা” এবং কবি প্রত্যুষ কুমার দাশের “সীমান্তের চিঠি”।
উপস্থিত অনেকেই মুনিরা পারভীনের আবৃত্তির প্রশংসা করেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব নুরুজ্জামান মনি তাঁর বক্তব্যে মুনিরা পারভীন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেন, আজ আমাদের স্নেহভাজন মুনিরার আবৃত্তি শোনে মনে হলো আমি যেন বাংলাদেশে সেই তরুণী মুনিরার আবৃত্তি শুনছি। মুনিরা পারভীনকে দেখলেই আমার সেই বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে, সেই শিশু একাডেমির কথা মনে পড়ে, সেই এক ঝাঁক তরুণীর মধ্যে থাকা মুনিরার কথা মনে পড়ে। আজকে তাকে এখানে দেখে আমার অত্যন্ত ভালো লাগছে।
সোমা দাসের আসর মাত করা পরিবেশনা
সঙ্গীতাসরে ব্যতিক্রমী সুর সুধায় আসর মাত করেন বিশিষ্ট সঙ্গীশিল্পী ও উপস্থাপিকা সোমা দাস। ক্লাসিক ঘরনার এই শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানের ইংরেজী ভার্সন “ড্রিং টু মি ওনলি থিন আইজ … কতোবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া” দিয়ে শুরু করেন। অতঃপর তিনি একে একে গেয়ে শোনান— সদ্য পরলোকগত নির্মলা মিশ্রের স্মরণে, শিবদাস ব্যানার্জির লেখা এবং ভূপেন হাজারিকার সুরারোপিত “জীবন খুঁজে পাবি …”, “সবুজ পাহাড় ডাকে আয়রে ছুটে আয় …” এবং প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের “আমি বাংলার গান গাই/ আমি বাংলায় গাই …”। তাঁর শেষ গানটি মূহুর্তেই সবাইকে নষ্টালজিক করে তোলে। ক্ষণিকের জন্য পরিভ্রমণে নিয়ে যায় সবুজ, শ্যামল বাংলায়। যেখানে প্রতিটি বাঙালি নিজেকে খুঁজে ফেরে।
মন মজালেন কবি সৈয়দ হিলাল সাইফ
সবার উপস্থাপনাই ছিলো প্রশংসনীয়। তবে বিলেতের এসময়ের অন্যতম সুপরিচিত তরুণ কবি সৈয়দ হিলাল সাইফ ভিন্নভাবে সবার মন মজাতে সক্ষম হয়েছেন। প্রকৃত অর্থে ব্যতিক্রম যা বোঝায় এই কবির ছড়াগুলো তাই। তাঁর বেশীরভাগ ছড়া দুই বা চার লাইনের। কিন্তু এই দু/চার লাইনেই থাকে একধরণের পোড়ন ও গভীর জিজ্ঞাসা। কবি আহমদ ময়েজ এসবের নাম দিয়েছিলেন ছড়াশ্লোক। চমৎকার ছন্দময় এসব ছড়াশ্লোক যে কোনো শ্রোতাকে নিমিষেই অবাক ও ভাবিত করে তোলার জন্য অব্যর্থ শৈল্পিক হাতিয়ার। তাঁর এধরনের অনেকগুলো ছড়াশ্লোক বিলেতের অনেক লেখকবন্ধুর মুখে মুখে ফেরে। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি একে একে পড়ে শোনান— “বলতে পারেন কোন সে কাজে/ আমার-আপনার হয়না খরচা/ … পরচর্চা, পরচর্চা!”, “বলতে পারেন কী সব খেলে/ সব‘চে বেশী আরাম মেলে?/ … হারাম খেলে, হারাম খেলে!”, “বলতে পারেন ভুলটি জেনেও/ কোন কথাটা আমরা কহি?/… আমিই সহি, আমিহ সহি!”, “বলতে পারেন বেল তলাতে/ কারা গেলেও পড়েবেনা বেল?/… তারা আতেল, তারা আতেল!”, “শুরু থেকেই আজ অবধি/ চলতেই আছে … কোন সে যন্ত্র?/… ষড়যন্ত্র … ষড়যন্ত্র!”, “বলতে পারেন কোন কাজটা/ করা যায় না দেখা দেখি/ … লেখালেখি, লেখালেখি!”। এধরনের অনেকগুলো ছড়াশ্লোক বলে তিনি আসর মাতিয়ে তোলেন।
সবশেষে অনেকের অনুরোধে পুরনো একটি ছড়াশ্লোক— “আপনারা খান মায়াবড়ি আপনারা খান ওভাকন/ আমরা যে তার কিছুই খাই না/ আপনারা কি অবাক হন” উচ্চারণ করে তুমুল হাততালি আর হর্ষধ্বনির মধ্যে মঞ্চ ছাড়েন তিনি।
দুই কবিবন্ধু আহমদ ময়েজ ও মাশূক ইবনে আনিসের পারস্পরিক টান
কবি আহমদ ময়েজ এবং কবি মাশূক ইবনে আনিস। দুজনই শক্তিমান কবি ও তীক্ষ্ণ সমালোচক এবং দুজনই মরমী ঘরানার। অনুষ্ঠানে এই দুই কবিবন্ধুর পারস্পরিক টান অনেকের নজর এড়ায়নি। তাদের একজন মঞ্চে গেলে আরেকজনকে খুঁজেন, এমনটিই লক্ষ্য করা গেছেন। কবি আহমদ ময়েজ যখন একটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচনে মঞ্চে গেলেন তখন তিনি ডাকলেন কবি মাশূক ইবনে আনিসকে। আবার কবি মাশূক ইবনে আনিস যখন মঞ্চে গেলেন তখন তিনিও কবি আহমদ ময়েজের প্রশংসা করলেন। এমনকি ছবি তুলতেও একে অন্যকে বার বার ডেকেছেন। একেই হয়তো বলে— “রতনে রতন চেনে”। মাশূক ইবনে আনিস একই সাথে লেখক-গবেষক ফারুক আহমদসহ অনেকের নামাল্লেখ করে প্রশংসা করেন এবং বিলেতের নামীদামী প্রকাশনা সংস্থা থেকে বিলেতের বিশিষ্ট গবেষক ফারুক আহমদের কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশের বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেন।
একজন কবি আবু মকসুদ এবং …
কবি আবু মকসুদ একজন আড্ডার মানুষ। তৃতীয় বাংলা খ্যাত ব্যস্ত শহর লণ্ডন ছেড়ে গেলেও লেখালেখি কিংবা আড্ডা থেকে মুখ ফেরাননি তিনি। তাই শেফিল্ডে যাওয়ার পরও তিনি তাঁর প্রয়োজনীয় আড্ডার মানুষজনকে খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মনের তাগিদ থেকেই হয়তো দাঁড়িয়েছে সাহিত্য একাডেমি শেফিল্ড। সভাপতি বা সেক্রেটারির দায়িত্ব না নিয়েও তিনি যে সাহিত্য একাডেমি শেফিল্ড গঠনের অন্যতম কারিগর তা সহজেই অনুমেয়। এই আবু মকসুদ লণ্ডনে থাকতে প্রায় সবগুলো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা আড্ডা-আসরের অন্যতম সক্রিয় ঘটকের কাজ করতেন। বলা যায়, শেফিল্ডেও তিনি সফল হয়েছেন। তাই অনেকটা তাঁরই আমন্ত্রণ ও বারংবারের তাড়া থেকে লণ্ডনসহ বিভিন্ন শহর থেকে সবাই ছুটে গিয়েছিলেন। সবাইকে পেয়ে তিনিও যে দারুণ খুশী এবং সাফল্যে সন্তুষ্ট তা তাঁর ফেইসবুক স্ট্যাটাস থেকে বোঝা যায়। “বিকেন্দ্রীকরণ” শিরোনামে তিনি লিখেছেন— “লণ্ডন কেন্দ্রীক প্রায় সব কবি সাহিত্যিককে একদিনের জন্য শেফিল্ডে নিয়ে এলাম। লণ্ডনকে একদিনের জন্য শেফিল্ডে প্রতিস্থাপন করলাম।
দেখা গেল শুধু আমরাই মুখিয়ে থাকি না; রাজধানীবাসীও হাত-পা ছুঁড়বার অপেক্ষায় থাকেন। একটু সবুজে কে না লালায়িত হয়, একটু বিশুদ্ধ বাতাস বুকে নিতে পারলে কার না ভালো লাগে।
শেফিল্ডের বাতাসে রাজধানীর চেয়ে কিছু বেশি পরিমাণ অক্সিজেন, শেফিল্ড এর চারপাশ বনরাজি বৃক্ষ এবং পাহাড় দিয়ে ঘেরা। রাজধানী থেকে যারা এলেন তাদের ভালো লাগলো, তাদের দেখতে পেয়ে আমাদেরও।”
সত্যি, আবু মকসুদ এমনটি করতে সফল হয়েছেন। সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ড‘র সভাপতি সাংবাদিক আহমদ হোসেন হেলালও একজন সজ্জন ব্যক্তি। বলা যায় এই দুইজনের যৌথ ভাবনার সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে এই অনুষ্ঠান। যারা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তারা সার্বিক আয়োজন ও পরিবেশনায় মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন। জয়তু কবিবন্ধু আবু মকসুদ! কবি-সাংবাদিক আহমদ হোসেন হেলাল! সাহিত্য একাডেমি, শেফিল্ডের সংশ্লিষ্ট সবাইকে সাধুবাদ।
আমাদের আসা-যাওয়ার গল্প
অনুষ্ঠানের জন্য নিমন্ত্রণ অনেক আগেই দিয়ে রেখেছিলেন কবিবন্ধু আবু মকসুদ। এরই মধ্যে কয়েকবার ফোনেও আলাপ হলো। আমার আবার ওইদিন ছিলো বিয়ের ২০তম বার্ষিকী। যে করেই হোক বন্ধুর মন রক্ষার্থে বউকে বোঝালাম। তারপরও ওইদিন সকালে কবি আবু মকসুদের আবার ওয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ। আর তাতে লিখেছেন— “শেফিল্ডে উড়ছে বর্ণিল পায়রা, বাক বাকুমে মুখরিত আকাশ, বাতাস। আনন্দের ফল্গুধারায় হৃদয় সিক্ত হবে। আমরা মিলিত হবো প্রাণের বন্ধনে, আমাদের স্পন্দনে থাকবে উচ্ছ্বসিত আনন্দ বার্তা।”
কবি আবু মকসুদের অমন আহবান আর অগ্রাহ্য করা যায় কী করে? তাই পূর্ব প্রস্তুতি মতো পূর্ব লণ্ডনের মাইল এণ্ডের কাছে জড়ো হয়ে বহুদিনের সেই মিলনাকাঙ্ক্ষা আর আড্ডা-আনন্দের ফলগুধারায় স্নাত হতে শেফিল্ডের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম আমরা। আমরা বলতে— কবি আহমদ ময়েজ, সঙ্গীতশিল্পী সোমা দাস ও কবি সৈয়দ হিলাল সাইফ।
গাড়িতেই শুরু হয়ে গেলো সেই আনন্দের আবহ। গাড়ি ড্রাইভ করা অবস্থাই রসাত্মক ছড়াশ্লোকে মাতিয়ে চললেন কবি-ছড়াকার সৈয়দ হিলাল সাইফ। সাথে নেয়া দাফ (এক ধরনের মিউজিক্যাল ইনস্ট্রোমেন্ট)-এ মৃদু সুর তুলে মরমী সঙ্গীতে মজিয়ে যাচ্ছেন কবি আহমদ ময়েজ। আর সঙ্গীতশিল্পী সোমা দাস ক্লাসিক সুরে মূল আড্ডা মাতানোর মানসে নিজেকে নিরব রাখলেও কথাবার্তায় সরব সায় দিয়ে যাচ্ছিলেন।
ফেইসবুকে হঠাৎ কবি সৈয়দ রুম্মানের “অফ টু শেফিল্ড” লেখার সাথে ছবি দেখে আমিও কয়েকটি সেলফি ও ছবি তুলে পোস্ট করে শেফিল্ড যাত্রার জানান দিলাম। পথিমধ্যে কয়েকবার আমরা কোথায় আছি এবং পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে জানতে চেয়ে ফোন করলেন কবি আবু মকসুদ। আমাদের আগেই পৌঁছে যাওয়ায় গবেষক ফারুক আহমদ ফোন করে জানতে চাইলেন আমরা আর কতো দূরে? অনুষ্ঠানে অন্য একটি গাড়ীতে করে যাচ্ছিলেন লেখক-গবেষক ফারুক আহমদ, কবি মাশূক ইবনে আনিস, কবি ও আবৃত্তিকার সৈয়দ রুম্মান, সম্মিলিত সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিষদ ইউকে‘র সভাপতি গল্পকার ময়নুর রহমান বাবুল, সেক্রেটারি কবি এম আব্দুল্লাহ, কবি মুহাম্মদ ইকবাল ও কবি মুহাম্মদ মুঈদ। আর একাই ট্রেনে, বাসে করে লণ্ডন থেকে অনুষ্ঠানে গিয়ে যোগ দেন বাংলাভাষী অনলাইন পোর্টালের সম্পাদক অলিউর রহমান খান।
অনুষ্ঠানে লাঞ্চ, ডিনার এবং বার বার চা পরিবেশন করেও সাধ মিটলো না কবিবন্ধু আবু মকসুদের। অনুষ্ঠান শেষে তিনি আবার আমাদের সবাইকে তাঁর ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে আবার আড্ডা, বিভিন্ন ফ্রুটের পানীয় এবং নানা পদের মুখরোচক ডিজার্টে আপ্যায়িত করে তবেই বিদায় দিলেন।
ফেরার পথেও কবি আহমদ ময়েজের বিরতিহীন কথার ফুলঝুরি আর বাউলিয়ানা এবং সঙ্গীতশিল্পী সোমা দাসের সুরেলা কন্ঠে সুমনের বিখ্যাত গান শুনতে, শুনতে মধ্যরাত পেরিয়ে গেলেও আমরা ক্লান্তহীন এক অভিযাত্রা শেষে পৌঁছে যাই নিজ নিজ গৃহে।