ফিচার

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৪২তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

।। হাসনাত আরিয়ান খান ।।

মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের ৪২তম শাহাদাৎ বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের জন্য সুরমা সম্পাদক শামসুল আলম লিটন ভাই গত সপ্তাহে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এবং এ উপলক্ষে দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম এর আদর্শ বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, তাঁর উন্নয়নের রাজনীতির ১৯ দফা কর্মসূচি এবং দেশ পরিচালনায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অনন্য অবদানের কথা এ দেশের নতুন প্রজন্ম তথা সাধারণ জনগণের মাঝে প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে লেখা আহ্বান করেছিলেন। কবি আহমেদ ময়েজ ভাই তাঁর সৃষ্টিশীলতা দিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্রের একটা লে আউট দাঁড় করিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্য জাসাসের সদ্য সাবেক সভাপতি এমাদুর রহমান এমাদ ভাই আমাকে ক্রোড়পত্রে লিখতে বলেছিলেন। সাপ্তাহিক সুরমা’র ক্রীড়া সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফ ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম তিনি আমার লেখা পছন্দ করেন। এমাদ ভাই না বললেও ক্রোড়পত্রে আমি অবশ্যই লিখতাম। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের ৪২তম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষে আমি একটা লেখা রেডি করেও রেখেছিলাম। জিয়াউর রহমানের কাছে আমাদের অনেক অনেক ঋণ। বিশেষ করে আমাদের সংবাদপত্র ও সাংবাদিক সমাজের অনেক ঋণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র তিন বছর পার হতে না হতেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন সরকার সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী এনে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল কায়েম করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ১৬ জুন বিতর্কিত বাকশাল সরকার চারটি সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ছাড়া বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হয়ে জিয়াউর রহমান সংবিধানে দেশের মানুষের পরম আকাঙ্খিত বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করে বাকশাল সরকারের সব প্রকার অগণতান্ত্রিক কালো ধারা বাতিল করেছিলেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ছিলেন আমাদের জাতীয় বীর, চির উন্নত শির। তিনি কমান্ডার ছিলেন, দেশপ্রেমিক ছিলেন, বিপ্লবী ছিলেন, স্বাধীনচেতা ছিলেন। তিনিই প্রথম বিদ্রোহ করেছিলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন, সাহস দিয়েছিলেন। তার চেয়ে বড় কথা তিনি ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ও সফল বাংলাদেশের সূচনা করেছিলেন। প্রত্যয় দীপ্ত কন্ঠে বলেছিলেন, বিদেশে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র আছে কিন্তু কোন প্রভু নেই। ভারতীয় আধিপত্যবাদকে ঠেকাতে তিনি সার্ক গঠন করেছিলেন। স্বেচ্ছাশ্রমে তিনি ১৪০০ খাল খনন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এই খাল কাটা শুধুমাত্র উৎপাদনেই সহায়ক ছিল না, এর ছিল সামরিক একটি দিক। সামরিক পরিবহন ও যোগাযোগের জন্য যে এই প্রকল্পটি কাজ করছিল সেটি ভারতকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তিনি সেনানিবাসের সংখ্যা বাড়ানোর সাথে সাথে সেনা সক্ষমতা, সংখ্যা ও সমরাস্ত্র বাড়িয়েছিলেন। অক্সিলিয়ারী ফোর্স হিসেবে তৈরী আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী তৈরী করেছিলেন। তার সাথে আর্মড পুলিশ ও ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর করেছিলেন। সে সময় বিপুল সংখ্যক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী সেনা তত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তিনি সমরাস্ত্র কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। দেশে বন্ধু দুটি রাষ্ট্রের সহায়তায় পৃথিবীর সর্বাধুনিক ট্যাংক ও যুদ্ধ বিমান তৈরির প্রকল্পও হাতে নিয়েছিলেন। ভারত যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে তালপট্রি দখল করতে এলে তিনিও পাল্টা যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছিলেন। ভারতীয় সরকার ও তাদের ‘র’ যখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নামে বেনামে নানা বাহিনী দিয়ে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র শুরু করেছিলেন, তখন বাধ্য হয়ে জাতীয় স্বার্থে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ভারতের অভ্যন্তরে পাল্টা গোয়েন্দা তৎপরতা শুরু করেছিলেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসন ছিল, সমৃদ্ধি, সম্মান আর উন্নয়নের। এই সাড়ে তিন বছরেই তৎকালীন ৮ কোটি মানুষের বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছিলো। শুধু তাই না, ১৯৮০ সালের শেষ দিকে বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে বাংলাদেশ প্রথম আফ্রিকার গিনিতে ১ লক্ষ্য ১১ হাজার মেট্রিক টন চাল রফতানির করেছিলো। অথচ কিছুদিন আগে যে দেশকে বিশ্ব দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, দুঃশাসন, চরম দ্রারিদ্রতা, সর্বোপরি তলাবিহীন ঝুড়ি নামে চিনতো। জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক ও একজন মহান নেতা। তাঁর সফল নেতৃত্ব, দেশ প্রেম, অক্লান্ত পরিশ্রমের জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় ৮ কোটি মানুষকে তিনি করে তুলেছিলেন, কর্মমুখী, দেশপ্রেমিক, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ একটি গর্বিত জাতিতে। জিয়াউর রহমান একটি ইতিহাস ও ইতিহাসের উজ্জল অধ্যায়। জিয়াউর রহমান একটি প্রতিষ্ঠান। জিয়াউর রহমান একটি বৈপ্লবিক চেতনা। জিয়াউর রহমান একটি রাজনৈতিক দর্শন। জাতির প্রতিটি সংকটে, প্রয়োজনের মুহুর্তে জাতিকে তিনি বলিষ্ঠ হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আমি যুগে আসি, আসিয়াছি পুণ: মহা বিপ্লব হেতু, আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে তিনি বিদ্রোহী কবির ধুমকেতুর মতোই তিনি ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান এই দেশের মানুষকে এতভাবে ঋণী করে গিয়েছেন, যে ঋণ কোনদিন শোধ হবার নয়।

যাই হোক, আমরা যারা উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বিলেতে এসেছিলাম, আমাদেরকে যারা মেধাবী ছাত্র হিসেবে মানেন, তাঁরা সকলেই জানেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষভাবে মূল্যায়ন করতেন। তাঁর আমলে নিয়মিতভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান অর্জনকারীদের বঙ্গভবনে নিমন্ত্রণ করা হত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে মেধাবীদেরকে সম্বর্ধনা দিতেন এবং ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দেশপ্রেম ও মূল্যবোধকে জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন। শুধু তাই না, হিজবুল বাহার নামক জাহাজে করে তিনি মেধাবীদের সমুদ্র ভ্রমণে নিয়ে যেতেন। হিজবুল বাহারে তিনি মেধাবীদের সঙ্গে দেশ নিয়ে নিজের ভাবনাগুলো শেয়ার করতেন। অত্যন্ত প্রত্যয় দীপ্ত কন্ঠে তিনি বলতেন, ‘‘শোনো ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের বাংলাদেশের ডাঙা থেকে তুলে উত্তাল বে অব বেঙ্গলের মধ্যখানে নিয়ে এসেছি। সমুদ্র হল অন্তহীন পানির বিস্তার ও উদ্দাম বাতাসের লীলাক্ষেত্র। এখানে এলে মানুষের হৃদয় একই সাথে উদার ও উদ্দাম-সাহসী হয়ে ওঠে। অন্তত উঠতে বাধ্য। আমি কি ঠিক বলিনি? আমি ঠিকই বলেছি। তোমার আমার বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডুকতাকে পরিহার করে সমুদ্রের মতো উদার ও ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী হতে হবে। আমি তোমাদের কাছে এখন যে কথা বলবো তা আমাদের জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক তাগিদ। এই তাগিদকে স্মরণীয় করার জন্য আমি একটা পরিবেশ খুঁজছিলাম। হঠাৎ বঙ্গোপসাগরের কথা মনে পড়লো। এই উপসাগরেই রয়েছে দশ কোটি মানুষের উদরপূর্তির জন্য প্রয়োজনেরও অতিরিক্ত আহার্য ও মূলভূমি ভেঙে আসা বিপুল পলিমাটির বিশাল দ্বীপদেশ, যা আগামী দু’তিনটি প্রজন্মের মধ্যেই ভেসে উঠবে। যা বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন বিন্দু সংযোজনের তাগিদ দিবে। মনে রেখো, আমাদের বর্তমান দারিদ্র, ক্ষুধা ও অসহায়তা আমাদের উদ্দামহীনতারই আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তিমাত্র। আমাদের ভিটাভাঙা পলি যেখানেই জমুক, তা তালপট্টি কিংবা নিঝুম দ্বীপ, এই মাটি আমাদের। দশ কোটি মানুষ সাহসী হলে আমাদের মাটি ও সমুদ্রতরঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্রকারী নিশান উড়িয়ে পাড়ি জমাতে জাহাজ ভাসাবে না। মনে রেখো, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা দশ কোটি মানুষ যথেষ্ট সাহসী নই বলে শত্রুরা, পররাজ্যলোলুপ রাক্ষসেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এই স্বাধীন জলাধিকারে আনাগোনা শুরু করেছে। তোমরা বাংলাদেশের সবচে মেধাবী ছেলেমেয়ে, দেশের দরিদ্র পিতামাতার সর্বশেষ আশার প্রাণকণা, যাদের ওপর ভরসা করে আছে সারাদেশ, সারাজাতি। তোমারাই হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের পরাধীনতার কলঙ্কমোচনকারী প্রত্যাশার আনন্দ নিশ্বাস। ইতিহাসের ধারায় দৃষ্টিপাত করলেও তোমরা জানবে এই সমুদ্রে ছিল আমাদের আদিতম পূর্বপুরুষদের নৌশক্তির স্বাধীন বিচরণভূমি। এমনকি বৌদ্ধ যুগে পাল- রাজাদের অদম্য রণপোতগুলো এই জলাধিকারে কাউকেই অনধিকার প্রবেশ করতে দেননি। সন্দেহ নেই আমাদের সেসব পূর্বপুরুষগণ ছিলেন যথার্থই শৌর্যবীর্যের অধিকারী। তখন আমাদের জনগণ ছিল সংখ্যায় কত নগণ্য। কিন্তু আমরা সারাটা উপমহাদেশ, সমুদ্রমেখলা দ্বীপগুলো আর আসমুদ্র হিমাচল শাসন করেছি। প্রকৃতপক্ষে আমার স্বজাতির মধ্যে মেধারও অভাব নেই। শোনো ছেয়েমেয়েরা, আমি তোমাদের সান্নিধ্য পেয়ে খুবই খুশি। তিনটি দিন ও তিনটি রাত আমরা এই দরিয়ার নোনা বাতাসে দম ফেলতে এসেছি। এখন এই জাহাজটিই হলো বাংলাদেশ। আর আমি হলাম তোমাদের ক্যাপ্টেন। আমি চাই আমাদের দেশের প্রতিভাবান ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটা চাক্ষুস পরিচয় ও বন্ধুত্বের আদান প্রদান হোক। চেনাজানা থাকলে পারস্পরিক আত্মীয়তা রচিত হয়। হয় না কি? আমি তোমাদের কাছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ব্যক্ত করতে চাই। আমাদের রয়েছে যোজন যোজন উর্বরা জমি। একটু আয়েসের ফলেই যেখানে ফসলে ভরে যেতে পারে। অর্থৈর অভাবে শুধু কোনো বৈজ্ঞানিক চাষের উদ্যম নেওয়া যাচ্ছে না। কে আমাদের বিনাস্বার্থে এই উদ্যমে সহায়তা করবে? কেউ করবে না। অথচ যে সম্পদের বিনিময়ে অর্থের প্রাচুর্য ঘটে তা আমাদের দেশের পেটের ভিতরেই জমা আছে। আমরা তুলতে পারছি না। কী সেই সম্পদ যা আমরা তুলতে পারছি না? তোমরা কী জানো সেই লুক্কায়িত সাত রাজার ধন কী? কোথায় সেগুলো আছে? সেই সাত রাজার ধন হলো তেল, গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর আরও অনেক কিছু। গ্যাস আমরা খানিকটা তুলেছি বটে, তবে এর বিপুল ভাণ্ডারে এখনও হাত দেইনি। গ্রামে গ্রামে জ্বালানী সরবরাহের জন্য তিতাস, বাখরাবাদের মতো অসংখ্য গ্যাসকেন্দ্র দরকার। দরকার দেশের কোন কোন অঞ্চলের গ্যাসের পরের স্তর থেকে তেল নিংড়ে বের করে আনা। এতে আছে বাংলাদেশের পেটের ভেতরে লুক্কায়িত সাত রাজার ধন, পেট্রোল। বিশুদ্ধ পেট্রোল। যা পুড়িয়ে বিমান, গাড়ি অসংখ্য ভারী যানবাহন, সমুদ্রে জাহাজ অনায়াসে চলাচল করতে পারবে। শক্তির ধাত্রী এই তেল। আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। তোমরা ভাল করে দেখে রাখো ছেলেমেয়েরা, আমাদের হাতে রয়েছে সেই মহার্ঘ নিয়ামত যা বাংলাদেশের সীমানার ভেতর, মাটির উদরে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। যা ক্রমাগত বাধার ফলে আমি শত চেষ্টা সত্ত্বেও তোমাদের ভাগ্য ফেরাতে তুলে আনতে পারছি না। আমার জীবৎকালে সম্ভবপর না হলে তোমরা, আমার ছেলেমেয়েরা, এই তেল তুলবে।’’

এই ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। তিনি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এইভাবে, এই ভাষায় কথা বলতেন। এভাবেই তিনি তাদের ভেতর দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতেন। এভাবেই তিনি দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতেন। তাদের মেধা ও মননে মানুষের প্রতি ভালোবাসা এবং মানুষের জন্য কিছু করার বাসনা জাগিয়ে তুলতেন, তাদেরকে প্রেরণা দিতেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সৎ ছিলেন। তিনি সৎ জীবনযাপন করতেন। আরাম- আয়েশ, ভোগ-বিলাসের বিপরীতে কঠোর কৃচ্ছতার জীবন তিনি অতিবাহিত করতেন। তার ব্যক্তি চরিত্রে কোন দিনই অনৈতিকতা, ভ্রষ্টাচারিতা, স্বজনপ্রীতি তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতে নিজের বাবা –মা বা ভাইয়ের নামে বাংলাদেশের কোথাও কোন স্থাপনা বানাননি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের যে একটা ভাই জীবিত ছিলেন মারা না গেলে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বোধহয় এই কথা জানতেন না। তিনি চাটুকারিতা একদম পছন্দ করতেন না। তিনি দুর্নীতিবাজ ছিলেন না, দুর্নীতিবাজদের তিনি পছন্দ করতেন না। একবার তমদ্দুন মজলিশের অধ্যাপক আবদুল গফুর অসুস্থ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে হাসপাতালে দেখতে গেলে তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে তাঁর প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘‘আবদুল গফুর আমি আমার জীবনে তোমার চেয়ে বেশি সরকার ও বেশি নেতাদের দেখেছি। ব্রিটিশ আমলে দেখেছি, পাকিস্তান আমলে দেখেছি, বাংলাদেশ আমলেও দেখেছি। তুমি আমাকে একটা এক্সাম্পল দেখাও, কোন রাজনৈতিক নেতা কম-বেশি দূর্নীতি করে নাই বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় নাই এবং কোন নেতা স্বজনপ্রীতি করে নাই। এখন পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের ব্যক্তিগত দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। কোনো রকম স্বজনপ্রীতিও তাঁর মধ্যে নাই। তাঁর আত্মীয়-স্বজনকে কেউ চেনে না। তাঁদেরকে সে কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয় না। ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্টে এ ধরণের শাসককে মানুষ পছন্দ করে। একজন সৎ শাসকের তো প্রশংসাই প্রাপ্য।” সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ভাসানী কাহিনীতে এই কথাগুলো লিখেছেন।

জিয়াউর রহমান এমন একজন মানুষ যাকে ভালোবাসতে বিএনপি করতে হয়না। শুধু ভালোবাসার মত একটা মন থাকলেই হয়। তিনি জাতীয় নেতাদের কখনও অসন্মান করেননি। শেখ মুজিবুর রহমানকে কখনও অসন্মান করেননি। অথচ আজ তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনা জিয়াউর রহমানকে কতভাবে অপমাণ, অপদস্থ করছেন! আর কতভাবে অসন্মান করছেন! জিয়াউর রহমানের বীর উত্তমের পদক তিনি কেড়ে নিয়েছেন! এমনকি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানকে পাকিস্তানী চর বলার মত দৃষ্টতাও তিনি দেখাচ্ছেন! অবশ্য কাউকে সম্মান করতে, শ্রদ্ধা করতে, শিক্ষা লাগে, কলিজা লাগে। আর অসম্মান করতে কিছুই লাগেনা, জাস্ট মূর্খতা থাকলেই হয়। পরিবার এবং সমাজ থেকে মানুষের মাঝে মূর্খতা ইনহেরিট করে। এখন মূর্খতার জয় জয়াকার চারিদিকে। যে যত বড় মূর্খ বেয়াড়া, সে তত বড় ক্ষমতাশালী বিত্তবান। আর গড়পড়তা বাঙালি এই মূর্খতারই পূজারি। আর এই মূর্খতা থেকেই আসে অহংকার, দাম্ভিকতা। জ্ঞানের সর্বশেষ স্তরে আসে বিনয়। ইতিহাস বিমুখ অগভীর বাঙালি তাই বিনয়কে দুর্বলতা ও পরাজয়জ্ঞান করে। একটা উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শেষ করবো। জিয়াউর রহমান পাকিস্তানী চর ছিলেন। তাকে জোর করে ধরে নিয়ে এসে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করানো হয়েছিলো ইত্যাদি বস্তাপচা আওয়ামী বয়ান ও আওয়ামী প্রধান শেখ হাসিনার অশ্রাব্য আর অশালীন মন্তব্য শুনতে শুনতে আমাদের কান পচে গেছে। অথচ জিয়াউর রহমান যখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেননি, ক্ষমতায় আসেননি, দল করেননি তখন কী আওয়ামী লীগ আর তাঁর প্রধান শেখ হাসিনা এসব কথা বলেছেন? তাজ উদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর ১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রথম বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরোধব্যুহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাইবোনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মোকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরোধ স্টালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরোধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শত্রুর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নোয়াখালী জেলাকে মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে।” মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই জিয়াউর রহমানের বীরত্ব, সাফল্য ও কৃতিত্বের ব্যাপারে যুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে মুক্তকণ্ঠে উচ্চারিত এই উচ্ছ্বসিত প্রসংশা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অমোচনীয় রেকর্ড। অথচ অর্বাচীনেরা এখন কী বলে বেড়াচ্ছেন! সেই একই ভাষণে আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন , “এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তোলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কন্ঠস্বর। এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করা হয়।” পাঠক বুঝেন তাহলে। কালুরঘাটের বেতার তরঙ্গ মারফত জিয়াউর রহমানের স্বকণ্ঠে দেয়া ঘোষণাকে সেই সময়েই প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর।’ তার অর্থ খুব পরিষ্কার। অর্থাৎ এই ঘোষণার আগে আর কোনো কণ্ঠ থেকেই উচ্চারিত হয়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা, এটাই প্রথম। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে তাজ উদ্দীন আহমেদ সারা দুনিয়ার সামনে দেয়া বেতার ভাষণে তিনি কি নিশ্চিত না হয়ে এই কথা এতো স্পষ্ট করে বলেছিলেন? কেবল তাই নয়, জিয়াউর রহমান নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিবাহিনীর সাময়িক প্রধান হিসেবে উল্লেখ করে সরকার গঠনের যে ঘোষণা দেন, সে ঘোষণাও তিনি এই বক্তব্যের মাধ্যমে অনুমোদন করেন। এতে সরকার ধারাবাহিকতা পায়। এর আগে পয়লা এপ্রিল তেলিয়াপাড়া চা বাগানে কর্ণেল এম এ জি ওসমানীকে প্রধান করে মুক্তিবাহিনীর কমান্ড স্ট্রাকচার গঠিত হলে মুক্তিবাহিনী প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমানের সাময়িক দায়িত্বের অবসান ঘটে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হলে অবসান ঘটে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়াউর রহমানের প্রতিকী দায়িত্ব পালনের। এগুলো আওয়ামী লীগ ও তাঁর প্রধান শেখ হাসিনা কখনো নিজে থেকে না বলেন বা অস্বীকার করেন তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে। ইতিহাসের সেই নিজস্ব গতিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বীয় আলোয় বাংলার আকাশে উজ্জল তারা হয়ে আছেন। বাংলার ইতিহাসে তিনি উজ্জল তারা হয়েই থাকবেন। ইতিহাসের নিজস্ব গতি কেউ রুখতে পারেনি, পারবেওনা কোনদিন। ইতিহাস একটি বহতা নদীর মত। স্তাবক ঐতিহাসিককে দিয়ে যেমন এর গতিরোধ করা যায় না। তেমনি `পেইড লেখক’, ‘মোসাহেব কথক’ বা ‘পতিত রাজনীতিজীবি’ কারো অপচেষ্টায়ই ইতিহাসের সত্যগতি অন্যদিকে ফেরানো অতীতে যায়নি, যায় না এবং ভবিষ্যতেও যাবে না। আব্রহাম লিংকন কতই না চমৎকার একটি উক্তি করেছেন! তিনি বলেছিলেন- “You can fool all the people some of the time, and some of the people all the time, but you cannot fool all the people all the time.”

৩০ই মে শুধু প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কে হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছিলো একটি আদর্শকে, হত্যা করা হয়েছিলো বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকলে আজ বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার চেয়েও অনেক অনেক এগিয়ে থাকতো। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা, বিশ্বাসঘাতকেরা তাকে এমন এক সময়ে হত্যা করেছিলেন, যে সময়ে তাকে খুব প্রয়োজন ছিল আমাদের। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মত একজন মহান দেশ প্রেমিক ও বীর উত্তমকে হারিয়ে আমরা গভীর শোকাহত। মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা, শহীদ প্রেসিডেন্ট  জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের ৪২ তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি! আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।

লেখক: চিফ রিপোর্টার, সাপ্তাহিক সুরমা। সাবেক প্রেসিডেন্ট, এশিয়ান স্টুডেন্টস ইউনিয়ন। প্রেসিডেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য। সভাপতি, শেরপুর ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এসোসিয়েশন, ইউরোপ।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close